ঢাবির যে উপাচার্যের নাম তালিকায় নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ৯৯ বছরে ২৯ জন উপাচার্য নিযুক্ত হলেও ২৮ জন উপাচার্যের নামের তালিকা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনের নাম নেই।মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা এবং রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদ দেওয়ার কারণে তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়েছে।
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ খ্রীস্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। নিজস্ব মেধার কারণেই সেই সময়কালের পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ের লেখাপড়া কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন। যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. ক্লাসের ছাত্র তখনই ঢাকায় গঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ গঠিত হয় এবং তিনি এর চেয়্যারম্যান-এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এম.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি সিলেটের এম,সি, কলেজে বদলী হন এবং এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন।যুক্তরাজ্যের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫২ সালে জোসেফ রোডিয়ার্ড কিপলিং এবং ভারতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি (১৮৬৫-১৯৩৬) বিষয়ে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।মাত্র দু’বছরের গবেষণা কাজ শেষ করে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি বিশ বছর ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক পদ থেকে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান পর্যন্ত সকল পদে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ১৯৬৯ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগেই ইউরোপে ছিলেন। তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভা যান।২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে পাকিস্তানি সেনারা একযোগে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে তিনি স্বাধীনের আগে আর দেশে ফেরেননি।সেখানে জেনেভার একটি পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন, “আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম”।বিলেতে থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কাজ করেছেন।বিশ্ব জনমত গঠনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরির ভূমিকা বাঙালি চিরকাল স্মরণ করবে ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপাচার্য বিহীন।পাকিস্তান সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে তাদের কনভয়ে করে ঢাকায় নিয়ে এসে ১৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে বসায়। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাকে সহায়তা করেন ড. হাসান জামান, ড. মেহের আলি। স্বাধীনতার পর তিনজনই গ্রেফতার হন।যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর যোগসাজশে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আসনে বসানো হয়। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনো স্বীকৃতি দেয়নি। কারণ উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন বিদেশে যান তারপরে ২৫ মার্চের সেই হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারী হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হন। অতএব এই সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ডকুমেন্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নামই রাখা আছে। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়োগ করেছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নাম এখন নেই।’ ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন বলেছিলেন, ‘সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের নাম উপাচার্যের তালিকায় রাখতেই হবে। সেটা না করলে ইতিহাস বিকৃতি হবে। তবে তার নামের সঙ্গে “পাকিস্তানি দালাল ও সহযোগী” কথাটা সংযুক্ত করা প্রয়োজন।’
একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ গ্রন্থে আহমদ শরীফ, কাজী নূর-উজ-জামান ও শাহরিয়ার কবির লিখেছেন, ‘দালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে মুখ্য ব্যক্তিটি ছিলেন ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জন বাঙ্গালী অধ্যাপক এবং দুই জন বাঙ্গালী অফিসারের একটি তালিকা তৈরী করে সামরিক হেডকোয়ার্টারে দাখিল করেন। এই তালিকায় অধ্যাপকদের ৪টি শ্রেণীতে বিভক্ত করে চার ধরনের শাস্তির জন্য সুপারিশ করেছিলেন (ক) হত্যা (খ) কারাদন্ড (গ) চাকুরী থেকে বহিস্কার (ঘ) ধরে নিয়ে প্রহার করার সুপারিশ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দন্ড প্রাপ্ত অধ্যাপকদের অনেকেই আলবদর এবং পাকিস্তান সেনা বাহিনীর হাতে নিহত অথবা নির্যাতিত হয়েছেন।’ নাজিব মাহমুদ ‘যখন ক্রীতদাস : স্মৃতি ৭১’গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নয়ই নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে চল্লিশ জন জওয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে ঢুকে যে নারকীয় দৃশ্য রচনা করে, তাও ভাইস চ্যান্সেলরকে হজম করতে হয়। পরদিন দুপুরে আই.জি. চীফ সেক্রেটারী, হোম সেক্রেটারীর সঙ্গে মেয়েদের হল ঘুরে ফিরে দেখলেন ভাইস চ্যান্সেলর, তারপর তিনি বললেন: সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীরা রোকেয়া হলে ঢুকেছিল। কিন্তু কারা এই দুষ্কৃতকারী সে কথা স্পষ্ট উচ্চারণ তিনি করতে পারলেন না।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের মতো সম্মানজনক পদে এখনো সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের নাম ও ছবি ঝুলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ও কার্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তিন মেয়াদে এক দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থেকেও দালাল উপাচার্যের ছবি সরানোরর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ওই উপাচার্যের ছবির ওপর ‘কালো কাপড়’ দিয়ে ঢেকে দেওয়া কিংবা তার নামের পাশে ‘পাকিস্তানি দালাল ও বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশাকারী’ লেখা হয়নি।
১৯৭৫ সালে ড. হোসেন তিন মাসের জন্য যুক্তরাজ্যের ক্যাম্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লেয়ার হল এর ফেলো নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মক্কার উম্মুল কুইয়ারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। আশির দশকের শেষ দিকে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৯৯৫ সালে ১২ই জানুয়ারি তিনি অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৭৫বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
গ্রন্থনায়- মো. আবু রায়হান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন