একজন মুসলিমের নামে লাদাখের গালওয়ান উপত্যাকা


ভারত চীনের সংঘাতের পর লাদাখের গালওয়ান উপত্যাকার নাম বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে সারা দুনিয়ায়।এটাই এখন ভারত ও চীন এই দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের সংঘাতের সর্বশেষ ফ্ল্যাশপয়েন্ট।স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে গালওয়ান উপত্যাকা দুদেশের কাছেই অতিব গুরুত্বপূর্ণ। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই লাদাখে ক্ষমতা বিস্তারের জন্য শুরু হয় রাজনৈতিক টানাপোড়েন। লাদাখের রয়্যাল নামগাল বংশের রাজাদের হারিয়ে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন কাশ্মীরের রাজা গুলাব সিং। পরবর্তীকালে সেই সাম্রাজ্যও বিকিয়ে যায় ব্রিটিশ শক্তির হাতে। পাশাপাশি চিন এবং রাশিয়াও হাত বাড়ায় লাদাখের দিকে। যদিও লাদাখের অধিকাংশ অংশই তখনো অনাবিষ্কৃত। ফলে শুরু হল দুর্গম অঞ্চল গুলোতে অভিযান, নতুন পথের সন্ধান এবং আধিপত্য স্থাপনের কাজ। শ্রমিক হিসাবে কাজে লাগানো হত লাদাখের অধিবাসীদের। চলত লাদাখের বরফে মোড়া ধূসর গ্রামগুলোতে লুঠতরাজ-ও।অনেকেরই হয়তো জানা নেই, প্রায় ১২৫ বছর আগে এর নামকরণ করা হয়েছিল লাদাখেরই এক কিংবদন্তী পর্বতারোহী ও মুসলিম অভিযাত্রী গুলাম রসুল গালওয়ানের নামে। গুলাম রসুল গালওয়ানের জন্ম লাদাখের রাজধানী লেহতে, সম্ভবত ১৮৭৮ সালে।লাদাখের ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দারিদ্র্য, অধিগ্রহণের ছাপ।গুলাম রসুল গালওয়ান পরিবারের আর্থিক অবস্থার সামাল দিতে মাত্র ১২ বছর বয়সেই নামলেন শ্রমিকের কাজে। অফিসার কিংবা বণিকদের মালবহন, পশুর পাল পৌঁছে দেওয়া, অশ্ব-পরিচালক এসবেই হাত লাগালেন তিনি। বদলে কখনো মিলত দু’মুঠো খাবার, কখনো সামান্য অর্থ।১৯২৫ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে প্রাণ হারিয়েছিলেন গালওয়ান।কাশ্মীরি ভাষায় গালওয়ান শব্দের অর্থ হল ডাকাত। গুলাম রসুল গালওয়ানের পিতামহ কারা গালওয়ান।কারা অর্থ কালো।কারা গালওয়ান ছিলেন ১৯ শতকের কাশ্মীরে বিখ্যাত এক দস্যু- ধনীর সম্পদ লুটে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার জন্য তার খ্যাতি ছিল রবিনহুডের মতো।কাশ্মীরের মহারাজার শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে তার গলাতেও কারা গালওয়ান ছুরি ধরেছিলেন বলে জনশ্র্রুতি আছে।কিন্তু পরে রাজার সেনাদের পাতা ফাঁদে ধরা পড়েই কারার ফাঁসি হয়- আর তার পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন লাদাখে। কিন্তু ততদিনে তাদের নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে যায় গালওয়ান বা ডাকাত শব্দটি।

বিধবা মা তাকে বড় করে তুলছিলেন, কিন্তু চরম দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধে মাত্র বারো-তেরো বছর বয়স থেকেই সে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের সঙ্গে নানা অভিযানে সামিল হতে শুরু করে। বারো বছর বয়সে স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ডের দলে পোর্টার বা মালবাহক হিসেবে তার অভিযানের শুরু। পশ্চিমা অভিযাত্রীরা তখন ঘন ঘন তিব্বত, ইয়ারকান্ড (যা এখন চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর স্বশাসিত অঞ্চল), কারাকোরাম, পামির মালভূমি বা মধ্য এশিয়ার দিকে অভিযান পরিচালনা করছেন, কিশোর গুলাম রসুলও ছুটে যেত তাদের সঙ্গে। Ghulam Rasool Galwan, either led or was part of numerous expeditions into Tibet, Yarkand in Xinjiang, the Karakoram range, the Pamirs and other Central Asian regions — mostly through inhospitable geographies with altitudes ranging from 5,000 m to 7,000 m above sea level where temperatures plunged to -30 degree Celsius in winter.তবে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায় ১৮৯২ সালে চার্লস মারে’র (সেভেন্থ আর্ল অব ডানমোর) সঙ্গে পামীর ও কাশগার পর্বত অভিমুখে এক অভিযানে বেরিয়ে।
লাদাখের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল গণি শেখ লিখেছেন, ‘ওই দলটি লাদাখের এক দুর্গম অঞ্চলে উঁচু উঁচু পর্বতমালা আর খাড়া গিরিখাতের এক মাঝখানে পড়ে থমকে গিয়েছিল- যেখান থেকে বেরোনোর কোনও রাস্তা দেখা যাচ্ছিল না।’গুলাম রসুল তখন তার বয়স মাত্র ১৪ – নিজেই বেরিয়ে পড়ে সেই জটিল গোলকধাঁধার মধ্যে থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতে। তারপর খাদের ভেতর দিয়ে সে একটা বেশ সহজ রাস্তা ঠিক খুঁজেও বের করে ফেলে, যার ফলে ওই অভিযান শেষ পর্যন্ত কোনও ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই সম্পন্ন হতে পেরেছিল।’‘অভিযাত্রী দলের নেতা চার্লস মারে কিশোর গুলাম রসুলের প্রতিভায় এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি কলকল করে বয়ে যাওয়া যে জলধারাটির পাশ ঘেঁষে নতুন রাস্তাটির সন্ধান মেলে তার নামকরণই করে ফেলেন গালওয়ান নালা’। সেই থেকেই গুলাম রসুল গালওয়ান লাদাখের শুধু ইতিহাস নয়, ভূগোলেরও অংশ হয়ে গেছেন।
সামান্য মালবাহক ও টাট্টু ঘোড়ার চালক থেকে গুলাম রসুল গালওয়ান একদিন লেহতে নিযুক্ত ব্রিটিশ জয়েন্ট কমিশনারের ‘আকসকল’ বা প্রধান সহকারীর পদেও উন্নীত হয়েছিলেন। আর অভিযানে বেরিয়ে পড়াটা ছিল তার নেশা, অর্থকষ্ট মিটে যাওয়ার পরও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যে কত অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা পথপ্রদর্শন করেছেন তার কোনো হিসাব নেই। Galwan for almost 35 years assisted expeditions led by British, Italian, and American explorers, he eventually rose to the ranks of 'aksakal' or chief assistant of the British joint commissioner of Leh in 1917.(TheEconomicTimes)মাত্র সাত চল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন গুলাম রসুল গালওয়ান। আর নানা অভিযানের ফাঁকে ফাঁকেই ইংরেজিতে লিখে ফেলেছিলেন নিজের আত্মজীবনী, ‘Servant of Sahibs: A Book To Be Read Aloud এক সময় এক বর্ণ ইংরেজি না-জেনেও কীভাবে তিনি ইংরেজিতে নিজের জীবনের স্মৃতিকথা লিখলেন, তারও এক মজার ইতিহাস আছে।গুলাম রসুল গালওয়ান লাদাখি, উর্দু আর তুর্কী ভাষা বলতে পারতেন গড়গড় করে, জানতেন কাজ চালানোর মতো তিব্বতি আর কাশ্মীরিও। Ghulam Rasool Galwan, was not very well educated but was a keen learner and learned to speak many languages from Francis Young husband including Chinese, and English. Besides native Ladakhi, he also spoke Turki, Urdu, Kashmiri, and Tibetan.কিন্তু ইংরেজিতে অত সড়গড় ছিলেন না। মার্কিন অ্যাডভেঞ্চার রবার্ট ব্যারেটের সঙ্গে এক অভিযানে বেরিয়ে তার সিরিয়াস ইংরেজি চর্চার শুরু।রবার্ট ব্যারেটের স্ত্রী ক্যাথরিনই তার আত্মজীবনীর সম্পাদনা করেছেন প্রায় এক যুগ ধরে। ক্যাথরিন ব্যারেট পরে জানিয়েছেন, ‘আমার স্বামীর সঙ্গে গুলাম রসুল গালওয়ানের যখন প্রথম দেখা হয় তখন তিনি বড়জোর দশ-বারোটা ইংরেজি শব্দ জানতেন। কিন্তু ইংরেজিতে লেখার ইচ্ছা ছিল প্রবল।’রবার্ট ওর সঙ্গে সব সময় ধীরে ধীরে ইংরেজিতে কথা বলতেন যাতে ও শব্দগুলো শিখতে পারে। ওকে পড়ার জন্য দিয়েছিলেন একটা কিং জেমসের বাইবেল আর সপ্তদশ শতাব্দীর ট্র্যাভেলগ।’গুলাম রসুল একটানা দশ বছর ধরে নিজের ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতেই আত্মজীবনীর নোট নিতেন, আর তারপর ডাকে সেগুলো আমার কাছে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিতেন।


প্রথমে পান্ডুলিপিগুলো আবার লেখার জন্য গুলাম রসুলের কাছে ফেরত পাঠাতে হলেও পরে আর তার দরকার হত না তার নিজস্ব লেখার ভঙ্গীটাই বজায় রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ক্যাথরিন ব্যারেট।অবশেষে বিলেতের কেম্ব্রিজে প্রকাশনা সংস্থা ডাবলিউ হেফার অ্যান্ড সন্স থেকে ১৯২৩ সালে বের হয় সেই আত্মজীবনী : Servant of Sahibs: A Book To Be Read Aloud এখন দিল্লির The Economic Times পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন রসুল বাইলে, পারিবারিক সম্পর্কে গুলাম রসুল গালওয়ান ছিলেন যার প্রপিতামহ।সেই রসুল বাইলে বলছিলেন,‘আজকের লাদাখে পয়সাকড়ি এসেছে পর্যটনের সুবাদে। কিন্তু একদিন লাদাখি যুবকদের জন্য পশ্চিমা অভিযাত্রীদের সঙ্গে বিপজ্জনক অভিযানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া কোনো উপার্জনের রাস্তা ছিল না, আর সেখানে সবচেয়ে ঝুঁকির কাজগুলো তাদেরই করতে হত।আমার প্রপিতামহ গুলাম রসুল গুলওয়ানই সেই ধারাটার সূচনা করেন। ফ্রস্টবাইটে তার হাত ও পায়ের অনেকগুলো আঙুল পর্যন্ত খোয়াতে হয়েছিল – কিন্তু গালওয়ান উপত্যকার নামকরণের মধ্যে দিয়ে তার স্মৃতি আজও অমলিন রয়ে গেছে!’রসুল বাইলে একদিন তার প্রপিতামহের নামে লাদাখে নিজের জমিতে একটা হোটেল চালু করার স্বপ্নও দেখেন। তবে তার চাচা এর মধ্যেই রাস্তার উল্টো দিকে চালু করে দিয়েছেন পর্যটকদের জন্য এক আধুনিক বিশ্রামাগার, ‘গালওয়ান গেস্ট হাউস’! সেই ঔপনিবেশিক আমলে কোনো ভৌগোলিক নিদর্শন তা সে পর্বতশৃঙ্গই হোক বা উপত্যকা-গিরিখাত নেটিভ বা দেশি অভিযাত্রীদের নামে নাম রাখার ঘটনা ছিল খুবই বিরল।ব্রিটিশ অভিযাত্রীদের নামে নামকরণ করাটাই তখন ছিল দস্তুর।গালওয়ান উপত্যকা ছাড়া আর কোথাও কোনো ভারতীয় নাগরিকের কপালে এই সম্মান জুটেছে এমন একটি দৃষ্টান্তও আমার জানা নেই।”
লাদাখের ধূসর পাহাড় আর তুষারধবল শিখর দিয়ে ঘেরা রুক্ষ ও প্রশস্ত, পাথুরে এক ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে গালওয়ান নদী, গালোয়ান নদী চীনের জিনজিয়াং ও ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত শ্যোক নদীর একটি উপনদী। The river originates from the Aksai Chin region, joins the Shyok River inside Indian territory west of LAC to form an upstream tributary of Indus River.গোলাম রসুল গালোয়ানের নামে এই নদীর নামকরণ করা হয়েছে। গালোয়ান নদীর দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটার।The river is named after Ghulam Rasool Galwan, a Ladakhi explorer of Kashmiri descent, who first explored the course of the river. In 1899, he was part of a British expedition team that was exploring the areas to the north of the Chang Chenmo valley, when he ran into this previously unknown river valley.

গ্রন্থনায়- মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল