কাশ্মীরের হযরতবাল মসজিদ ও পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা

মো.আবু রায়হানঃজম্মু-কাশ্মীর ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পাহাড়ি জনপদ ও প্রদেশ।আয়তন ২,২২,২৩৬ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা প্রায় ১,০১,৪৩,০০০ জন অধিকাংশ মুসলিম।কাশ্মীরের শতকরা ৭৭ ভাগ লোক শিক্ষিত।বাংলাদেশ থেকে ১,৭৪৬ কি.মি. দূরের কাশ্মীর উপত্যকা।কাশ্মীরের স্থাপত্যের মধ্যে হযরতবাল মসজিদ অন্যতম ।প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক হযরতবাল মসজিদ পরিদর্শনে আসেন।হযরতবাল মসজিদটি ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের শ্রীনগর শহরের মধ্যে অবস্থিত।শ্রীনগর শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে ডাল লেকের উত্তর পার্শ্বে লেকের তীরে হযরতবাল মসজিদ অবস্থিত।এটি কাশ্মীরি মুসলিমদের আগ্রহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।কাশ্মীরিদের ধারণা ও দাবী মতে, এখানে প্রিয়নবী (সা.) এর চুল মোবারক সংরক্ষিত রয়েছে। ১৬৩৫ সালে মদিনা থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাথার চুল এনে মসজিদে একটি বিশেষ গ্লাসে রাখা হয়েছে।ধর্মীয় বিশেষ বিশেষ দিনে মাথার চুল ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের দেখানো হয়।মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে আরবি শব্দ হযরত থেকে যার অর্থ শ্রদ্ধেয়,পবিত্র, সম্মানিত এবং কাশ্মীরি শব্দ বাল এর অর্থ হল স্থান।(The name of the shrine comes from the Arabic word Hazrat, meaning holy or majestic, and the Kashmiri word bal, (bal is a corrupted form of Sanskrit Vala which means an enclosure) meaning place..)কারো মতে এই মসজিদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাথার চুল কিংবা দাড়ি কাচের বোতলে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। সে জন্যই এই মসজিদের নাম হযরতবাল মসজিদ। আলি (রা) এর যুদ্ধের পোশাক ও ৫/৭ফুট বিস্তৃতির বৃহতাকৃতির কোরআন শরীফ এখানে রাখা আছে। এটি আসার-ই-শরিফ, দরগাহ শরিফ ও মদীনাতুস-সানি নামেও পরিচিত। মসজিদটি সাদা মার্বেল দিয়ে খোদাইকৃত।সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আরবীয় ডিজাইনে তৈরি করা মসজিদ।একপাশে বয়ে গেছে কলকল সুরের হ্রদ; অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেত-শুভ্র আরকের হযরতবাল মসজিদ’—দৃশ্যটি ভীষণ মনোমুগ্ধকর ও সুখানন্দের।১৯৯৩ সালে হযরতবাল মসজিদে কিছু জঙ্গি আশ্রয় নেয়। তখন ভারতের নিরাপত্তারক্ষা বাহিনী তাদের পাকড়াও করতে মসজিদে হামলা চালায়। এতে মসজিদ বেশ ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়। মসজিদটি কঠোর নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা থাকে।মসজিদের আশপাশে অসংখ্য জালালি কবুতরের আবাস। মসজিদটি দেখতে খুবই সুন্দর। মসজিদের চারপাশ শীতকালে বরফাবৃত থাকে।
১৯৬৩ সালের ২৭ ডিসেম্বরে ভারতের শ্রীনগরে অবস্থিত হযরতবাল দরগাশরীফ মসজিদে হযরত মুহাম্মদ (সা.) -এর সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি হয়ে যায়। এজন্য ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে ব্যাপক বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। আব্দুল হাই নামে ইসলামিক বোর্ডের উপদেষ্টা কমিটির একজন সদস্য পূর্ব-পাকিস্তানের সকল হিন্দু এবং অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেয়। ইসলামাবাদে ফেরার প্রাক্বালে ঢাকা বিমানবন্দরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ঘোষণা করেন যে, হযরতবাল ঘটনার কারণে পাকিস্তানের মুসলিমরা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালে তার কোন দায় নেই। পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগ ১৯৬৪ সালের ৩ জানুয়ারী কে কাশ্মীর দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারিতে হারিয়ে যাওয়া চুল খুঁজে পাওয়া গেলেও পরেরদিনই পাকিস্তান রেডিও থেকে ওই ঘটনাকে মিথ্যা বলে প্রচার করা হয়।হযরতবাল মসজিদে প্রিয়নবী (সা.) এর সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি করা হয়েছে-এই সংবাদ ছড়ানোর মাধ্যমে পূর্ব-বাংলায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সূচনা করা হয়।১৯৬৪ সালে খুলনা, ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট ,নারায়ণগঞ্জের আদমজীসহ বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম ও হিন্দুদের মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে যখন বিভিন্ন স্থানে বাঙালি ও বিহারীদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা শুরু হয়। দাঙ্গায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছিল এবং অবাধে চলছিল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। দাঙ্গায় গৃহহীন হয়ে পড়ে শত শত মানুষ। সরকারবিরোধী মনোভাব অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য এসময় আইয়ুব সরকার এই দাঙ্গাকে আরও উৎসাহিত করে। দাঙ্গার ফলশ্রুতিতে বাঙ্গালীহিন্দু শরণার্থীদের ঢেউ আছড়ে পড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপর। এই আশ্রয়প্রার্থী পীড়িত-নির্যাতিত হিন্দু শরণার্থীরা ভারতের জাতীয় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়। ভারত সরকার পূর্ববাংলার এই নিপীড়িত হিন্দুদেরকে মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ