মো.আবু রায়হানঃ১৯৯১ সালের আগে পর্যন্ত আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান, দুটি দেশই ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর দুটি স্বাধীন দেশ হিসেবে তারা আলাদা হয়।আজারবাইজান সরকারী নাম আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র ।এশিয়া মহাদেশের একটি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র।আয়তন ৮৬ হাজার ৬০০বর্গকিলোমিটার। আয়তন ও জনসংখ্যার দিকে থেকে এটি ককেশীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বৃহত্তম। দেশটির উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে ইরান, পশ্চিমে আর্মেনিয়া, উত্তর-পশ্চিমে জর্জিয়া। এছাড়াও ছিটমহল নাখশিভানের মাধ্যমে তুরস্কের সাথে আজারবাইজানের একচিলতে সীমান্ত আছে। আজারবাইজানের রাষ্ট্রভাষা আজারবাইজানি। কাস্পিয়ান সাগরতীরে অবস্থিত বন্দর শহর বাকু আজারবাইজানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ১৯২২ সালে দেশটি আন্তঃককেশীয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটি ভেঙে তিনটি আলাদা প্রজাতন্ত্র আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়াতে ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ২০শে অক্টোবর আজারবাইজান স্বাধীনতা লাভ করে। এখনও নাগোর্নো-কারাবাখ ও আরও ৭টি আজারবাইজানি জেলা আর্মেনীয়দের সামরিক নিয়ন্ত্রণে আছে।আজারবাইজানে প্রায় ৯৬ লক্ষ ২৪ হাজার ৯০০ লোকের বাস।আজারবাইজানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী।৯৫% লোক জাতিগতভাবে আজারবাইজানি।ইসলাম ধর্ম (মূলত শিয়া) আজারবাইজানিদের প্রধান ধর্ম। এখানে মূলত শিয়া মুসলিম ধর্মাবলম্বী আজেরি জাতির লোকদের বাস।
আর্মেনিয়া পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। ১১,৪৮০ বর্গ মাইলের ছোট্ট এই দেশ নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রায় ৩,০০০ বছরের প্রাচীন সংস্কৃতি, ভাষা আর ঐতিহাসিক সব নিদর্শন সংরক্ষণ করে আসছে। দেশটির উত্তরে জর্জিয়া, দক্ষিণে ইরান, পূর্বে আজারবাইজান ও পশ্চিমে তুরস্ক।ইয়েরেভান দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। জাতিগত আর্মেনীয়রা নিজেদের হায় বলে ডাকে এবং আর্মেনিয়ার ৯০% লোক হায় জাতির লোক। ১৯২২ সালে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯১ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।২০১১ এর আদমশুমারি অনুযায়ী আর্মেনিয়ার জনসংখ্যা প্রয় ৩০ লাখ ১৮ হাজার। খ্রিস্টানধর্ম, প্রায় ৯৫% অধিবাসীর ধর্ম। যিশুর দুই শিষ্য বার্থেলেমিউ ও থাদেউস প্রথম শতকেই এখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন।ইতিহাসে আর্মেনিয়া প্রথম দেশ যারা খিস্টান ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেছিল।এখানকার শতকরা ৯০ ভাগ লোক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী বিদ্যমান। স্বল্পসংখ্যক ইহুদি, ইয়াজিদি ও মুসলমান অধিবাসী বসবাস করেন।
নাগোর্নো-কারাবাখ নামে বিতর্কিত একটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুসলিম আজারবাইজান এবং খ্রিস্টান আর্মেনিয়ার মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে গত চার দশক ধরে এই দুই দেশ দ্বন্দ্বে লিপ্ত। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে তিন শতাধিক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।নাগোর্নো-কারাবাখ আজারবাইজানের বলেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।আজারবাইজানের পার্বত্য অঞ্চল নাগোর্নো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ আর্মেনীয় নৃগোষ্ঠীর হাতে রয়েছে ।নাগোর্নো-কারাবাখ ককেশাস পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত একটি বিস্তৃত উচ্চভূমি। নাগর্নো-কারাবাখ ছিটমহলটির মোট আয়তন৪,৪০০ বর্গকিলোমিটার।ছিটমহলটির বাসিন্দাদের শতকরা ৯০ ভাগ জাতিগত আর্মেনীয়। ১৯২৩ সালে তত্কালীন সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্ট্যালিন একে আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে আজারবাইজানের সঙ্গে জুড়ে দেন। নাম দেওয়া হয় নাগোর্নো-কারাবাখ অটোনোমাস ওব্লাস্ট (এনকেএও)।আর্মেনিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক ইস্যুটি এরপর দীর্ঘ সময় অমীমাংসিত অবস্থায় পড়ে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগ অবসানের কিছুকাল আগে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে জাতীয়তাবাদীদের বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। তারা আজারবাইজানের কাছ থেকে কারাবাখকে ফেরত চায়। উল্লেখ্য, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান তখনো সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই প্রজাতন্ত্র।উভয় প্রজাতন্ত্রে জাতিগত আজারি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে তখন থেকে উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করে। বাকু থেকে বহিষ্কৃত হয় আর্মেনীয় জাতিগতরা। এনকেএওর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এর অল্প পরেই আর্মেনিয়ার সঙ্গে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের তখনো তিন বছর বাকি। সোভিয়েত নিরাপত্তা বাহিনী তখন দফায় দফায় আর্মেনিয়ায় দমনাভিযান চালায়। আজারবাইজানের ভেতরও উত্তেজনা বেড়ে চলে। ১৯৯১ সালের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মধ্য এশিয়ার অনেক প্রজাতন্ত্রের মতো স্বাধীনতা ঘোষণা করে নাগোর্নো-কারাবাখ । শুরু হয়ে যায় পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পক্ষে থাকে কারাবাখ ও আর্মেনিয়া অন্যদিকে আজারবাইজান। ১৯৯৪ সালে দুই পক্ষের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি হয়। তিন বছরের যুদ্ধে ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, বাস্তুচ্যুত হয় ১০ লাখের বেশি। যুদ্ধের পর কারাবাখ কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা ভোগ করছে, যদিও এই স্বাধীনতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়নি। কারাবাখ এখনো আজারবাইজানের আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যে রয়েছে কিন্তু ছিটমহলটির ওপর বাকুর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।১৯৯৪তে যুদ্ধবিরতির পর থেকে ‘মিনস্ক গ্রুপ‘ নামে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের কূটনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল নাগোর্নো-কারাবাখ সংকট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি আপোষ মীমাংসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত তিন দশক ধরে পরিস্থিতির কোনো অগ্রগতি না হওয়া নিয়ে আজারবাইজানের মধ্যে হতাশা দিনদিন বাড়ছে। আজেরিরা দেখছে যে যুদ্ধের প্রায় তিন দশক পরও নাগোর্নো-কারাবাখ এবং আজারবাইজানের কমপক্ষে সাতটি দখল হয়ে যাওয়া এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে আর্মেনিয়া।নাগোর্নো-কারাবাখ আজারবাইজানের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অংশ হলেও এটির নিয়ন্ত্রণ আর্মেনিয়ার হাতে যা আজেরিরা কখনই মেনে নেয়নি। ফলে যুদ্ধবিরতি মাঝে মধ্যেই ভেঙ্গে পড়ে এবং ২০১৬ সালে দুই দেশের মধ্যে চারদিনের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয় যা রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের হস্তক্ষেপে থামে। করোনাভাইরাস প্যানডেমিকের মধ্যেই দুই বৈরি প্রতিবেশী আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে পুরাদস্তুর যুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা নিয়ে গভীর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।২০২০ সালে জুলাইতে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সীমান্তে ব্যাপক সংঘাত হয়। এতে উভয়পক্ষের ১৭ সেনা নিহত হন।আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আটকাতে দেওয়া বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার মানুষ সহিংস বিক্ষোভ করে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর দাবি করে।জাতীয় পতাকা নিয়ে মানুষজন স্লোগান তুলেছে নাগোর্নো-কারাবাখ আজারবাইজানের “দ্রুত সৈন্য পাঠাও“।এ ধরণের পরিস্থিতির পর আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য দুই দেশের প্রতি আহ্বান জানায়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেন “যুক্তরাষ্ট্র খুবই উদ্বিগ্ন“, এবং তিনি দুই দেশের মধ্যে দ্রুত শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর আহ্বান জানান।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, আজারবাইজানকে রক্ষার জন্য বিন্দুমাত্র দ্বিধা তিনি করবেন না।পশ্চিমের অনেক দেশ আর্মেনিয়াকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে আসছে। সে তুলনায় আজারবাইজান সহায়তা পায়নি। আজারবাইজান একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাশিয়া তখন আজারবাইজানের তেল শোষণ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ প্রয়োজনের সময় রাশিয়া তাদের সহায়তা না দিয়ে আর্মেনিয়াকে সাহায্য করছে।আজেরি প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ খোলাখুলি বলেন, আন্তর্জাতিক এই মীমাংসা “অর্থহীন।“ তার দুদিন না যেতেই সীমান্তে শুরু হয় এই লড়াই।পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নব্বই দশকের তুলনায় আজারবাইজানের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি এখন অনেকটাই বেড়েছে। ২০১৭ সালে আজারবাইজান সামরিক খাতে যে ব্যয় করেছে তা আর্মেনিয়ার পুরো বছরের বাজেট। ফলে, আজেরিদের মধ্যে নাগোর্নো-কারাবাখের বাস্তবতা পরিবর্তনের সংকল্প শক্ত হচ্ছে।সর্বশেষ রবিবার দুই পক্ষের মধ্যে হামলার ঘটনা ঘটে ।এক বিবৃতিতে আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, রবিবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১০ মিনিটের দিকে হামলা চালায় আজারবাইজান। এর জবাবে আর্মেনিয়ার বাহিনী প্রতিপক্ষের দুটি হেলিকপ্টার, তিনটি ড্রোন ভূপাতিত ও তিনটি ট্যাংক ধ্বংস করেছে।তিনি আরও বলেন, আর্মেনিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে তারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে। এ সময় তারা ট্যাংক, আর্টিলারি মিসাইল, যুদ্ধবিমান এবং ড্রোন ব্যবহার করেছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আজারবাইজানের হেলিকপ্টার ভূপাতিত করা হলেও ক্রুরা জীবিত আছেন। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র হিকমেত হাজিয়েভ এক বিবৃতিতে বলেন, হতাহতদের মধ্যে সাধারণ মানুষ এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোও জানিয়েছে, ওই অঞ্চলে সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছে।আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বিবৃতিতে জানান,নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে আর্মেনিয়ার এক নারী এবং এক শিশু নিহত হয়েছে।বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলটির কর্তৃপক্ষ যুদ্ধের ঘোষণা পর আর্মেনিয়া সরকারও মার্শাল জারি করেছে এবং সেনাদের প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এক বিবৃতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান বলেন, আমাদের পবিত্র মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য প্রস্তুত হোন।আর্মেনিয়া সরকারিভাবে নাগার্নো কারাবাখ প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে তাদের সব ধরনের সহায়তা আর্মেনিয়া দিয়ে থাকে। রাাশিয়াও নিজের স্বার্থে স্বঘোষিত কারাবাখ প্রজাতন্ত্রকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। এখানকার সমস্যা ভূখণ্ড সম্পর্কিত ও জাতিগত। এখানকার লোকজন বেশির ভাগ আর্মেনীয় ভাষায় কথা বলে। তবে বিভিন্ন হিসাবে পুরো এলাকাটি আজারবাইজানের এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। তাই আজারবাইজান এলাকাটি দাবি করছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, আর্মেনিয়া আজারবাইজানের অখণ্ডতার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। যুদ্ধবিরতির কারণে যুদ্ধ বন্ধ থাকলেও মাঝে মধ্যে তা বিস্ফোরণোম্মুখ হয়ে ওঠে। প্রায় পাঁচ লাখ আর্মেনীয় আজারবাইজানে বসবাস করছে। এদের অনেকেই উদ্বাস্তু। যদি আর্মেনিয়ার সাথে আবারো বড় ধরনের যুদ্ধ হয়, তবে এদের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটতে পারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন