সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বলকান উপদ্বীপের ছোট্ট মুসলিম দেশ কসোভো



মো.আবু রায়হানঃবলকান উপদ্বীপের ছোট্ট একটি স্বাধীন মুসলিম দেশ কসোভো। ১৯৯০-এর দশকের বলকান যুদ্ধের মাধ্যমে সাবেক ইউগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর কসোভো ছিল সার্বিয়ারই একটি প্রদেশ। কসোভোর দক্ষিণ-পশ্চিমে আলবেনিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে মেসিডোনিয়া, পশ্চিমে ক্রোয়েশিয়া ও উত্তরে সার্বিয়া অবস্থিত। কসোভোর আয়তন ১০ হাজার ৯০৮ বর্গকিলোমিটার। দেশটির সবচেয়ে বড় শহর ও রাজধানীর নাম প্রিস্টিনা।কসোভোর জনসংখ্যা ১৯ লাখ সাত হাজার ৫৯২ জন। যার মধ্যে মুসলমান রয়েছে ৯৬ শতাংশ, রোমান ক্যাথলিক ২.২, অর্থডক্স ১.৫ ও অন্যান্য ধর্মের মানুষ রয়েছে ১ শতাংশেরও কম।কসোভো সর্বশেষ স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। ইউরোপের বুকে ইসলামের স্মারক বুকে নিয়ে টিকে আছে। কসোভোর ইতিহাস পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মতো। বাইজান্টাইন ও সার্বিয়ানরা দীর্ঘদিন দেশটি শাসন করেছে। উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের সময় সার্বিয়ানদের বিরুদ্ধে বিখ্যাত কসোভো যুদ্ধ হয়। কসোভো সমভুমির এই যুদ্ধ ইতিহাসে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হিসাবে পরিচিত। ১৪৫৫ সালে এই অঞ্চলটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। এখানকার আলবেনীয় জনগোষ্টীর ওপর ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা এতটাই করারোপ করেছিলো যে মানুষের জীবন যাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিলো। উসমানীয়দের বিজয়ের পর আলবেনীয় জনগোষ্টী এক সাথে ইসলাম গ্রহণ করে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ৫০০ বছর উসমানীয় শাসনের অধীনে ছিল। এ সময় এ অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটে। ফলে উসমানীয় ঐতিহ্যর প্রতিফলন পাওয়া যায় কসোভোতে।

বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে কসোভোর মানুষ তাদের ঈমান ও ইসলাম টিকিয়ে রেখেছে। ইউরোপের ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিগুলোর আক্রমণের শিকার হয়েছে অত্র অঞ্চলের মুসলিম জনগণ। সবশেষ নব্বইয়ের দশকে হানাদার সার্ব বাহিনীর হাতে লাখ লাখ মুসলিম প্রাণ হারায় এবং গৃহহারা হয় অসংখ্য মানুষ।কসোভোও বসনিয়া-হার্জেগোভিনার পরিণতি ভোগ করেছে। মুসলিম হত্যার ক্ষত কসোভোতে এখনো শুকায়নি। বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সরকারের হাতে সে দেশের দুই লাখ মুসলমান জঘন্য হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। আর কসোভোতে নারকীয় হত্যার শিকার হয় প্রায় ১০ হাজার নিরীহ মুসলমান। ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপে এই হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটে। কসোভোর দুই জনগোষ্ঠী আলবেনিয়ান ও সার্বদের মধ্যে কখনোই বনিবনা ছিল না। এদের দীর্ঘ দিনের রেষারেষির এক পর্যায়ে ২০০৮ সালে একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে কসোভো । এ পর্যন্ত পৃথিবীর ১১৫টি দেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে । সার্বিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ায় রাশিয়া। রাশিয়ার মদদ পেয়ে সার্বিয়া রাজি হয় না কাসোভোর স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে। কসোভোয় বসবাসকারী সার্বরাও কসোভোর স্বাধীনতা চায় না ।গ্রিস, চীন ও স্পেনের মতো দেশগুলো এখনো স্বাধীন দেশ হিসেবে কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়নি।হেগের আন্তর্জাতিক আদালত ২০১০ সালে কসোভোর স্বাধীনতাকে বৈধ হিসেবে রায় দিয়ে জানায়, বেলগ্রেড সরকারের অনুমতি ছাড়াই স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশে কসোভোর বাধা নেই। বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও সদস্যপদ পেয়েছে দেশটি।কসোভো এখনো জাতিসংঘের সদস্য দেশ নয়। রাশিয়া এবং চীনের হস্তক্ষেপের কারণে তারা এই সদস্যপদ পাচ্ছে না। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর সদস্যপদ পেতে মুখিয়ে থাকলেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ৫টি সদস্যদেশ এখনো কসোভোকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় তা হয়ে উঠছে না।
২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রয়ারি কসোভোকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। কসোভোকে স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ১১৪তম। ওআইসির ৫৭টি দেশের মধ্যে তাদের স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ছিল ৩৭তম।কসোভোর স্বাধীনতার ১০ বছর পূর্তিতে সে দেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে বাংলাদেশ।কসোভাও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে যে তারাও দখলদার ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে এবং একই সঙ্গে তারা ইসরায়েলের স্বীকৃতির পর জেরুজালেম আল কুদসে তাদের নিজস্ব দূতাবাস স্থাপন করবে।
কসোভোর নান্দনিক পতাকাটিও বেশ অর্থবহ। নীল ভূমির ওপর একটি স্বর্ণালি মানচিত্রের খিলান, তার ওপর ছয়টি তারকা। যা সেখানকার প্রধান ছয়টি জাতি-গোষ্ঠীর ইঙ্গিত করে।এখানকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক শক্তির ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছে আমেরিকা। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটি এখন নিজেদের নতুন করে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সার্বদের হাতে ধ্বংস হওয়া ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এবং ধর্মীয় অবকাঠামোর পুনর্র্নিমাণের কাজ শুরু করেছে।কসোভোর ধর্মবিদ্বেষী কমিউনিস্ট শাসকরা বিগত ৭০ বছর ধরে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সব ধরনের ধর্মীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। সার্ব বাহিনীর সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়েছিল প্রায় দুই শতাধিক মসজিদ। এখন সেখানে গড়ে উঠছে নতুন নতুন মসজিদ-মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। আবার শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে দেওয়া হয়েছে মাদরাসায়ে আলাউদ্দিন নামে একটি প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নতুন করে খোলা হয়েছে একটি বিশেষায়িত ইসলামিক কলেজ। কসোভোর প্রতিটি জেলায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি করে ইসলামিক সেন্টার ও পাঁচটি ধর্মীয় স্কুল। যেখানে শিক্ষার্থীদের ইসলাম ও আরবি ভাষা-সাহিত্য শেখানো হয়। কসোভোর সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাগত অবস্থা চমকপ্রদ। এখানকার প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয় কসোভোর সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশটির ইসলামী ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তুরস্ক প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে। কসোভোয় ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্য ইসলামী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি এখন সময়ের প্রয়োজন। ১৯৯৯ সালের যুদ্ধের পর খ্রিস্টানরা এখানে বহু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। তারা একটা ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। এর বিপরীতে ইসলামী ঐতিহ্য লালন করার জন্য মুসলমানদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...