ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকাল -একাল

দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৯৯তম বছর শেষ করে আজ ১লা জুলাই শতবর্ষে পদার্পণ করল।১৯২১ সালের ১লা জুলাই প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা ও গবেষণা, মুক্তচিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ এবং সৃজনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১লা জুলাই ২০২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষে বর্ণাঢ্য আয়োজনের প্রস্তুতি থাকলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লোকসমাবেশ এড়িয়ে স্বল্প পরিসরে প্রতিষ্ঠা বার্ষিক পালন করা হচ্ছে।প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর শুভ, পবিত্র এই দিনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি আমাদের পূর্বসূরীদের অমর স্মৃতির প্রতি, যাদের দৃঢ় প্রয়াসে ও অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রিয় খ্যাতিমান এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ১৯১২ সালের ২৭ মে বঙ্গীয় সরকার কর্তৃক গঠিত হয় নাথান কমিশন। তেরো সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আর. নাথানিয়েল, বার-অ্যাট-ল।বাম থেকে (বসা) বাংলার গণশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক জি.ডব্লিউ কুচলু, কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট রাসবিহারী ঘোষ, রবার্ট নাথান, নওয়াব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ.আর জেমস, নওয়াব সিরাজুল ইসলাম, বাম থেকে (দাঁড়ানো) ড. এস.সি. বিদ্যাভূষণ, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি.ডব্লিউ পীক, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ.এ.টি আর্চবোল্ড, ঢাকা মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওহীদ, ঢাকা জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিত মোহন চ্যাটার্জী, কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সতীশচন্দ্র আচার্য, ঢাকার জমিদার ও উকিল আনন্দচন্দ্র রায়, আলীগড়ের মুহম্মদ আলী এবং ডি.এস ফ্রেজার এ কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯১৩ সালে নাথান কমিশনের ইতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। নাথান কমিটির হিসেব অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রায় ৫৩ লক্ষ টাকা এবং বাৎসরিক খরচ প্রায় ১২ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। রমনা অঞ্চলের ৪৫০ একর জমির উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এই এলাকার মধ্যে ছিল ঢাকা কলেজ, গভর্নমেন্ট হাউজ, সেক্রেটারিয়েট, গভর্নমেন্ট প্রেস ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভবন।
নাথান কমিশনের সদস্যরা
সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই রিপোর্টটি অনুমোদিত হয়। এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হয়। ১৯১৭ সালে স্যাডলার কমিশন (লীড্স্ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম.ই স্যাডলার ছিলেন কমিশনের সভাপতি। স্বনামধন্য জে.ডব্লিউ গ্রেগরী, স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ, প্রফেসর র‌্যামজে মুর, স্যার আশুতোষ মুখার্জী, ডব্লিউ.ডব্লিউ হর্নওয়েল এবং জিয়াউদ্দীন আহমদ ছিলেন কমিশনের অন্যান্য সদস্য। জি অ্যান্ডারসন কমিশনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।) ইতিবাচক রিপোর্ট দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ধাপ তৈরি হয়ে যায়। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিভিন্ন আবাসিক হলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিট হিসেবে ধরা হয়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কে আরো তেরোটি সুপারিশ করে, যা কিছুটা রদবদল করে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভায় ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯২০’ পাস হয়। ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এই বিলে সম্মতি প্রদান করেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সব সন্দেহের অবকাশ ঘটে। এই আইনকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইনটির বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনসমূহের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়।বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন ২৫৪ একর। কিন্তু প্রতিষ্ঠাকালে ১৯২১ সালে এর মোট জমির পরিমাণ ছিল ৬০০ একর। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর গত ৯৯ বছরে আয়তন কমেছে প্রায় আড়াই গুণ। কমে যাওয়া এ জমিতে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান।তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ডিগ্রি ক্লাসে অধ্যয়নরত ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। শুধু ছাত্র নয়, শিক্ষক এবং লাইব্রেরির বই ও অন্যান্য উপকরণ দিয়েও এই দুটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে। এই সহযোগিতা দানের কৃতজ্ঞতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি হলের নামকরণ করা হয় ঢাকা হল(বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) ও জগন্নাথ হল। ৩টি আবাসিক হল নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।
৩টি অনুষদ- কলা, বিজ্ঞান ও আইন। ১২টি বিভাগ ছিল।কলা অনুষদের অধীনে ছিল ৮টি বিভাগ- সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ, ফার্সি ও উর্দু, দর্শন এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি।
বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ছিল- পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং গণিত।আইন অনুষদের অধীনে ছিল- শুধুমাত্র আইন বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৮৪টি বিভাগ, ১৩টি ইনস্টিটিউট এবং ৬০টি গবেষণা কেন্দ্র ও ব্যুরো রয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিচ অ্যান্ড লিবার্টি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার জন্যে রয়েছে ১৯ টি আবাসিক হল ও ৪টি হোস্টেল , ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে।
প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৪৭জন।৮৪৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৮৬ জন ঢাকা (শহীদুল্লাহ) হলে, ৩১৩ জন জগন্নাথ হলে এবং ১৭৮ জন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪৬,১৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ (ইংরেজি বিভাগ; এমএ-১৯২৩)। ১৯২৭ সালে গনিত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ফজিলতুন্নেসা জোহা। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে ফজিলতুন্নেসা প্রথম স্নাতক ডিগ্রীধারী। তার আগে আর কোনো মুসলমান মেয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করতে পারেনি। দেশেরে প্রথম নারী অধ্যক্ষ তিনি। ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন।শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন।করুণাকণা গুপ্ত প্রথম মহিলা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।করুণাকণা গুপ্ত ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। এই বিভাগ থেকে ১৯৩২ সালে স্নাতক এবং ১৯৩৩ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি লাভ করেছিলেন। শতকরা ৭০ ভাগের বেশি নাম্বার পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৩৩ সালে রমেশচন্দ্র মজুমদারের অধীনে ইতিহাস বিভাগের গবেষক হিসেবে যোগ দেন।বর্তমান পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় দুই হাজার ৮ জন শিক্ষক। শিক্ষকদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত।
ফিলিপ হার্টগ
ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের প্রথম চ্যান্সেলর ছিলেন লওরেন্স জন লামলে ডানডাস (১৯২১-১৯২২)।প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবৎ মোট ২৮ জন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেছেন।প্রথম ভাইস চ্যান্সেলার হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্টার ফিলিপ হার্টগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোষাধ্যক্ষ (অবৈতনিক) ছিলেন জে.এইচ লিন্ডসে, আইসিএস (১-৭-১৯২১ থেকে ২০-২-১৯২২), প্রথম রেজিস্ট্রার খানবাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমদ (১০-৪-১৯২১ থেকে ৩০-৬-১৯৪৪) এবং প্রথম প্রক্টর ফিদা আলী খান (১৯২৫-১৯৩০)। ১৯৭৬ সাল থেকে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর পদ সৃষ্টি করা হয়। প্রথম প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন ড. মফিজুল্লাহ কবির।বর্তমান ও ২৮ তম উপাচার্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। তিনি প্রথমে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমানে পূর্ণকালীন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা)অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল।বর্তমান প্রক্টর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী। সীমা ইসলাম হলেন ঢাবির ইতিহাসে প্রথম নারী সহকারী প্রক্টর।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন কোর্স প্রণয়ন, বিভাগ সৃষ্টি ও অনুষদ প্রতিষ্ঠার ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ডিগ্রি ও সমমানের ৫৫টি অধিভুক্ত কলেজের তদারকির দায়িত্বও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ন্যস্ত হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৫২ সাল থেকে সাধারণ স্নাতক ডিগ্রির জন্য নির্ধারিত বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে পড়ানোর ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫। ১৯৫৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৭টি কলেজকে অধিভুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগের কলেজগুলিকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এক ঘোষণাবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।তবে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৭৪টি অঙ্গীভুত (Constituent) কলেজ ও ইনস্টিটিউট (২২টি সরকারি ও ৫২টি বেসরকারি) রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৬১টিতে ডেন্টাল, নার্সিং, ফিজিওলজি, হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আর্য়ুবেদিকসহ চিকিৎসা বিজ্ঞান, ৪টি গার্হস্থ্য অর্থনীতি এবং ৯টি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করা হয়।বর্তমানে অধিভুক্ত ৭ টি সরকারি অনার্স কলেজ রয়েছে - ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।এসব কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে বর্তমানে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন ছাত্রছাত্রী এবং এক হাজার ১৪৯ জন শিক্ষক রয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার আঠারো হাজার বই নিয়ে যাত্রা শুরু করে।১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংগৃহীত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৬৫০০০০ এবং প্রাচীন পান্ডুলিপির সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজার।সাড়ে ৪১ হাজারেরও বেশি  সাময়িকী ও জার্নাল রয়েছে।
১৯২২ সালের ১লা ডিসেম্বর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত শিক্ষকদের একটি সভায় ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ' নামে একটি ছাত্র সংসদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।১৯২৩ সালের ১৯শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী পরিষদ পূর্বোল্লিখিত শিক্ষক সভার সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে এর নাম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ' গ্রহণ করা হয়। প্রথমবার ১৯২৪-২৫ সালে ভিপি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও জিএস ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অনেকবার ডাকসু নির্বাচন হলেও ৯০ সালের পর থেকেই ডাকসু নির্বাচন বন্ধ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ১৯৯০ পর্যন্ত ৩৬ বার নির্বাচন হয়েছে।দীর্ঘ ২৮ বছর পর কিছুটা সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে ২০১৯ সালে ১১ই মার্চ বহুল প্রতিক্ষিত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।সম্প্রতি ডাকসুর মেয়াদ শেষ হয়েছে। উল্লেখ্য, ডাকসু নির্বাচনের পর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান থেকে এক বছর পর্যন্ত মেয়াদ থাকে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ব্রিটিশ আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম নিয়মিত সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি।তৎকালীন বাংলার গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড লিটন স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেন I have already stated in public that in my opinion this university is DaccaÕs greatest possession and will do more than anything else to increase and spread the fame of Dacca beyond the limits of Bengal or even of India itself. এ বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়, বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অর্জনের পেছনে পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এরপর ১৯২৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই সর্বমোট ২৪ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ আমলে শেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের ২১ নভেম্বর। পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ। ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ সমাবর্তনে উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. এম ওসমান গনি ও চ্যান্সেলর আবদুল মোনায়েম খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোন সমাবর্তনে আচার্য ও উপাচার্য উভয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। কিন্তু, মোনায়েম খানের কাছ থেকে ডিগ্রি নিতে ছাত্র ছাত্রীরা অস্বীকার করলে এই সমাবর্তন পণ্ড হয়ে যায়।১৯৭০ সাল পর্যন্ত আরও ১৫ বার সমাবর্তন হয়। পাকিস্তান আমলে সর্বশেষ সমাবর্তন হয় ১৯৭০ সালের ৮ মার্চ; সেটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম সমাবর্তন। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো ১৯৭৫ সালে ৪০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৫ আগস্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে সমাবর্তন উদ্বোধন করার কথা ছিল; কিন্তু তার আগেই ভোররাতে ঘটে যায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডি। এরপর ৪০তম সমাবর্তন হয় ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর।এরপর ২০০১ সালে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর থেকে নিয়মিত ভাবেই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সর্বশেষ ৫২তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ২০২০ সালের সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি (মরণোত্তর) দেওয়া হবে।
১৯২৩ সালের ১৭ আগস্ট একাডেমিক কাউন্সিলের এক সভায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মটো বা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় Truth shall prevail অর্থাৎ সত্যের জয় সুনিশ্চিত।বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ‘Truth shall Prevail’ শ্লোগান লেখা মনোগ্রাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পরবর্তী সময়ে এ মনোগ্রাম তিনবার পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত প্রথম মনোগ্রামে আরবিতে ‘ইকরা বিস্মে রাবিবকাল লাজি খালাক্ক’ (১৯৫২-৭২), দ্বিতীয় মনোগ্রামে ‘শিক্ষাই আলো’ (১৯৭২-৭৩) এবং ‘শিক্ষাই আলো’ লেখা সম্বলিত নতুন ডিজাইনের তৃতীয় মনোগ্রাম অদ্যাবধি ব্যবহার করা হচ্ছে।
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক
এ বিশ্ববিদ্যালয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয় প্রত্যাশা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা আন্দোলন, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী। মুক্তিযুদ্ধকালে পাক-সরকারের বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার শিকার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যাপলয়ের ১৯ জন শিক্ষক। ২৫ মার্চ রাতে আরো শহীদ হন ১০৪ জন ছাত্র, ১ জন কর্মকর্তা ও ২৮ জন কর্মচারী। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের পশ্চিমগেটের দোতলার ছাদের উপর প্রথম ‘স্বাধীন বাংলার পতাকা’ উত্তোলন করে। ৭১’-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে অতর্কিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর হামলা করলে অনেকে শহীদ হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য উপাচার্য ভবনের সম্মুখস্থ সড়ক দ্বীপে ২৬ মার্চ ১৯৯৪ তারিখে উদ্বোধন করা হয় ‘বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক’। এই স্থিতিফলকে ১৯ জন শিক্ষক, ১০৪ জন ছাত্র, ১ জন কর্মকর্তা, ২৮ জন কর্মচারীসহ ১৫০ জন শহীদের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে।
গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল