গির্জা কী বিক্রয় হয় ? ইতিহাস কী বলে ?
স্পেনের কর্ডোভা মসজিদ |
মো.আবু রায়হানঃ আয়া সোফিয়া জাদুঘর থেকে পুনুরায় মসজিদে রুপান্তর হওয়ায় খ্রিস্টান বিশ্বের চেয়ে মুসলিম নামধারীদের চিৎকার চেঁচামেচি বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে । বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুপ সমালোচনা করছে । এসবই তাদের অজ্ঞতা হীন মনমানসিকতার পরিচায়ক। অনেকেই আয়া সোফিয়া মসজিদকে বাবরি মসজিদের সঙ্গে মিশিয়ে তালগোল পাকানোর চেষ্টায় লিপ্ত । কিন্তু দুটোর ইতিহাস ও ঘটনা যে ভিন্ন তা তারা অবগত নন ।এবার মূল আলোচনায় যাবার আগে কিছু ঐতিহাসিক সত্য আলোকপাত করি ।
অমুসলিমদের প্রতি ইসলামের উদারতা-
অমুসলিমদের প্রতি ইসলামের উদারতায় শান্তির ধর্ম ইসলাম সর্বাধিক সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। প্রয়োজনে অন্য ধর্মের উপাসনালয় রক্ষায় যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে কোরআনের ভাষ্য এমন, ‘আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খ্রিস্টান সংসারবিরাগীদের উপাসনাস্থল, গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ, যার মধ্যে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়।’ (সুরা হজ- আয়াত ৪০)।আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল কোরআনে আরও বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন।’ (সুরা আল মুমতাহিনা আয়াত- ৮)। এখানে এমন কাফেরদের সাথে পার্থিব লেনদেন ও আচার-ব্যবহার বিষয়ক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। যারা দ্বীন ইসলামের কারণে মুসলিমদের সাথে বিদ্বেষ ও শত্রুতা রাখে না এবং এর ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না। তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্যান্য কাফেরদেরকে কোন প্রকার সাহায্য-সহযোগিতাও করে না; না পরামর্শ দিয়ে, আর না অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে। এই ধরনের কাফেরদের সাথে অনুগ্রহ প্রদর্শন এবং সুবিচারপূর্ণ আচরণ করা নিষেধ নয়।ঐতিহাসিকভাবে ইসলামে অমুসলিমদের প্রতি ন্যায় বিচার ও সমতা বিধানের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে।হযরত আসমা (রা.) এর মা আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর স্ত্রী কুতাইলা হুদায়বিয়া সন্ধির পর কাফের অবস্থায় মক্কা থেকে মদীনায় পৌছেন। তিনি কন্যা আসমার জন্যে কিছু উপঢৌকনও সাথে নিয়ে যান। কিন্তু আসমা (রা.) সেই উপঢৌকন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন- আমার জননী আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন, কিন্তু তিনি কাফের। আমি তার সাথে কিরূপ ব্যবহার করব? রাসূলুল্লাহ (সা.)- বললেন- মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার কর। (বুখারী: ২৬২০, ৩১৮৩, মুসলিম: ১০০৩, আবু দাউদ: ১৬৬৮, মুসনাদে আহমাদ: ৬/৩৪৭, ইবনে হিব্বান: ৪৫২)।মদিনার ইহুদিরা সব সময় ইসলামের বিরোধিতা করত, তথাপি রাসুল (সা.) তাদের ধর্ম পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি।একবার মদিনার মসজিদে বসে নবী (সা.) নাজরান থেকে আগত একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার বিরতিতে তারা স্বধর্ম অনুসারে প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে নবী করিম (সা.) তাদের মদিনার মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন। (ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৭১)।অন্যের উপাসনালয় ভেঙে ফেলার অনুমতি ইসলাম দেয়নি। মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দনীয় কাজ। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) হিরা নামক স্থানের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিরাপত্তাসংক্রান্ত যে চুক্তি করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘তাদের গির্জা তথা ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করা যাবে না এবং তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া যাবে না। এবং ঘণ্টা বাজানো থেকে তাদের নিষেধ করা যাবে না। ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের সময় ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ বের করাতে বাধা দেওয়া যাবে না।’ (ফতোয়ায়ে হক্কানিয়া)।অমুসলিমদের উপাসনালয় রক্ষায় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) একটি রাজকীয় ফরমান জারি করেছিলেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিস্টানদের জন্য তিনি একটি সংবিধান রচনা করেছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি একটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তিনামা, যা মুসলমানদের আমির, আল্লাহর বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত হলো। এই চুক্তিনামা ইলিয়্যাবাসী তথা জেরুজালেমে বসবাসরত খ্রিস্টানদের জীবন ও সম্পদ, গির্জা-ক্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ তথা খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাদের উপাসনালয়ে অন্য কেউ অবস্থান করতে পারবে না। তাদের গির্জা ধ্বংস করা যাবে না এবং কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করা যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বস্তু, তাদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ও তাদের সম্পদের কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন বা হামলা করা যাবে না। (তারিখুর রাসুল ওয়াল মুলুক, তারিখে তাবারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৯)।হযরত উমার (রা)-এর আদেশে সাহাবী আবু উবাইদা (রা) জেরুজালেম অধিকার করবার জন্য এগিয়ে যান মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে। সামনে সামনে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)। নভেম্বরে জেরুজালেমে এসে পৌঁছায় মুসলিম বাহিনী। ছয় মাস অবরোধ করে রাখার পর নগরকর্তা সোফ্রোনিয়াস আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন। তবে শর্ত একটাই, হযরত ওমর (রা)-কে নিজে আসতে হবে, তাঁর হাতেই সমর্পণ করবেন। সোফ্রোনিয়াস অবাক বিস্ময়ে দেখলেন কোনো জাঁকজমক ছাড়াই হযরত ওমর (রা) তাঁর দাস আর গাধা নিয়ে জেরুজালেম এসেছেন। তিনি ঘুরিয়ে দেখালেন পবিত্র শহরটি। যখন নামাজের সময় হলো, তখন সোফ্রোনিয়াস তাঁকে চার্চে আহ্বান করলেন, কিন্তু ওমর “না” বললেন। তিনি জানালেন, এখন যদি তিনি এই চার্চে নামাজ আদায় করেন, তাহলে পরে মুসলিমরা এই চার্চ ভেঙে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। এতে খ্রিস্টানরা তাদের পবিত্র স্থান হারাবে। উমার (রা) এখানে কোনো জবরদস্তি করানো থেকে বিরত করলেন এ কারণে যে, এটাই সেই জায়গা যেখানে খ্রিস্টানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে যীশু খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন আর এখানের গুহাতেই তাঁর দেহ রাখা হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই চার্চ এখনো আছে, নাম হলো চার্চ অফ দ্য হোলি সেপালকার । হযরত ওমর (রা) চার্চের বাইরে বেরিয়ে নামাজ পড়লেন। পরে সেখানে আরেকটি মসজিদ বানানো হয়, নাম দেয়া হয় ‘মসজিদে ওমর’। তবে উল্লেখ্য, কয়েক শতক পর (১০০৯ সালে) ফাতিমীয় খলিফা আল হাকিম ওমর (রা) এর কথা সম্পূর্ণ অমান্য করে এই চার্চ ধ্বংস করে দেন, পরবর্তীতে তাঁর পুত্র খলিফা আজ-জহির চার্চটি আবার নির্মাণ করার অনুমতি দেন। ১০৪৮ সালে সেটি বানানো শেষ হয়।
কর্ডোভার জামে মসজিদের ভেতরের অংশ |
ইসলামে যুদ্ধ নীতি-রাসূল (সা.) এর হাদীসের দিকে যখন আমরা লক্ষ্য করি, তখন দেখতে পাই কিরূপ সতর্কতার সাথে ইসলামে যুদ্ধ নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ কোন প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। এখানে রাসূল (সা.) এর হাদীসের আলোকে সংক্ষেপে ইসলামের যুদ্ধনীতি উপস্থাপন করা হল-১ নারী ও শিশুদের হত্যা করা যাবেনা,২. বয়স্ক ও অসুস্থ লোকদের হত্যা করা যাবে না,৩. কোন প্রকার সম্পদ, চাষের জমি বা শস্যের ক্ষতি করা যাবে না,৪. সংঘাত বৃদ্ধির জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যাবেনা,৫. ধর্মীয় পন্ডিত ও পুরোহিতদের এবং ধর্মস্থানসমূহকে যুদ্ধের আওতা থেকে দূরে রাখতে হবে,৬. যুদ্ধকালীন সময়েও ধৈর্যের অনুশীলন করতে হবে, ৭. ফলবান বৃক্ষ কাটা বা জ্বালিয়ে দেওয়া যাবেনা,৮. খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া কোন প্রাণী হত্যা করা যাবে না,৯. ভীত হওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে, ১০. যুদ্ধের বিশৃঙ্খলায় কোন প্রকার লুটপাট ও চুরি করা যাবে না,১১. মানব বসতিপূর্ণ স্থান ধ্বংস পরিহার করে চলতে হবে ,১২. বিশ্বাসঘাতকতা করা থেকে বিরত থাকতে হবে,১৩. উপকারী পতঙ্গের কোন ক্ষতি করা যাবে না এবং ১৪. বন্দীদের মুক্ত করে দিতে হবে, ক্ষুধার্ত ও অসুস্থদের সাহায্য করতে হবে।
মুসলমানদের কনস্টান্টিপোল বিজয়-কনস্টান্টিনোপল বিজয় কেবল ওসমানি সালতানাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণই ছিল না, বরং এর বিজেতা সেনাপতি ও সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষভাবে দোয়া করে গিয়েছেন মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)। রাসূলুল্লাহ সা: এই শহর সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের সামনে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন -“লাতাফতাহুন্নাল কুসতুনতিনিয়াতা, ফালা নে’মাল আমীরূ আমীরূহা ওয়ালানে’মা জাকাল জাইশু।” অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে তোমরা কুসতুনতিনিয়া জয় করবে। সুতরাং তার শাসক কতই না উত্তম হবে এবং তার জয় লাভকারী সৈন্যরাও কতই না উত্তম হবে! (মুসনাদে আহমদ)। (“Verily you shall conquer Constantinople. What a wonderful leader will her leader be, and what a wonderful army will that army be!”) দ্বিতীয় মুহাম্মাদের আমলে কনস্টান্টিনোপলের সিংহাসনে ছিলেন কনস্ট্যান্টাইন ড্রাগাসেস। ১৪৫৩ সালে ৭ম ওসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ খ্যাত শাসক সুলতান মোহাম্মাদ ফাতিহ এর দখলে চলে যায় কনস্টান্টিনোপল। এমনকি দ্বিতীয় মুহাম্মদের পূর্বে তারই জাতির নৃপতিরা ১৭ বা ১৮ বার চেষ্টা করেছেন, সফল হননি। দ্বিতীয় মুহাম্মদ পেরেছেন, তাই তিনি ফাতিহ বা নগরদোর উন্মোচনকারী।তিনি মুহাম্মাদ ফাতিহ অর্থাৎ বিজয়ী মুহাম্মাদ নামে পরিচিতি পেলেন।পূর্বে এটি পূর্ব রোমান (বাইজেন্টাইন) সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। শহর অধিকারের পূর্বে এটি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল থেকে ২৯ মে পর্যন্ত অবরোধের সম্মুখীন হয়। এরপর চূড়ান্তভাবে শহরটি ওসমানীয়দের অধিকারে আসে। ভীত রাজধানীবাসী তখন হাজিয়া সোফিয়াতে প্রার্থনারত ছিল বলে ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন (Edward Gibbon) তা উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় মুহাম্মদ ভোরে হাজিয়া সোফিয়ার দ্বারপ্রান্তে অশ্বপৃষ্ঠে প্রবেশ করেন এবং অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে মাটিতে চুম্বন করেন। তিনি হাজিয়া সোফিয়ার শীর্ষে চাঁদতারা পতাকা উড্ডীন করে তার বিজয় ঘোষণা করেন এবং কনস্টান্টিপোলকে তিনি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন।কনস্টান্টিনোপলে বিজয়কে ১৫০০ বছরের মত টিকে থাকা রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হামলার পর অটোমান সেনারা শহরের সড়ক, প্রাক্তন ফোরা, এবং চার্চ অব দ্য হলি এপস্টলস এসব এলাকয় চলে আসে। সুলতান মুহাম্মদের ইচ্ছা ছিল যে তার নবনিযুক্ত পেট্রিয়ার্ককে একটি পদ দেয়া যাতে তিনি তার খ্রিস্টন প্রজাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। তাই তিনি চার্চ অব দ্য হলি এপস্টলসের মত স্থাপনা রক্ষার জন্য একটি নিরাপত্তা দল পাঠান। জেনিসারী সেনারা হাজিয়া সোফিয়ার সামনের চত্বর অগাস্টিয়ামে চলে আসে। এর ব্রোঞ্জের ফটকের ভেতর বিপুল বেসামরিক লোক স্বর্গীয় নিরাপত্তার আশায় অবস্থান নিয়েছিল। দেয়াল ভেঙ্গে ফেলার পর সৈনিকরা মূল্যবান বস্তুকে অধিকার করা শুরু করে। বিজয়ের তৃতীয় দিন সুলতান মুহাম্মদ সব ধরনের লুটপাট বন্ধের নির্দেশ দেন এবং সৈনিকদের শহরের বাইরে পাঠান। ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বাইজেন্টাইন ইতিহাসবিদ জর্জ স্ফ্রান্টজেজের (George Sphrantzes) বর্ণনা অনুযায়ী “আমাদের শহরের পতনের তৃতীয় দিন সুলতান তার বিজয় উদযাপন করেন। তিনি এই মর্মে আদেশ জারি করেন- লুকিয়ে থাকা সকল বয়সের নাগরিকদেরকে মুক্ত মানুষের মত বেরিয়ে আসতে হবে এবং তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তিনি এও ঘোষণা করেন যে অবরোধের আগে যারা শহর ত্যাগ করে চলে গেছে তাদের বাড়ি ও সম্পদ পুনর্বহাল করা হবে, যদি তারা বাড়ি ফিরে আসে তবে তাদের সাথে তাদের পদ ও ধর্ম অনুযায়ী ব্যবহার করা হবে, যেন কিছুই পরিবর্তন হয়নি। হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়। তবে গ্রীক অর্থোডক্স চার্চকে আগের মতই রেখে দেয়া হয় এবং গেনাডিয়াস স্কোলারিয়াসকে কনস্টান্টিনোপলের পেট্রিয়ার্ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়’’। অটোমানদের এই বিজয়ের ফলে অটোমান সেনাদের সামনে ইউরোপে অগ্রসর হওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকল না। খ্রিস্টানজগতে এই পতন ছিল বিরাট ধাক্কার মত। বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মদ তার রাজধানী এড্রিনোপল থেকে সরিয়ে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে আসেন। শহর অবরোধের আগে ও পরে শহরের বেশ কিছু গ্রীক ও অগ্রীক বুদ্ধিজীবী পালিয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ ইতালিতে চলে যায় এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁতে সাহায্য করে। বেশ কিছু ইতিহাসবিদ কনস্টান্টিনোপলের বিজয় ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনকে মধ্য যুগের সমাপ্তি হিসেবে দেখেন। বলা যায় কনস্টান্টিপোল বিজয় এডওয়ার্ড গিবন (Edward Gibbon) এর The decline and fall of the Roman Empire গ্রন্থের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং রোমানঞ্চকর অধ্যায়। কনস্টান্টিপোল বিজয় শুধু একটি শহরের বিজয় নয়-একটি সভ্যতার বিজয়। এই বিজয়ের বীর তখন আর কেবল গাজি বা দ্বিতীয় সুলতান মুহাম্মদ নন, তিনি ইতিহাসের মুহাম্মদ ফতিহ(বিজয়ী) একটি সম্রজ্যের অধীশ্বর, সম্রাট।
আয়া সোফিয়া-খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে খ্রিস্টান সম্রাট দ্বিতীয় কনস্টান্টিন প্রথম এই হাজিয়া সোফিয়া’ গির্জা নির্মাণ করেন।৩৬০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘হাজিয়া সোফিয়া’ গির্জা খ্রিস্টানদের উপাসনার জন্য খুলে দেয়া হয়। ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলে সৃষ্ট দাঙ্গায় এই গির্জার একাংশ ভস্মীভূত হয়। পরবর্তীতে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের আদেশে এটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়।এই সুবিশাল ক্যাথিড্রাল তৈরির সময় তখনকার প্রকৌশলীরা ভূমধ্যসাগরের ওপার থেকে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন।হাজিয়া সোফিয়া নির্মাণ শেষ হয় ৫৩৭ সালে। এখানে ছিল অর্থডক্স চার্চের প্রধানের অবস্থান। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজকীয় অনুষ্ঠান, রাজার অভিষেক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো এখানেই।প্রায় ৯০০ বছর ধরে হাজিয়া সোফিয়া ছিল পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স খ্রিষ্টান ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। অবশ্য মাঝখানে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে একটি সংক্ষিপ্ত কালপর্ব ছাড়া।চতুর্থ ক্রুডের সময় ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা অর্থডক্স খ্রিস্টানদের পুরোপুরি কচুকাটা করে। তারা পুরো কনস্ট্যান্টিনোপল শহরকে শ্মশানে পরিণত করে। অনেকে বলে থাকেন হালাকু খান বাগদাদ দখলের পর যে বীভৎসতা দেখিয়েছিল তার থেকে কোনো অংশে কম ছিল না ক্যাথলিকদের হাতে অর্থডক্স খ্রিস্টানহত্যার এই জঘন্য নারকীয়তা।চতুর্থ ক্রুসেডের সবথেকে ভয়ানক দিক হচ্ছে লাইব্রেরীতে আগুণ লাগিয়ে দেয়া। লাইব্রেরী পোড়ানোর যে দায় সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদের উপর দেয়া হয় ১২০৪ সালের ক্রুসেডেই সেই লাইব্রেরী আসলে পুড়িয়ে ফেলেছিল ক্যাথলিকরা।
কর্ডোভামসজিদের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি |
লাইব্রেরির প্রতি তাদের আক্রোশের কারণ লাইব্রেরিকেন্দ্রিক বিজ্ঞানচর্চা ও বিশপের বিরোধিতা। যাই হোক তারা এসময় চার্চ অফ হোলি এপসলস এবং হাজিয়া সোফিয়াকে অর্থডক্স চার্চ থেকে ক্যাথলিক চার্চে জোরপূর্বক রূপান্তর করে।হাজিয়া সোফিয়ার এই বদল থেমে থাকেনি। ১০৫৪ সালে হাজিয়া সোফিয়ার উপর অধিকার নিয়ে একটি প্যাপাল বুল জারি করেছিলেন পোপ লিও। এরপর ১২৬১ সালে রোমান পালাইলোগোস ডাইন্যাস্টির অষ্টম মাইকেল আবার যখন নতুভাবে কন্সটান্টিনোপল জয় করেন তখন আবার হাজিয়া সোফিয়াকে অর্থডক্স চার্চে পরিণত করা হয়। আর তা ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯২ বছর স্থায়ী হয়। প্রায় ১০০০ বছর ধরে এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জা।সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ কনস্ট্যান্টিনোপল/ ইস্তাম্বুল বিজয়ের পর খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতাদের কাছে এটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়ছিলেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে নয়, বরং নিজের ব্যক্তিগত খরচে তিনি গির্জাটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।উসমানীয় সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ হাজিয়া সোফিয়া কিনে নেয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাতে হ্যাঁ সূচক জবাব আসে তৎকালীন গির্জার তত্ত্বাবধায়কদের পক্ষ থেকে। অর্থলোভ কিংবা নিজের পকেট ভারী করার ইচ্ছে থেকে হোক কিংবা ধর্মীয়ভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ার কারণে হোক তৎকালীন খ্রিস্টান নেতারা হাজিয়া সোফিয়া বিক্রি করে দিয়েছিলেন। অনেকে সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদের কিনে নেয়ার ভাউচার বিল সরাসরি উত্থাপন করছেন। অনেকগুলো তুর্কি গণমাধ্যমের পাশাপাশি আল জাজিরা পর্যন্ত এটা দেখিয়েছে ।
এবার বিশ্বের গির্জা বেচাকেনা দেখে আসি-
একটি পত্রিকার শিরোনাম-Wall Street Journal: “Europe’s empty churches go on sale” এখানে বলা হচ্ছে-
Hundreds of churches, closed or threatened by plunging membership, pose a question for communities, and even governments, across Western Europe: What to do with once-holy, now-empty buildings that increasingly mark the countryside from Britain to Denmark?যুক্তরাজ্যের একটি ক্যাথলিক গির্জা মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। কব্রিজের সেন্ট পিটার্স ক্যাথলিক চার্চের স্থানে গড়ে উঠবে ‘মদীনা মসজিদ’।উপাসনাকারীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় গির্জাটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।গির্জার একজন মুখপাত্র বলেন, এই গির্জাটির রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর পূজারির সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে, এখানে একজন যাজক রাখা এবং ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।এভাবে ইউরোপজুড়েই খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারিদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি খ্রিষ্টান ধর্মের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইসলাম।ফ্রান্সের বিখ্যাত এমানুয়েল মুনিয়ার, জর্জেস বার্নানোস, ফ্রাসোয়া মরিয়াক, জ্যাক মরিটেইন, তেইলহার্ড ডি চার্ডিনসহ বহু গির্জার স্থানে মসজিদ, শো-রুম ও শপিং মল গড়ে উঠছে।দা অবজার্ভেটরি ফর রিলিজিয়াস হেরিটেজ জানায়, প্রথমবারের মত (খ্রিষ্টান) উপাসনালয়গুলো ভেঙে সেখানে পার্কিং সুবিধা, রেঁস্তোরা, বুটিক, বাগান ও ঘরবাড়ি গড়ে উঠছে।ফ্রান্সের সিনেট জানিয়েছে, দেশটির ২,৮০০ খ্রিষ্টান ধর্মীয় ভবন উচ্ছেদ করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ফ্রান্সে ৪০,০০০ যাজক ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা নেমেছে ৯০০০-এ। অনেক গির্জা ভেঙে গড়ে উঠেছে মসজিদ।সেইন্ট ক্রিস্টোফারের পুরাতন গির্জা কুই মালাকফ নান্টিসের স্থানে গড়ে উঠেছে ‘ফোরকান মসজিদ’। ইতিহাসবিদ ডিডিয়ার রিকনার লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম গির্জাগুলো গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। গত জুনে ভিরজনের সেইন্ট-ইলোই গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে।এ অবস্থার মধ্যেই দা ন্যাশনাল ফেডারেশন অব দা গ্রেট মস্ক অব প্যারিস খালি পড়ে থাকা গির্জাগুলোকে জুমার নামাযের জন্য ভাড়া দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।জার্মানির বড় বড় গির্জাগুলোকে ইবের মাধ্যমে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। ব্রান্ডেবার্গের সেইন্ট বার্নার্ড গির্জাটি বিক্রির দাম হাঁকা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ইউরো। গত ১০ বছরের এই এলাকায় এটি নিয়ে ২৫টি গির্জা বিক্রি হবে।Many Protestant churches in Germany have sold property in the last five years, according to a new study. Church administrations are trying to repurpose their empty buildings or are putting them up for sale. (DW)।‘ঈশ্বর মৃত’ স্লোগান দিয়ে জার্মানির গির্জাগুলো বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন স্পিরিটের হিসেবে, আগামী দুই বছরের মধ্যে জার্মানির ৪৫ হাজার গির্জার ১৫ হাজার বা প্রায় এক তৃতীয়াংশই উচ্ছেদ অথবা বিক্রি হয়ে যাবে।তবে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে গির্জাগুলো বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে না। জার্মানরা ক্রমেই ধর্ম ত্যাগ করছে। প্রতি ৭৫ সেকেন্ডে একজন জার্মান গির্জায় যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে।জার্মানি ইভানজেলিকাল চার্চই ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৩৪০টি গির্জা বন্ধ করে দিয়েছে। সম্প্রতি হামবুর্গে মুসলিম সম্প্রদায় একটি গির্জা কিনে নিয়েছে।জার্মানির প্রভাবশালী দার স্পাইজেল সাময়িকী জানায়, স্পানদাউয়ে সেন্ট রাফায়েল গির্জাকে মুদি দোকানে রূপান্তর করা হয়েছে, বিপ্লবী কার্ল মার্ক্সের শহরে একটি গির্জাকে জিমে পরিণত হয়েছে। কোলোনে একটি গির্জাকে বিলাসবহুল বাসভবেন পরিণত করা হয়েছে, যেখানে প্রাইভেট পুলওতৈরি করা হয়েছে।ফ্রাঙ্কফুর্টে গত শতাব্দীর ৫০ এর দশকে প্রোটেস্ট্যান্টের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজারে। এখানকার এক চতুর্থাংশ গির্জাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।নেদারল্যান্ডে প্রতি সপ্তাহে দুটি খ্রিষ্টান ধর্মীয় ভবন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যাজক জান স্টুইট বলেন, ‘নেদারল্যান্ডে রবিবার গির্জায় ক্যাথলিকদের উপস্থিতি ছিল ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৯০ জন। এখন এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ১০ জনে।নেদারল্যান্ডে প্রতি বছর ৬০টি উপাসনালয় উচ্ছেদ, বন্ধ অথবা বিক্রি হয়ে যায়। ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ২০৫টি গির্জা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ সময় ১৪৮টি গির্জাকে লাইব্রেরি, রেঁস্তোরা, জিম, অ্যাপার্টমেন্ট ও মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে।আমস্টারডামে একটি গির্জার জায়গায় গড়ে উঠেছে ফিটি কামি মসজিদ। শহরের সবচেয়ে পুরনো সেইন্ট জ্যাকোবাস গির্জাটিকে বিলাসবহুল বাসভবনে রূপান্তর করা হয়েছে।এই শহরের প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জাগুলোর অনুসারির সংখ্যা প্রতি বছর ৬০,০০০ করে কমছে। এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে এখানে আর কোনো প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান থাকবে না।সম্প্রতি ইউট্রেস্টট ও আমস্টারডামের দুটি গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে। এই হলো পাশ্চাত্যের বর্তমান অবস্থা। সূর্যাস্তের দেশগুলো সূর্য এভাবে অস্ত যাচ্ছে। সেখানে উদিত হচ্ছে প্রাচ্যের নতুন সূর্য।
স্পেনে শত শত মসজিদ গির্জায় রুপান্তর-
৭১১ সালে নির্যাতিত জনতার আহবানে স্পেন বিজয় করেন মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ।কিন্তু কালের পরিক্রমায় নানা ষড়যন্ত্র ও বিশেষভাবে শাসক গোষ্ঠীর আদর্শচ্যুতির ফলে ১৪৯২ সালে সম্মিলিত খ্রিস্টান শক্তির কাছে মুসলিম গ্রানাডার পতন ঘটে। এর মাধ্যমেই স্পেনে মুসলিম শাসনের সুদীর্ঘ সাতশত বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সমাপ্তি হয়।স্পেন থেকে মুসলিম শক্তির পতনের পর শুধু মসজিদগুলোই নয়, আরও বহু মসজিদ ও মুসলিম স্থাপত্য গির্জা ও অন্যান্য স্থাপনায় রূপান্তর করা হয়েছে। তবে সে সকল স্থাপনার অধিকাংশই রুপান্তরের পর টিকে থাকেনি, বরং সেগুলো মুসলমানদের প্রতি স্পেনীয় খ্রিস্টান রাজশক্তির আক্রোশের শিকার হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
১. কর্ডোভা জামে মসজিদ-
স্পেনে উমাইয়া শাসনের প্রতিষ্ঠাতা আমীর প্রথম আবদুর রহমান তার রাজধানী কর্ডোভায় এই মসজিদটি ৭৮৪ ঈসায়ীতে নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই মসজিদটির আয়তন ও শোভাবর্ধনসহ বিভিন্ন সংস্কারকাজ করা হয়। রাজা ফার্দিনান্দের নির্দেশে ঐতিহাসিক কর্ডোভা মসজিদকে খ্রিস্টানদের গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়।
কর্ডোভা মসজিদে আল্লামা ইকবালের নামায আদায়ের সেই বিরল দৃশ্য। |
একসময় শত শত বছর ধরে এ কর্ডোভা মসজিদই ছিল মুসলিম শাসনের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদের অবকাঠামো, কারুকাজ ও সৌন্দর্য সব কিছু অক্ষুণ্ন থাকলেও নেই কেবল মুসলিমদের নামাজ ও ইবাদতের কোনো কার্যক্রম। আজও সৌন্দর্য ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক কর্ডোভা মসজিদ। দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদ আজও বিশ্ব মুসলিমদের হৃদয়ে হাহাকার জাগিয়ে রাখছে। মুসলিম বিশ্বের কাছে সুপরিচিত বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ কুরতুবি রয়েছে এ মসজিদের এক গভীর সম্পর্ক। এ মসজিদেই আল্লামা কুরতুবি (র) মুসলিমদের তার রচিত তাফসিরে কুরতুবির পাঠ দিতেন।ঐতিহাসিক কুরতুবি মসজিদে বসেই ইলমে তাসাউফের দরস দিতেন শায়খুল আকবর সুফি ইমাম ইবনে আরাবি। ইলমে হাদিসের দারস দিতেন হজরত বাকি ইবনে মাখলাদ। হজরত ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া আন্দালুসিও ইলমে দ্বীনের পাঠদান করতেন এ মসজিদে। ইলমে ফিকহের মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করতেন হজরত ইবনে হাজাম জাহেরি। আল্লামা ইকবাল ১৯৩৩ সালে স্পেন সফরকালে কুরতুবা মসজিদ পরিদর্শনে গিয়ে দুই রাকাআত নামাজ আদায়ের অনুমতি চান। স্পেন প্রশাসনের বিশেষ অনুমতিতে আল্লামা ইকবাল সে মসজিদে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করেন।ঐতিহাসিক কর্ডোভা মসজিদে নামাজ পড়ে তিনি তার আবেগকে ৭টি কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। বালে জিবরিলে দুআ’ শিরোনামে দীর্ঘ কবিতাটি ওই মসজিদে বসেই লিখেছিলেন তিনি। যাতে কেউ সেখানে নামাজ, রুকু কিংবা সেজদা দিতে না পারে। সে জন্য অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত বিশেষ সিকিউরিটি ফোর্স সেখানে সার্বক্ষণিক পাহারায় নিয়োজিত।
২. আলমুনাসতের মসজিদ-
স্পেনের বর্তমান আন্দালুসিয়া অঞ্চলের হুভান প্রদেশের গ্রাম্য শহর আলমনাসতের লা রিয়েলে এই মসজিদটি অবস্থিত। স্পেনের মুসলিম সভ্যতার গ্রামীণ স্থাপত্যের উদাহরণ হিসেবে এখন এই একটি স্থাপনাই বর্তমানে টিকে আছে। দশম শতাব্দীতে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। খ্রিস্টীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই মসজিদটিকে ক্যাথলিক গীর্জায় পরিণত করে ফেলা হয়।
৩. জেরাজ ডি লা ফ্রন্টেরার আলকাজার দূর্গ মসজিদ-
স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের কাদিজ জেলার জেরাজ ডি লা ফ্রন্টেরা শহরের আলকাজার দূর্গে মসজিদটি অবস্থিত। একাদশ শতকে স্পেনের আলমোহাইদ শাসক কর্তৃক এই দূর্গ ও মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। ১২৬১ সালে দূর্গটি দখল করার পর খ্রিস্টানরা মসজিদটিকে গীর্জায় পরিণত করে এবং মসজিদের মিনারকে বেল টাওয়ারে রূপান্তরিত করে।
৪. গিরাল্ডা-
সেভিলে অবস্থিত এই স্থাপনাটি একটি অতীত মসজিদের স্মৃতিচিহ্ন। এটি মূলত পুরাতন একটি মসজিদের মিনার ছিল। মিনারটি লম্বায় ৩৪১.৫ ফুট (১০৪.১ মিটার) লম্বা। ১২৪৮ সালে মসজিদটিকে গীর্জায় পরিণত করা হয় এবং মিনারটিকে গীর্জার বেল টাওয়ারে রূপান্তরিত করা হয়। ১৩৬৫ সালে সম্পূর্ণ মসজিদটি ভেঙে নতুন করে এখানে একটি গীর্জা নির্মাণ করা হয়। গিরাল্ডা নামে পরিচিত এই মিনারটিকে বেল টাওয়ার হিসেবে রেখে দেওয়া হয়। বর্তমানেও এটি বেল টাওয়ার হিসেবে অক্ষত রয়েছে।
৫. ক্রিস্টো ডি লা লুজ মসজিদ-
৯৯৯ ঈসায়ীতে টলেডোতে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তখন এটি বাব আল-মারদুম মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টীয় শক্তি মুসলমানদের কাছ থেকে টলেডো কেড়ে নেওয়ার পর ১১৮৬ সালে মসজিদটিকে গীর্জায় পরিণত করা হয়।
এরপরও যদি মুসলিম নামধারীরা আয়া সোফিয়া মসজিদ নিয়ে সমালোচনা করেন তাহলে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন