আর্কিমিডিস নগ্ন গায়ে ছুটছিলেন-আসিফ তা করেননি
মো.আবু রায়হানঃকরোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি, নাকাল মানুষ।হাজার হাজার লাশের সারি। কিং কর্তব্য বিমূঢ় সারা বিশ্ব। ক্ষুদ্র আদেখা করোনা ভাইরাসের কাছে মানুষ আজ অসহায়।জানা নেই প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়। বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলি করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেও তা ওই পর্যন্ত। এরমধ্যে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কোম্পানি ও বিজ্ঞানীরা করোনা রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। তারা অনেকটা সফল ও অনেক দূর এগিয়েছেন। একথা জানাতে গিয়ে আসিফ মাহমুদ আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন। কেন কাঁদবেন না? এ ভাইরাস কতজনের জীবন স্বপ্ন, কর্ম, প্রেম কেড়ে নিয়েছে। বিরহ বাড়িয়েছে। অনাহার, অর্ধাহারে ভীষণ কষ্ট সইছেন। এ ভ্যাকসিন তাদের ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার স্বপ্নটুকু জিইয়ে রাখবে। আমাদের মন খুবই নরম, আমাদের আবেগ, উচ্ছ্বাস অনেক বেশি। আমরা অল্পতে অনেক খুশি।তাইতো আনন্দটাও বেশি উপভোগ করি। আসিফ মাহমুদের কান্নায় রয়েছে দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি পরম মমতা ও ভালোবাসার স্ফুরণ। বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানীর কিছু আবিষ্কারের পর উদযাপনে তাদের পরিবেশটাই ছিল আলাদা। আমাদের উদযাপন ছিল প্রেম, ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার মোড়কে প্যাচানো।
গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপ অব কোম্পানিজ লিমিটেড’র সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো করোনার টিকা উদ্ভাবনের দাবি করেছে। সংবাদ সম্মেলনে গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, টিকা উদ্ভাবনে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন প্রতিষ্ঠানের সিইও ড. কাকন নাগ এবং সিওও ড. নাজনীন সুলতানা। প্রতিষ্ঠানটি গত ৮ মার্চ এই টিকা তৈরির কাজ শুরু করে। প্রাথমিকভাবে করোনার ভ্যাকসিনে সফল হয়েছে। প্রাণী পর্যায়ে এটা সফল হয়েছে। তিনটি খরগোশের ওপর এই ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের আশা, মানবদেহেও সফলভাবে কাজ করবে এই ভ্যাকসিন।এখন তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যাবেন। এরপর তাদের দেওয়া গাইডলাইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।
গ্রিসের রাজা হিয়েরো এক স্বর্ণকারের কাছে একটা সোনার মুকুট বানাতে দিয়েছিলেন। স্বর্ণকার মুকুটটি বানিয়েছিলেন ভালোই। কিন্তু রাজার মনে সন্দেহ হলো যে স্বর্ণকার সোনা চুরি করেছেন এবং সেই চুরি ঢাকার জন্য মুকুটের মধ্যে খাদ মিশিয়েছেন। কোনো সহজ উপায়ে এই চুরি ধরা যায় কি না, জানার জন্য বিজ্ঞানী বন্ধু আর্কিমিডিসকে ডেকে পাঠালেন রাজা। আর্কিমিডিস সব শুনে বললেন, ‘একটু ভেবে বলব।’ ভাবতে ভাবতে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। একদিন গোসলের সময় কাপড় ছেড়ে সবে তিনি বাথটাবে পা দিয়েছেন, এমন সময় খানিকটা পানি উপচে পড়ল। হঠাৎ সেই প্রশ্নের এক চমৎকার মীমাংসা খেলা করে গেল আর্কিমিডিসের মাথায়! কোথায় গেল গোসল! আর্কিমিডিস নগ্ন শরীরে ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলে রাস্তায় ছুটে বের হয়ে গেলেন।
ডা. আসিফ মাহমুদ ভ্যাকসিনটি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে আবেগে কান্না ধরে রাখতে পারেননি। দ্রুত মাইক্রোফোন ত্যাগ করে চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেন এই কান্না? আসিফ সারাবিশ্বের ভ্যাকসিনের অগ্রগতি সম্পর্কে বলতে থাকেন। প্রতিটি কম্পানির ভ্যাকসিন আবিস্কারের সময়কাল উল্লেখ করে বলেন। 'সারাবিশ্ব যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারবো না? আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিনের আশায় বসে থাকবো তা কেন হবে? তারা কবে দেবে আর আমরা কবে নেবো সে আশায় বসে থাকলে চলবে না।আমাদের নিজস্ব একটি ভ্যাকসিন দরকার, যেন আমাদের অন্যের আশায় বসে না থেকে প্রত্যেকটি মানুষ ভ্যাকসিন গ্রহণের সুযোগ পায়।আমরা আর কোনো চাকরি হারাতে চাই না, আমরা আর কোনো সঞ্চয় হারাতে চাই না, আমরা আর কোনো সুখী সময় হারাতে চাই না, আমাদের মধ্য থেকে আমরা আর কোনো মানুষকে হারাতে চাই না। উই কান্ট এফোর্ড টু লুজ এনিমোর... বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আসিফ।'
আসলেই করোনায় আমরা কতকিছুই হারিয়েছি, এই হারানোর বেদনা এতো গভীরে দাগ ফেলে যাচ্ছে যা আসলে অনেকেই সামলে নিতে পারছেনা। মানুষ বাসা ভাড়া দিতে পারছে না, মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। এই করোনা কত প্রিয় স্বজনকে কেড়ে নিয়েছে। আসিফ হয়তো এসবের আর কিছুই হারাতে চান না। এজন্যই জান-প্রাণ দিয়ে করোনার ভ্যাকসিনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কথা বলতে গিয়ে আসিফের আবেগের কান্না ছুঁয়ে গেছে পুরো দেশবাসীকে।
গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডা. আসিফ মাহমুদ।কে এই আসিফ ? ডা. আসিফ মাহমুদ, মেট্রিকে আইডিয়াল স্কুল (7th stand), নটরডেমিয়ান।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে ফার্স্ট ক্লাস থার্ড, মাস্টার্স ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, তারপর জাপান থেকে পড়াশুনা করে দেশে ফিরে আসেন।আসিফের সামনে অপার সম্ভাবনা ছিল উন্নত জীবনের। চলে যেতে পারতেন্ ইউরোপ-আমেরিকায়। কিন্তু তিনি যাননি। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে দেশেই থেকে গেছেন।
গ্রিক পণ্ডিত আর্কিমিডিস নিজের বাড়ির উঠোনে গণিতের সূত্র আঁকিবুঁকি করছেন।তিনি যখন গণিতে ডুবে থাকেন, চারপাশের জগতের কোনো খোঁজ রাখেন না। ঠিক সে সময় রোমানরা আক্রমণ করেছে তাঁর দেশে। যুদ্ধে তাঁর দেশের সম্রাট হেরেও গেছেন। কিন্তু আর্কিমিডিসের সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি তাঁর কাজ নিয়েই ব্যস্ত। ঠিক তখনই কোনো এক মাথামোটা সৈনিক এসে আর্কিমিডিসকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। হাতে তাঁর ধারালো খোলা তরবারি। আর্কিমিডিসের বয়েই গেল তাকে কেয়ার করতে। বরং তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহ্, বিরক্ত কোরো না, দেখছ না ব্যস্ত আছি!’মাথামোটা সৈনিক জ্যামিতি বা গণিতের কী বোঝে! আর্কিমিডিসকে সে চেনে না, জানে শুধু যুদ্ধ করতে। আর্কিমিডিসের কথায় তার আঁতে ঘা লাগল। ‘কী, পরাজিত দেশের নাগরিকের এত বড় স্পর্ধা!’ তলোয়ারের এক কোপ বসিয়ে দিল সে আর্কিমিডিসের ঘাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল আর্কিমিডিস। পরে আর্কিমিডিসের কাটা মুণ্ডু দেখে বিজয়ী রোমান সম্রাট দুঃখ পেয়েছিলেন। যুদ্ধের আগে সম্রাট তাঁর সৈন্যদের বলে দিয়েছিলেন যেন আর্কিমিডিসকে হত্যা করা না হয়। তিনি গুণের কদর করতেন। যদিও আর্কিমিডিসের কারণে বারবার হেরেছেন তিনি। তাঁর তৈরি আয়না পুড়িয়ে মেরেছে রোমান সৈন্যদের, তাঁর অদ্ভুত যন্ত্র ডুবিয়ে দিয়েছে বহু জাহাজ। তবু আর্কিমিডিসের প্রতি ক্ষিপ্ত হননি সম্রাট। বরং এই গুণী মানুষটিকে একবার স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি।
যেখানে গুণী মানুষের কদর নেই, সেখানে গুণী মানুষ জন্মায় না।গণস্বাস্থ্যের কিট আবিষ্কার করার পর অনুমোদন নিয়ে যে নাটক হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। পরম শত্রুকে আগলে রেখেও যদি মানব কল্যাণ হয় সেখানে আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা থাকা উচিত। মত পথ আলাদা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কোনো জ্ঞানী গুণীকে নাজেহাল নয়, তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ টা আদায় করা উচিত।আশা করি আসিফ মাহমুদ ও তার টিম যথেষ্ট সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাবেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন