লুজেন চুক্তি ও এরদোয়ানের নিও অটোমান নীতি



মো.আবু রায়হানঃতুর্কি সাম্রাজ্য বা অটোমান সম্রাজ্য ছিল একটি ইসলামি সাম্রাজ্য। সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের নাম থেকে উসমানীয় বা অটোমান নামটি এসেছে। একইভাবে রাজবংশকে উসমানীয় রাজবংশ বা অটোমান রাজবংশ বলা হয়। তুর্কি ভাষায় সাম্রাজ্যকে বলা হত দেভলেতি আলিয়া উসমানিয়া বা উসমানলি দেভলেতি বলা হত। আধুনিক তুর্কি ভাষায় উসমানলি ইম্পারাতুরলুগু বা উসমানলি দেভলেতি বলা হয়। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় বিস্তৃত উসমানীয় সাম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজীর পিতা আরতুগ্রুল গাজী। ১২৯৯ সালে অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রথম উসমান উত্তরপশ্চিম আনাতোলিয়ার দ্বায়িত্ব পান সেলযুক সাম্রাজ্য কর্তৃক, প্রথম দিকে রুমের সেলযুক সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থাকলেও রুমের সেলজুক সাম্রাজ্যের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।এবং ধীরে ধীরে একটি বৃহৎ সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন।প্রথম মুরাদ কর্তৃক বলকান জয়ের মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্য বহুমহাদেশীয় সাম্রাজ্য হয়ে উঠে এবং খিলাফতের দাবিদার হয়। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের কনস্টান্টিনোপল জয় করার মাধ্যমে উসমানীয়রা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য উচ্ছেদ করে। ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরি জয়ের পর ইউরোপের বলকান অঞ্চল সমূহ নিয়ে বড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে বিশেষত সুলতান প্রথম সুলাইমানের সময় উসমানীয় সাম্রাজ্য দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ, উত্তরে রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস, উত্তর আফ্রিকা ও হর্ন অব আফ্রিকা জুড়ে ,মধ্যপ্রাচ্য ও আরব অঞ্চলসহবিস্তৃত একটি শক্তিশালী বহুজাতিক, বহুভাষিক সাম্রাজ্য ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের মত এত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে শাসন সেই সময়ে অন্য কোন সাম্রাজ্যের ছিল না,যে কারণে অটোমান সুলতান প্রথম সুলাইমানকে বলা হত পৃথিবীর বাদশাহ।১২৯৯ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত ওসমানী শাসন ব্যবস্থায় মোট ৩৭ জন খলিফা ৬২৬ বছর খিলাফত পরিচালনা করেছেন ।১৭শ শতাব্দীর শুরুতে সাম্রাজ্যে ৩৬টি প্রদেশ ও বেশ কয়েকটি অনুগত রাজ্য ছিল। এসবের কিছু পরে সাম্রাজ্যের সাথে একীভূত করে নেয়া হয় এবং বাকিগুলোকে কিছুমাত্রায় স্বায়ত্ত্বশাসন দেয়া হয়।উসমানীয় সাম্রাজ্য সুদীর্ঘ ৬২৬ বছর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে।অটোমান শাসনামল প্রথম ৩০০ বছর স্বর্ণজ্জ্বল ছিল, কিন্তু শেষের ৩০০ বছরে খেলাফাতের সুর্য অস্তমিত হয়ে যায়। তবে দীর্ঘদিনব্যাপী ইউরোপীয়দের তুলনায় সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। ধারাবাহিক অবনতির ফলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়।বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে ওসমানী সুলতান জার্মানির সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি করেন। এতে করে যুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ সময় ধরে জার্মানির পক্ষে ছিল তারা।কেন্দ্রীয় শক্তিধর দেশ- জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং ইটালির হয়ে যুুুদ্ধ করে।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে পরাজয়ের পর পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষত ইউরোপের বহুকালের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ওসমানী সাম্রাজ্যের উৎখাতের সুবর্ণ সুযোগ আসে তাদের হাতে। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের অধীনে তুর্কিরা স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর সালতানাত বিলুপ্ত করা হয় এবং শেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ১৭ নভেম্বর দেশ ছেড়ে চলে যান। সালতানাত বিলুপ্ত হলেও এসময় খিলাফত বিলুপ্ত করা হয়নি। ষষ্ঠ মুহাম্মদের স্থলে দ্বিতীয় আবদুল মজিদ খলিফার পদে বসেন।১৯২৩ সালে ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে সম্পাদিত হওয়া চুক্তিতে মিত্রশক্তি তুরস্কের ওপর ইচ্ছা মত এমন অনেক অন্যায় শর্ত চাপিয়ে দেয় যা সুনিশ্চিত করে যে তুরস্ক তাদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে না।
বলকান ও মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যের সাবেক অংশগুলো প্রায় ৫০টি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।ন্যাশনাল এসেম্বলি ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ও আঙ্কারাকে এর রাজধানী ঘোষণা করে। ফলে ৬২৬ বছর পর উসমানীয় সাম্রাজ্য আনুষ্ঠানিক ভাবে সমাপ্ত হয়। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ খিলাফত বিলুপ্ত করা হলে সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদ দেশত্যাগ করেন।১৯২৩ সালে সম্পাদিত লুজেন চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৩ সালে। তুরস্ক মুক্তি পেতে যাচ্ছে অনেক বিধি নিষেধ এবং নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে। এই চুক্তিই এককভাবে তুরস্ককে ইউরোপের পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত করে। প্রথমে দেখে নেয়া যাক এই চুক্তির শর্তসমূহ।
ওসমানী সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি -ওসমানী সালতানাতের সব উত্তরাধিকাদেরকে নির্বাসিত করা হয়, কাউকে গুপ্ত হত্যা করা হয়, অনেককে নিখোঁজ করা হয়। তাদের সম্পদ বাজয়াপ্ত করা হয়। এই ভাবে খিলাফতের শেষ চিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলা হয় তুরস্ক থেকে।
ওসমানী সাম্রাজ্যের বিভাজন এবং নতুন অনেক রাষ্ট্রের আবির্ভাব -১৫২১ খ্রিস্টাব্দে ওসমানী সালতানাতের আয়তন সর্বোচ্চ হয়, এ সময় তার আয়তন ছিল ৩৪ লক্ষ বর্গ কিমির বেশি। বিভিন্ন সময় কম বেশি হওয়া সাম্রাজ্যের গড় আয়তন ছিল ১৮ লক্ষ বর্গোকিমি। বর্তমান তুরস্কের আয়তন মাত্র ৭ লক্ষ ৮৩ হাজার বর্গ কিমি। বিশ্বখ্যাত অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর এর থেকে অন্তত ৫০টি নতুন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।
ইসলাম বিরোধী সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা -
কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপ আমেরিকার তাবেদার সেক্যুলার রাষ্ট্র। নিষিদ্ধ করা হয় আরবি চর্চা, বন্ধ করা হয় হাজারো মাদ্রাসা, মসজিদে মসজিদে আজান নিষিদ্ধ করা হয়, হত্যা করা হয় বহু ইমাম, মুয়াজ্জিন, ইসলামী স্কলার এবং আলেমকে। ওসমানী সালতানাতে মূলত দুটি ভাষা প্রচলিত ছিল একটি আরবী অপরটির ফারসি। সাম্রাজ্যের বর্ণমালাকে আবজাদ বলা হতো, যা ওসমানী সাম্রাজ্যের ভাষা বলে পরিচিত ছিল। তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষার পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রচলন করা হয় ল্যাটিন ভাষার। এই ভাবে রাতারাতি একটি জাতিকে ফেলে দেয়া হয় অক্ষরজ্ঞানহীন, পরিচয়হীন একটি অন্ধকার কুপে।
শেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদ
তুরস্কের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা -চুক্তির পরবর্তী একশো বছর তুরস্ক নিজেদের ভূমিতে বা বাইরে কোনো দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণ করতে পারবে না। বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশের অর্থনীতি শুধুমাত্র তেলের ওপর নির্ভরশীল সেখানে তুরস্ককে তেল উত্তোলন করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত রাখা হয় ফলে তুরস্ক নিজেদের প্রয়োজনে সব রকম জ্বালানি আমদানি করে বাইরের দেশ থেকে যা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে প্রধান অন্তরক।
বসফোরাস প্রণালীর আন্তর্জাতিকরণ -তুরস্কের অর্থনীতির ওপর আরো একটি বৃহৎ ধাক্কা দেয়া হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ বসফরাসের ওপর তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ শেষ করে দেয়ার মাধ্যমে। কৃষ্ণ সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝে সংযোগস্থাপনকারি এই প্রণালীটি এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যেকার বাণিজ্যের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯২০ সালে সম্পন্ন হয় সেইভ্রিস চুক্তি। এই চুক্তির অধীনে বসফরাসকে সকল ধরনের সামরিক নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত করা হয় এবং একে লীগ অফ নেশন্‌স এর নিয়ন্ত্রণে এনে জলপথে আন্তর্জাতিক চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।১৯২৩ সালের লুজেন চুক্তিতে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। এতে বলা হয়, বসফরাস প্রণালী ভৌগোলিকভাবে তুরস্কের অধীনে থাকলেও এ পথে যেকোন দেশের জলযান নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবে।  প্রতিদিন তুরস্কের বুকের ওপর থেকে হাজারো জাহাজ পার হলেও তুরস্ক তাদের থেকে এক টাকাও সংগ্রহ করতে পারে না।
মক্কা ও মদিনার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া -৪০০ বছর মক্কা এবং মদিনাকে নিয়ন্ত্রণ করা তুর্কি সুলতানরা নিজেদেরকে দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম বলে অভিহিত করতে গর্ববোধ করতো। ওসমানী সাম্রাজ্য থেকে পৃথক হওয়ার পর ১৯৩২ সালে আমেরিকার মদদপুষ্ট সাউদ গোষ্ঠী সৌদি আরবের মসনদে বসার পর মক্কা ও মদিনার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তুরস্কের বাসিন্দারা আজও হজ এবং ওমরাহ করার সময় মক্কা মদিনায় কেঁদে কেঁদে দোআ করে যে, “ইয়া আল্লাহ, আমাদের ক্ষমা করো, আমাদের ওপর তোমার অসন্তুষ্টি শেষ করো, আমাদেরকে আবার মক্কা মদিনার খাদেমের মর্যাদা ফিরিয়ে দাও।”তুর্কিরা হজের সময় নিজেদের সঙ্গে এক ধরনের মানচিত্র নিয়ে আসে যাতে মক্কা মদিনার পূর্বের সব পবিত্র স্থাপনার বর্ণনা আছে যার মধ্যে অনেক স্থাপনা সৌদি সরকার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। তারা নাম নিয়ে নিয়ে সেই সব জায়গায় সাহাবীদের কবর জিয়ারত করে।
২য় মুহাম্মদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে রিপাবলিক গঠিত হওয়ার পর পশ্চিমাদেরই অনুসরণ করেছে তুরস্ক।২০০০ সালে এরদোয়ানের নেতৃত্বে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিরও বদল ঘটতে থাকে। তুরস্ক এখন আর পুরোপুরি পশ্চিমা বা ন্যাটোনির্ভর নীতি অবলম্বন করছে না। মার্কিন প্রভাবের বাইরে গিয়ে নিজের অবস্থান সংহত করার চেষ্টা করছে।আরব বসন্তের ধাক্কায় আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে মিসর হারিয়ে যায়। ধীরে ধীরে ইরানের উত্থান ঘটতে থাকে। পাশাপাশি তুরস্কও বিভিন্ন সংকটে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার সুযোগ পায়। বিভিন্ন দিক থেকে উপসাগরীয় দেশগুলোকে তুরস্ক ঘিরে ফেলছে। এর পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বকে সৌদির প্রভাববলয় থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় ৫০টির অধিক মুসলিম দেশ নিয়ে তুরস্ক ও মালয়েশিয়া সম্মেলনও করেছে।তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হয়েও রাশিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি করছে। কিছুদিন আগে ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করেছে। সম্প্রতি গ্যাস পাইপলাইনের চুক্তি করেছে। গ্যাস পাইপলাইনের চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা কমে তুরস্কের ওপর ইউরোপের নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে ইউক্রেন দিয়ে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করে। তুরস্ক রাশিয়ার জন্য বিকল্প পথ বের করে দিয়েছে অন্যদিকে, ইউরোপের সঙ্গে তুরস্কের দর-কষাকষির সুযোগ বেড়ে যাবে নতুন এই চুক্তির কারণে।তুরস্ককে নিজস্ব সীমানার বাইরেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। মুক্তাঞ্চলের নামে সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখলের পাঁয়তারা করছে।সিরিয়া ছাড়াও লিবিয়ায় তুরস্কের সৈন্য রয়েছে। লিবিয়ায় সৈন্য পাঠিয়ে আফ্রিকায় প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইছে তুরস্ক। সাইপ্রাসেও খনিজ সম্পদ আহরণের নামে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাইছে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রিসের প্রভাব হ্রাস করতে লিবিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে তুরস্ক।
এসব সামরিক তৎপরতা ও চুক্তির বাইরেও তুরস্ক আফ্রিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগী হয়েছে। ২০০৮ সালে তুর্কি-আফ্রিকা সহযোগিতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আফ্রিকার ৫০টি দেশ অংশ নেয়। ২০১৩ সালে গ্যাবনে গিয়ে এরদোয়ান বলেছিলেন, ‘আফ্রিকা আফ্রিকানদেরই থাকবে; আমরা এখানে সোনার জন্য আসিনি।এরদোয়ান আলজেরিয়া, সেনেগাল ও গাম্বিয়া সফর করেন। লিবিয়াতে সৈন্য পাঠালেও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই আফ্রিকার দেশগুলোকে আস্থায় আনতে চাইছে তুরস্ক। গত বছর তুরস্ক ও আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৩ সালে আফ্রিকার দেশগুলোয় তুরস্কের বিনিয়োগ ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সাল নাগাদ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তুরস্ক ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। তুরস্কের বিনিয়োগ মহাদেশজুড়ে ৭৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। গত ১০ বছরে এরদোয়ান ৩০টি আফ্রিকান দেশে ২৮টি সফর করেছেন। এমনকি ২০১১ সালে দুর্ভিক্ষ, খরা ও যুদ্ধাক্রান্ত সোমালিয়া সফর করে আলোচনায় আসেন তিনি।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতাকা
আফ্রিকাকে ঘিরে তুরস্কের এসব উদ্যোগকে অনেকেই মহানুভব বললেও উপসাগরীয় দেশগুলো এর বিরোধিতা করছে। সৌদি আরবসহ অন্য উপসাগরীয় দেশগুলো মনে করে, ‘নব্য অটোমান’ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে হর্ন অব আফ্রিকা দখল করতে চাইছে তুরস্ক। সোমালিয়ায় মানবিক সহায়তার নামে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে তুরস্ক; যদিও তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল সোমালিয়ার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এই ঘাঁটি স্থাপন করা হয়।একদিকে আফ্রিকাকে হাত করে জাতিসংঘের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চাইছেন, অন্যদিকে সিরিয়ার কিছু অংশ পরোক্ষে দখল করে সৌদিকে চাপে রাখছেন। ওআইসির বিকল্প বৈঠক করে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে দেখাতে চাইছেন। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ইউরোপের সঙ্গে দর-কষাকষির পথ তৈরি করছেন এরদোয়ান।
তুরস্ক সরাসরি কোনো দেশকে দখল করছে না। তবে কৌশলে বিভিন্ন দেশকে কবজা করে ফেলছে। কখনো সামরিক পদক্ষেপে। কিছু কিছু দেশে অর্থনৈতিক সহযোগিতার নামে। সফট পাওয়ার ও হার্ড পাওয়ারের সমন্বয়ে নিও অটোমান নীতির সফল প্রয়োগ করছেন এরদোয়ান। ঘরের রাজনীতিতেও দক্ষতার সঙ্গে একটি অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে দিয়েছেন। ভারসাম্য ধরে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছেন। সিরিয়া ও লিবিয়া সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছে তুরস্ক।সর্বশেষ দীর্ঘ ৮৫ বছর পর আয়া সুফিয়া জাদুঘরকে মসজিদে রুপান্তর করায় এরদোয়ান ফের আলোচনায়।তুরস্ক হয়তো আবারো ফেরাতে পারবে না ওসমানী সালতানাতের সেই সোনালী দিন গুলো তবে তারা যে আস্তে আস্তে সেই দিকেই যাবে তা এক প্রকার নিশ্চিত। তুরস্ক সেই উদ্দেশ্যেই তাদের জনগন সহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে সালতানাতে ওসমানিয়ার গৌরবময় দিনগুলো সম্পর্কে ড্রামা সিরিজ, চলচ্চিত্র ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে অবহিত করছে।তুরস্কের বর্তমান অর্থনীতি খুব একটা বৃহৎ আয়তনের নয়। তাদের জিডিপি হলো ৭৪৩ বিলিয়ন ডলার (২০১৯ সালের হিসেব) যা বিশ্বে ১৯তম।কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবল সম্ভাবনাময় দেশ তুরস্ক লুজেন চুক্তির পর যে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক অগ্রগতি করবে তা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। ইতোমধ্যে তারা গ্রিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভূমধ্যসাগরে তেলের অনুসন্ধান শুরু করেছে। নিজেদের দেশের প্রয়োজনের একটা বড়ো অংশ তারা নিজেদের উত্তোলিত তেল থেকে পূরণ করতে পারলে তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি অনেক কমবে এবং তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যা ২০১৯ সালের হিসেব অনুসারে ছিল ১ শতাংশেরও কম তা অনেক বৃদ্ধি পাবে। তারা নিশ্চিতভাবেই বসফরাসের ওপর নিজেদের অধিকার কায়েমের চেষ্টা করবে এবং এতে বাধা এলেও তারা সফল হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আমেরিকা যে তাতে বাধা দেবে তা ভেবেই তারা এখন থেকে চীন রাশিয়া ইরান পাকিস্তানের সঙ্গে মজবুত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে।তুরস্ক এরদোয়ানের আমলে আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত মুসলিম বিদ্বেষী সেক্যুলার ছবি থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বদান করার ক্ষেত্রে সবার থেকে এগিয়ে আছে। সব মিলিয়ে দেখতে গেলে তুরস্কের ভবিষ্যৎ যে খুব উজ্জ্বল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সব ঠিক ঠাক থাকলে তারা নব বিশ্ব শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে এক দশকের মধ্যে এবং এটি নিঃসন্দেহে মুসলিম বিশ্বের জন্য আবার সুখের দিনের বার্তা বহন করে আনবে।
(জাতীয় পত্র পত্রিকা থেকে সংকলন )

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ