যেভাবে হায়দরাবাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিল ভারত

গোলকোন্ডা দুর্গ

মো.আবু রায়হানঃ সাবেক হায়দরাবাদ দেশীয় রাজ্য ১৯৫৬ সালে পুনর্গঠিত হয়। ভাষাতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় রাজ্যগুলির পুনর্গঠনের সময় ১৯৫৬ সালে, হায়দরাবাদ রাজ্যটি অন্ধ্র প্রদেশ এবং বোম্বাই রাজ্যের মধ্যে বিভক্ত হয়।১৯৬০ সালে এর অংশগুলো ভারতের অঙ্গরাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ, বোম্বে রাজ্য (পরে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট হিসেবে ভাগ হয়) এবং কর্ণাটকের মধ্যে বন্টিত রয়েছে।একসময়ে অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী ছিল হায়দরাবাদ শহর। কিন্তু পুরনো অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙ্গে এখন তৈরি হয়েছে নতুন রাজ্য তেলেঙ্গানা।রাজধানী হায়দরাবাদ পড়েছে তেলেঙ্গানার অংশে।বর্তমানে হায়দরাবাদ ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী ও সবচেয়ে বৃহত্তম শহর। জন এভারেট-হিথের মতে,হায়দরাবাদের অর্থ হায়দারের শহর বা "সিংহের শহর" যেখানে হায়দার (অর্থ সিংহ) এবং আবাদ (অর্থ শহর)। খলিফা আলী ইবনে আবী তালিবকে সম্মান জানাতে নামকরণ করা হয়েছিল, যিনি যুদ্ধে সিংহের মতো বীরত্বের কারণে হায়দার নামেও পরিচিত ছিলেন।ইসলামী স্থাপত্যের পন্ডিত অ্যান্ড্রু পিটারসনের মতে,শহরটিকে আসলে বাগনগর (উদ্যানের শহর) বলা হত।একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব থেকে জানা যায় যে নগরটির প্রতিষ্ঠাতা গোলকোন্ডা সালতানাতের মুহাম্মদ কুলী কুতুব শাহ স্থানীয় নাচনেওয়ালী ভাগমতীর তিনি প্রেমে পড়েছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং হায়দার মহল উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তার সম্মানে এই শহরটির নামকরণ করা হয় হায়দরাবাদ। হায়দরাবাদ ডেকান নামেও পরিচিত।




ব্রিটিশ-ভারতের ৫৫৬টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে হায়দরাবাদ ছিল সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এর আয়তন ছিল ৮৬,০০০ বর্গ কিমি যা বর্তমান যুক্তরাজ্যের প্রায় সমান। ১৫৯০ সালে গোলকুণ্ডার শাসক কুলি কুতুব শাহ হায়দরাবাদ নগরী প্রতিষ্ঠা করলেও স্বাধীন রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় আরও ১৩০ বছর পরে। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পরে ১৭২৪ সালে নিজাম উল-মুলক আসফ জাহ হায়দরাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।১৭২৪ থেকে ১৮৫৭ রাজ্যটি নিজামদের শাসনাধীনে ছিল, যারা প্রাথমিকভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের ডেকান বা দাক্ষিণ্যাতের ভাইসরয় ছিলেন। ১৭২৪ সালে আসফ জাহ (মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি) নিয়ে পুনরায় শাসন শুরু করেন। তাঁর অন্য উপাধি নিজাম উল-মুলক তাঁর পদমর্যাদায় পরিণত হয়েছিল হায়দরাবাদের নিজাম। তাঁর শাসনামলের অবসানের পরে নিজাম মুঘলদের কাছ থেকে স্বাধীন হয়ে আসফ জাহি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন।আসফ জাহি রাজবংশের প্রধান দ্বারা শাসিত হতো, যাকে নিজাম উপাধি দেওয়া হয়েছিল এবং যার উপর ব্রিটিশরা তাকে হিজ এক্সালটেড হাইনেস বলে সম্বোধন করতো।বৃটিশ শাসনামলে হায়দরাবাদ রাজ্যটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল আর্থার ওয়েলেসলি ঘোষিত অধীনতামূলক মিত্রতার আওতায় ব্রিটিশের আশ্রিত রাজ্যের মর্যাদা হিসাবে টিকে থাকে।হায়দরাবাদ ক্রমবর্ধমান জোট চুক্তি স্বাক্ষর করে ব্রিটিশদের প্রভাবের অধীনে প্রথম দেশীয় রাজ্যে পরিণত হয়।ব্রিটিশ সরকার নিজামকে সম্মানসূচক লেফটেনেন্ট জেনারেল পদবিতে ভূষিত করেছিল। ব্রিটিশ রাজধানীতে তার আগমনে ২১ বার তোপধ্বনি করা হতো। তুর্কি সুলতানের কাছ থেকে তিনি খলিফা উপাধি পেয়েছিলেন।

চারমিনার

সর্বশেষ নিজাম মীর ওসমান আলী খান ১৯১১ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন।নিজাম, মীর ওসমান আলী খান ১৯৩০ এর দশকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন।১৯৪০ এর দশকের শুরুর দিকে তার ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদ ছিল বলে জানা যায়। সেসময় নবগঠিত ভারতীয় ইউনিয়ন সরকারের কোষাগারের রিপোর্ট মোতাবেক বার্ষিক রাজস্ব ছিল এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৩৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি টাইম ম্যাগাজিনে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি বর্ণনা করে প্রচ্ছদে তার ছবি ছাপা হয়। ধারণা করা হয় যে ১৯৬৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন।১৯৪৭ সালে নিজাম প্রিন্সেস এলিজাবেথকে তার বিয়ে উপলক্ষে হীরা, টায়রা খচিত একটি হার উপহার দেন। এটি হায়দরাবাদের নিজামের হার নামে পরিচিত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করায় তাকে ব্রিটিশ সিংহাসনের বিশ্বস্ত মিত্র ঘোষণা করা হয়েছিল। হায়দরাবাদকে এই সময়ের মধ্যে পশ্চাৎপদ, তবে শান্তিপূর্ণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। নিজামের শাসনামলে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে হায়দরাবাদের বিকাশ ঘটে। হায়দরাবাদকে স্বাধীন জাতি হিসাবে রাখার জন্য নিজাম পশ্চিমের মারাঠাদের প্রতিরোধ করার জন্য রাজ্যে তার বাহিনী রাখার জন্য ব্রিটিশ ভারতের সাথে আলোচনা করেন। নিজাম সরকার দেশ গঠনের অংশ হিসাবে হায়দরাবাদের উন্নয়নের জন্য বিশ্বজুড়ে টেকনোক্র্যাটদের আমন্ত্রণ জানান। এটির নিজস্ব বৈদেশিক নীতি রয়েছে এবং ব্রিটিশ ভারতের বাইরের অনেক দেশের সাথে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। নিজাম সরকার নতুন রাজধানী নয়াদিল্লিতেও দূতাবাস স্থাপন করেছিলেন। হায়দরাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ সহযোগী হওয়ায় এটি ব্রিটিশ ভারতের সাথে কাজ করার জন্য তার দূতাবাস হিসাবে 'হায়দরাবাদ হাউস' ডিজাইন ও নির্মাণের জন্য স্যার এডওয়ার্ড লুটিয়েনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজ্য জুড়ে বেশ কয়েকটি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনেক লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ( ফানি বাদায়ুনি, দাগহ দেহলভী, জোশ মালিহাবদী, আলী হায়দার তাবাতাবাই, শিবলি নোমানী, নবাব মহসিন-উল-মুলক, মির্জা ইসমাইল ) আসফ জাহ সপ্তম এবং তাঁর পিতা পূর্বসূরীর আসফ জাহ ষষ্ঠের রাজত্বকালে ভারতের সমস্ত অঞ্চল থেকে হায়দরাবাদে পাড়ি জমান। নিজাম হায়দরাবাদ স্টেট ব্যাংকও প্রতিষ্ঠা করেন। হায়দরাবাদ ব্রিটিশ ভারত উপমহাদেশের একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল যার নিজস্ব মুদ্রা ছিল হায়দরাবাদী রুপী।বেগমপেট বিমানবন্দরটি ১৯৩০-এর দশকে নিজাম কর্তৃক হায়দরাবাদ এরো ক্লাব গঠনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এটি ব্রিটিশ ভারতের প্রথমতম বিমান সংস্থা ডেকান এয়ারওয়েজের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসাবে ব্যবহৃত হতো। টার্মিনাল বিল্ডিংটি ১৯৩৭ সালে নির্মিত হয়েছিল। তিনি তার শাসনামলে শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করেন। তিনি উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ।বড় ধরনের বন্যা, প্রতিরোধ করার জন্য নিজাম দুই হ্রদ ওসমান সাগর এবং হিমায়েত সাগর নির্মাণ করেন। এই সময়কালে ওসমানিয়া জেনারেল হাসপাতাল, জুবিলি হল, স্টেট লাইব্রেরি ( তৎকালে আসিফিয়া কুতুবখানা নামে পরিচিত) এবং পাবলিক গার্ডেন (তৎকালীন বাগ-ই -আম নামে পরিচিত) নির্মিত হয়। ১৯০১ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এই রাজ্যের গড় আয় ছিল ৪৭১,০০,০০০ রুপি যা এটিকে ভারতের সবচেয়ে ধনী দেশীয় রাজ্য হিসাবে গড়ে তুলেছিল। হায়দরাবাদ ডেকানের আদি বাসিন্দারা, জাতি বর্ণ নির্বিশেষে, মুলকি (দেশবাসী) নামে পরিচিত ছিল, এটি আজও ব্যবহৃত হয়।ব্রিটিশ রাজের শেষ বছরগুলিতে রাজবংশটি নিজেকে স্বাধীন রাজতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করে।
হায়দরাবাদ রাজ্যের প্রতীক
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগের পূর্বে ভারতে স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে।তবে স্বাধীনতার পর নব গঠিত পাকিস্তান বা ভারতের যেকোনো একটিতে স্বাধীন রাজ্যগুলোকে যোগদানের সুযোগ দেয়া হয়। ভারত স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ এর ২.৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চাইলে স্বাধীন থাকার সুযোগও ছিল।হায়দরাবাদ ছিল মুসলিম শাসকের অধীনে এর শাসক ছিলেন নিজাম উসমান আলি খান এবং রাজনীতি মুসলিম অভিজাতদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।১৯৪৭ সালের ১১ ই জুন নিজাম গণপরিষদে পাকিস্তান বা ভারতের যে কোনও একটিতেও অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন।এসময় নিজামের শাসনাধীনে প্রায় ১৬ মিলিয়ন জনগণ, মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও নিজামপন্থি মুসলিম দল ইত্তেহাদ উল মুসলিমিন ভারত ও পাকিস্তানের মত হায়দরাবাদের স্বাধীন থাকার পক্ষে জোর দেয়।(১৯২৭ সালে প্রথম মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (কাউন্সিল ফর ইউনিটি অফ মুসলিম, সংক্ষেপে ইত্তেহাদ) গঠিত হয়। মুসলমানদের একত্রিত করার এবং শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের উদ্দেশ্যগুলি উল্লেখ করা ছাড়া প্রথম দশকে এর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব অল্পই ছিল। তবে এটি মুসলিম স্বার্থের নজরদার হিসাবে কাজ করেছিল এবং সরকার ও প্রশাসনে মুসলমানদের সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থানকে রক্ষা করেছিল)।১৯৪৮ সনের ৩০ জুলাই ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির বিরোধী দলীয় নেতা, সাবেক ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির বিরোধী দলীয় নেতা, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর একটি বয়ান; ‘যদি এবং যখন প্রয়োজন মনে করবো, হায়দারাবাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান শুরু করা হবে।’ এই দাম্ভিক উক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কমন্সসভায় বলেছিলেন, ‘নেহরুর ভীতি প্রদর্শনের ভাষা অনেকটা হিটলারের ভাষার অনুরূপ যা তিনি অস্ট্রিয়া ধ্বংস করার সময় ব্যবহার করেছিলেন।’ [Churchill Compared Nehru’s threat to the language which Hitler might have used befor the devouring of Austria] [V.K. Bawa , The last Nizam] তিনি ব্রিটিশ মন্ত্রীসভাকে সতর্ক করে বলেছিলেন যে, ‘তাঁদের পবিত্র দায়িত্ব এবং কর্তব্য হচ্ছে- যে সমস্ত রাজ্যকে সার্বভৌম মর্যাদা দান করা হয়েছে, সেগুলোকে গ্রাস করা, শ্বাসরুদ্ধ করা বা অনাহারে রেখে শক্তিহীন করে গ্রাস করার অপচেষ্টাকে ব্রিটিশ সরকার যেন অনুমোদন না দেয়।’ ১৯৪৭ সনের ৯ জুলাই নিজাম ব্রিটিশ সরকারকে যে পত্র দিয়েছিলেন সেই পত্রে তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে হায়দারাবাদের শিক্ষা সংস্কৃতির সাদৃশ্য এবং যোগসূত্র বিদ্যমান, তদুপরি হায়দারাবাদের দীর্ঘস্থায়ী স্বায়ত্বশাসনের আকাঙ্খার কারণেই তিনি ভারতভুক্ত হতে আগ্রহী নন।ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিজামকে পাকিস্তানে যোগ না দিতে পরামর্শ দেন।নিজাম একটি ফরমানের মাধ্যমে ঘোষণা করেন যে হায়দরাবাদ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে এবং ভারতীয় ইউনিয়নের যোগ দেবে না। তবে ভারত সরকার তার এই ফরমান প্রত্যাখ্যান করে এবং এর আইনত বৈধতা নেই বলে দাবি করে।। হায়দরাবাদ চতুর্দিক থেকে ভারত কর্তৃক আবদ্ধ ছিল এবং এর কোনো সমুদ্র সীমা ছিল না। তাই স্বাধীন হায়দরাবাদ ভারতের পক্ষে সুবিধাজনক ছিল না। ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ভোর চারটায় ভারতের হায়দরাবাদ অভিযান, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোড-নাম অপারেশন পোলো শুরু হয়েছিল। মেজর জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরীর অধীনে এক ডিভিশন ভারতীয় সেনা ও একটি ট্যাঙ্ক ব্রিগেড হায়দরাবাদে আক্রমণ চালায়। সমস্ত দিক থেকে হায়দরাবাদ আক্রমণ করে ভারতীয় সেনারা। নিজাম এই হামলা প্রতিহত করতে অক্ষম ছিলেন।কারণ তার সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪,০০০, যাদের মধ্যে প্রায় ৬,০০০ পুরোপুরি প্রশিক্ষিত এবং সজ্জিত ছিল। ফলে নিজাম পরাজিত হন। ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৫ টায় নিজামের সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এরপরে ভারত হায়দরাবাদ রাজ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং নিজামদের শাসনের অবসান ঘটে এবং স্বাধীন হায়দ্রাবাদের অস্তিত্ব বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে যায়।
হায়দরাবাদের পতাকা
“হায়দারাবাদ : একটি মুসলিম ট্র্যাজেডি” শীর্ষক এক প্রবন্ধে অধ্যাপক উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য উল্লেখ করে লিখেছেন, “যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর মুসলমানরা (গণহারে)ব্যাপক আঘাত ও পাশবিক হামলার শিকার হয়।ধ্বংসযজ্ঞের পর যারা বেঁচে ছিলেন তারাও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন।তাদের হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং উচ্ছেদ করা হয় কয়েক লাখ মানুষকে। মুসলিম বাহিনীর সহযোগীদের কথিত সহিংসতার প্রতিশোধ নেওয়ার অজুহাত দেখিয়েই এইসব নারকীয় অভিযান চালানো হয়েছিল। (দ্য মিডল-ইস্ট জার্নাল’, খণ্ড ৪, প্রকাশিত ১৯৫০, উদ্ধৃত: সাম্প্রতিক দেশকাল, ১০ অক্টোবর ২০১৩)।হায়দারাবাদ দখলের পরপরই গণহত্যার খবর আসতে থাকে। মুসলিমদের গণঅসন্তোষের ভয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু কংগ্রেসের সংসদ সদস্য পন্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন যাতে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মেরই সদস্য ছিলো।এ কমিটি হায়দারাবাদ ঘুরে এসে তাদের রিপোর্ট জমা দেয় যা সুন্দরলাল রিপোর্ট নামে পরিচিত। নেহেরু থেকে শুরু করে মনমোহন পর্যন্ত, ভারত সরকার এ রিপোর্ট সম্পর্কে গোপনীয়তা বজায় রেখেছে।গণহত্যার বিষয়ে বহির্বিশ্ব ও ভারতের জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়। সর্বশেষে ২০১৩ সালে দিল্লীর নেহেরু স্মৃতি জাদুঘরে এ রিপোর্ট জনসম্মুখে আসে। কমিটির মতে, খুব কম করে ধরলেও ২৭,০০০ থেকে ৪০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।যদিও এ জি নুরানি ও অন্যান্য গবেষকদের মতে এ সংখ্যা ২ লাখ বা তার থেকেও বেশি। কমিটির রিপোর্টে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী এ সকল গণহত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলো।হায়দরাবাদ রাজ্যকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার পরে এমকে ভেলোদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন।নিজাম উসমান আলি খানকে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তাকে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের রাজপ্রমুখ করা হয়। ১৯৫৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন।১৯২০ সালের ১৪ এপ্রিল উসমান আলি খানের সাথে তার প্রথম স্ত্রী আজমাতুন্নিসা বেগমের বিয়ে হয়। আজম জাহ ও মুয়াজ্জাম জাহ তাদের পুত্র। তার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন ইকবাল বেগম। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আজম জাহর সাথে শেষ উসমানীয় খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদের কন্যা দুররু শেহভারের বিয়ে হয়। মুয়াজ্জাম শাহ উসমানীয় রাজকুমারি নিলুফারকে বিয়ে করেন।উসমান আলি খান ১৯৬৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তার জানাজা ভারতের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জানাজাসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল।

নিজামের জানাজা মিছিলে জনতা
আনুমানিক ১০ লাখ মানুষ নিজাম বন্দুক-কার্ট মিছিলের অংশ হয়ে উঠেছে।এই শহরের রাজনীতি এখনো নিজাম-শাসন প্রভাবিত। শহরের একটি মাত্র লোকসভা আসন রয়েছে যা ১৯৮৪ সালের সাধারণ নির্বাচন থেকে সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন নামক রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় রয়েছে , যা এই দলের একমাত্র লোকসভা আসন ও। এই আসনের অধীনে চারমিনার , চৌমহল্লা প্রাসাদ, মক্কা মসজিদ ও নিজামের অলংকার প্রাসাদ এর এলাকাগুলি রয়েছে। ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ অব্দি সাংসদ ছিলেন সুলতান সালাউদ্দিন ওয়াইসি। তারপর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আসাদউদ্দিন ওয়াইসি সাংসদ হন। সালাউদ্দিন-এর অপর পুত্র আকবরউদ্দিন ওয়াইসি এই আসনের অন্তর্গত বিধানসভা আসন চন্দ্রায়ণগুত্তা-র বিধায়ক। এই আসনের অন্তর্গত গোসামহল বিধায়ক আসনটি ব্যাতিক্রমে ভারতীয় জনতা পার্টি-র দখলে, যা দলের একমাত্র বিধানসভা আসন।
সিকেন্দ্রাবাদ স্টেশনের একটি ইঞ্জিন (১৯২৮)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল