ফিলিস্তিনের হামাস- ফাতাহ ঐক্য কতদূর ?
মো.আবু রায়হানঃ ফিলিস্তিনে দুটি দল বেশ সক্রিয়। একটি হামাস, অন্যটি ফাতাহ। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের মূল শক্তি হলো ফাতাহ। দলটি ইসরাইলি দখলদার সরকারের সমর্থনপুষ্ট। ফাতাহ ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ১৯৫৯ সালে গঠিত দল। ফাতাহ নিজ অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে ১৯৬৫ সনে। মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসেরের অনুরোধে ওই ঘোষণা দেয় ফাতাহ। নাসের ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মিশর শাসন করেন। একমাত্র ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড মুক্ত করা সম্ভব হবে বলে নাসের বিশ্বাস করতেন। তাই নাসেরের নেতৃত্বাধীন মিশর ফাতাহকে অস্ত্র ও সামরিক উপকরণের যোগান দেয়। রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি ফাতাহ জনপ্রিয় গণপ্রতিরোধ আন্দোলনও গড়ে তোলে এবং ফাতাহর সামরিক শাখার নাম দেয়া হয়েছিল আস সায়িক্বা বা বজ্র। ফাতাহ'র বেশিরভাগ রাজনৈতিক ও সামরিক সদস্যরা থাকতেন মিশর, সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, আলজেরিয়া ও তিউনিশিয়ায়।
অন্যদিকে হামাস ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছে। হামাস হল ফিলিস্তিনি সুন্নি ইসলামী বা ইসলামী রাজনৈতিক দল। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরায়েলি দখলদারির অবসানের দাবিতে ইন্তিফাদা বা ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরুর পর ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। হামাস যার অর্থ উদ্দীপনা যার পুরো নাম হারাকাত আল মুকাওয়ামা আল ইসলামিয়া যার বাংলা অর্থ ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন।ইসরায়েলবিরোধী আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমাদ ইয়াসিনের নেতৃত্বে আবদেল আজিজ আল-রান্তিসি ও মাহমুদ জহর হামাস প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটির বর্তমান প্রধান খালেদ মিশাল। সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী তারা ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর তাদের চাওয়া হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একক ইসলামি রাষ্ট্র।হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শাইখ আহমেদ ইয়াসীন বলেন "ইসরাইলের জন্মই হয়েছে অবৈধভাবে, তাদের বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে হবে।" ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইসরাইল ও জাপান হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে। সৌদি আরব, মিসর, আরব আমিরাতসহ আরও কিছু আরব দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেই বিবেচনা করে। অন্য দিকে ইরান, সিরিয়া, কাতার, তুরস্ক, রাশিয়াসহ বিশ্বের আরও বিভিন্ন দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন নয় বরং একটি স্বাধীনতাকামী ও প্রতিরোধকামী সংগঠন হিসেবেই দেখে। হামাসের রাজনৈতিক শাখার পাশাপাশি আল কাসসাম ব্রিগেড নামে একটি সামরিক শাখা আছে। এই শাখাটিই মূলত ইসরাইলের সাথে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধরত।হামাসের দখলে রয়েছে গাজা এলাকা।
২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যুর পর হামাস ও ফাতাহ'র মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয় এবং সেটা চরম আকার ধারণ করে ২০০৬ এর নির্বাচনের পর। সংসদ নির্বাচনে ১৩২টি আসনের মধ্যে হামাস ৭০টি আসনে জয়ী হয়। আরব লিগ ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থার পর্যবেক্ষকরাসহ আন্তর্জাতিক অন্যান্য পর্যবেক্ষকরা হামাসের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করে ওই নির্বাচনকে সুষ্ঠ বলে ঘোষণা করে। ফলে ফিলিস্তিনে ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় হামাসের সরকার। অভ্যন্তরীণ জনসমর্থন ও অন্তবর্তীকালীন ফিলিস্তিনি সংবিধানের আলোকে এগিয়ে যায় হামাস। কিন্তু আব্বাসের স্বশাসন কর্তৃপক্ষ হামাস সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং এভাবে দুই পক্ষের মধ্যে বিভেদ জোরদার হয় এবং সংঘাত তুঙ্গে উঠে । ফাতাহর সঙ্গে লড়াইয়ের পর তাদের বিতাড়িত করেই হামাস ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস জেতার পরও ফাতাহ তা মেনে নেয়নি। সে কারণে গাজা উপত্যকায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্য হামাসকে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা তৈরি করতে হয়েছিল। বর্তমানে গাজার জনজীবনের সবকিছুই হামাস নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতাল, রাজস্ব সংগ্রহ, নিরাপত্তা আর মিসর ও ইসরায়েলের সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা—এসবই হামাস করে থাকে। । ২০১১ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোয় ফাতাহ নেতা আব্বাস আর হামাসের নেতা খালেদ মেশাল একটি সম্প্রীতি চুক্তি সই করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।এরপর একাধিকবার ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সবগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।সে সময় থেকেই হামাস ও ফাতাহর মধ্যে টানাপড়েন বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর তখন থেকে গাজায় অবরোধ আরোপ করে রেখেছে ইসরাইল ও মিসর। তারা গাজায় যেকোনও পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানিতে কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ইসরাইল মনে করে, এতে হামাস চাপে থাকবে আর গাজাবাসীও নিষেধাজ্ঞা শিথিলের আশায় তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনের হামাস ফাতাহ ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।আগেই জেনেছি নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আগেও সচেষ্ট হয়েছিল হামাস ও ফাতাহ। তবে কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি তারা। ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে ফিলিস্তিনের দু’টি গ্রুপ ফাতাহ ও হামাস এক বৈঠকে মিলিত হয়ে তারা ইসরাইলি দখলদারির বিরুদ্ধে ও এই অঞ্চলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করার জন্য বৈঠকে বসেছিলেন।এখন ইসরায়েলের সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলোর চুক্তির পর হামাস-ফাতাহসহ ফিলিস্তিনের ১৪টি রাজনৈতিক পক্ষ নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের অবসান ঘটাতে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে আগ্রহী।সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলোর চুক্তির পর আঙ্কারার প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং কড়া সমালোচনা করে।এ ছাড়া ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনে সৌদি আরব ও আমিরাত অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুপ থাকলেও এরদোয়ান ছিলেন বরাবরই সরব।ফলে এরদোয়ানের সঙ্গে আব্বাসের মধ্যে সম্পর্কে দূরত্ব থাকলেও ফিলিস্তিন সরকার আঙ্কারাকে পাশে চায় বলে অভিমত পর্যবেক্ষকদের একাংশের।তুরস্কের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা বৈরুতের মতো ভিন্ন কোনো শহরে বৈঠকে বসে সাধারণত। আলোচনার ভেন্যু হিসেবে ইস্তাম্বুলকে আমরা কোনো গুরুত্ব দিই না। তবে এই বৈঠক কোথায় হবে সেই সিদ্ধান্ত তাদের (হামাস-ফাতাহ)। যাই হোক প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত।’সূত্র জানায়, ফিলিস্তিনের দুই অংশে ক্ষমতায় থাকা হামাস ও ফাতাহ নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ নিরসনে কৌশলগত সমাধান এবং পরবর্তী নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণে একটি যৌথ কমিটি গঠনের জন্য আলোচনা করছে। এ ব্যাপারে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সমঝোতামূলক বৈঠকে বসতে চায় দুই পক্ষ। ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দল গুলোর একতা ছাড়া স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন