ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরের বিস্মৃত ইতিহাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এবং সেখানে যাদের আসা যাওয়া আছে তাদের কাছে মল চত্বর পরিচিত একটি জায়গা। চারিদিকে সারি সারি গাছ ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ সত্যিই অসাধারণ। সবার ভালো লাগার একটি জায়গা। ঢাবির কলা ভবন ও রেজিস্টার বিল্ডিং তথা প্রশাসনিক ভবনের মাঝের অংশটুকু মল চত্বর হিসেবে পরিচিত।মল চত্বরের নামকরণ নিয়ে আছে উদ্ভট যতসব গল্প। কেউ কেউ মনে করে ময়লা-আবর্জনা রাখার কারণে এই জায়গার নাম মল চত্বর, আবার কেউ কেউ মনে করে প্রচুর পশু পক্ষীর মলত্যাগের কারণেই এই চত্বরের নাম মল চত্বর হয়েছে । এমন আরো অনেক উদ্ভট গল্প প্রচলিত রয়েছে, তবে নামকরণের মূল ইতিহাস একেবারেই ভিন্ন যা অনেকেরই অজানা।
আন্দ্রো মালরো |
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ইউরোপে বাংলাদেশের বড় শুভাকাঙ্ক্ষী ফরাসি দার্শনিক,ঔপন্যাসিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ,শিল্পকলা তাত্ত্বিক সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আন্দ্রো মালরোর (১৯০১–১৯৭৬) নামে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যে জাতি “না” বলতে পারে, তাদের পক্ষ নেওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই।’ তাই তো ৭০ বছর বয়সেও অসমসাহসিকতায় তিনি যোগ দিতে চাইলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে।বাংলাদেশে এসে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আকুল ইচ্ছা প্রকাশ করেন।১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আন্দ্রে মারলো গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন।ফ্রান্স সরকারের উদ্দেশে তার করা আকুতি-‘আমাকে একটি যুদ্ধবিমান দাও, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের শেষ লড়াইটা করতে চাই।”১৮ সেপ্টেম্বর ৭১ সালে এক বিবৃতিতে মালরো বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর আগেও মালরো স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের হয়ে সম্মুখসমরে লড়াই করেছিলেন বিপ্লবীদের পক্ষে। এবার তিনি একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড তৈরি করার আহ্বান জানান।তিনি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে শরিক হতে ১৫০ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও গঠন করেন। তবে ৭১-এ বিভিন্ন প্রতিবন্ধতার কারণে তার বাংলাদেশে আসা হয়নি।
মলরো বাগান |
তবে মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে অঁদ্রে মালরো এ দেশে আসেন। তাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অঁদ্রে মলরোর সেই ইচ্ছা ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সামনে একটি বাগানের নামকরণ করা হয় মলরো বাগান। সেখান থেকে বাগানের পাশেই অবস্থিত চত্বরটির নাম হয় মলরো চত্বর, যা লোকমুখে বিবর্তিত হয়ে মল চত্বরে রুপ নেয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এসেছিলেন। যেখানে তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছাত্রদের উদ্দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন,'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ,আজ আমি প্রথমবারের মতো কথা বলছি পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দের সামনে,যাদের শহীদের সংখ্যা অনেক বেশি জীবিতের চেয়ে।' তার ওই উদ্ধৃতি মালরো বাগানের উদ্বোধনী ফলকে লেখা আছে তার ছবির পাশে ফরাসী ও বাংলা ভাষায়।
তবে নাম নিয়ে যত দ্বন্দ্বই থাকুক না কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সকল ছাত্রছাত্রীদের সবচেয়ে ভালোবাসার চত্বর যে এই মল চত্বর তা নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই কারও মাঝেই। সন্ধ্যার পর মল চত্বরে গেলে দেখা যায়, অনেক গানের আসর জমেছে। হলের ছাত্রছাত্রীরা গিটার বাজিয়ে কিংবা খালি গলায় গান গেয়ে সারারাত মুখরিত করে রাখে চত্বরের পরিবেশ। তাই সব চত্বরকে ছাপিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছে বর্তমানে মল চত্বরই একটু বেশি আকর্ষণীয়।বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মল চত্বরে বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে।
গ্রন্থনায় - মো. আবু রায়হান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন