সাদা কালো বৈষম্যে আমেরিকা, ইসলাম বলে সমানাধিকার
মো.আবু রায়হানঃআমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাষ্ট্রের পুলিশ প্রকাশ্য রাস্তায় জর্জ ফ্লয়েড নামে রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তাকর্মী এক কৃষ্ণাঙ্গের গলা হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ফ্লয়েড বারবার বলছে, 'আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।' তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে আসছে। মৃত্যুর আগে পানি চেয়ে অনুরোধ জানায় পুলিশকে। পথচারীরাও অনুরোধ করে ফ্লয়েডকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। পাশে আরও পুলিশ ছিল একজন মানুষকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টায় করেনি। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর ফ্লয়েডের অনুরোধ পুলিশ অফিসারের কানে যায়নি। মৃত্যুযন্ত্রণা তাকে এতটুকু টলাতে পারেনি। রীতিমতো হাঁটু দিয়ে মাটিতে পিষতে থাকে পুলিশ। ওই অবস্থায় কয়েক মিনিট ছটফট করতে করতে ফ্লয়েড নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।এই হল তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার দাবিদার আমেরিকার সাম্প্রতিককালের বর্ণবাদের ভয়ঙ্কর চিত্র।
ইংরেজি রেস থেকে রেসিজম তথা বর্ণবাদ কথাটির উদ্ভব। এক্ষেত্রে মানুষের গাত্রবর্ণ, সামাজিক শ্রেণি, বংশ পরিচয় ও জন্মস্থানের উপর ভিত্তি করে মানুষে মানুষে বিভক্ত করে কোন জাতি বা গোষ্ঠী তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করলে তাকে বর্ণবাদ বলে। উইলিয়াম জে. `Races & People’ নামক গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “রেসিজম হল নিজেদেরকে ছাড়া অন্যান্য যে কোন গোষ্ঠীকে মূলৎপাটনের চেষ্টা অথবা মানুষ হিসেবে তাদের অস্তিত্ব নাকচকরণ। এরই ফলাফলে তারা নিজেদেরকে মনে করে শ্রেষ্ঠতর। আর অন্যদেরকে করে তুচ্ছ-জ্ঞান। এই তুচ্ছ চোখে দেখার কারণেই অন্যদের মাঝে কোন ঐশ্বর্য বা অর্জন দেখলে তা আত্মসাৎ করার প্রয়াসও কম থাকে না তাদের। এজন্যই অনেক বিশ্লেষকের মতে, প্রত্যেক উপনিবেশিকতা জন্ম দেয় একেকটি বর্ণবাদের, তবে প্রত্যেক বর্ণবাদ জন্ম হয় না উপনিবেশিকতার উদরে। রেসিজমের আরেকটি রূপ হল, বৈষম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে, মানবজাতির এক অংশকে শ্রেষ্ঠ, আরেক অংশকে হেয়তর বলে মনে করা।”
A belief or doctrine that inherent differences among the various human racial groups determine cultural or individual achievement, usually involving the idea that one's own race is superior and has the right to dominate others or that a particular racial group is inferior to the others.(www.dictionary.com )
বর্ণবাদী বৈষম্যের যে প্রকাশ ঘটে সমাজে, এর পিছনে বিদ্যমান রয়েছে কয়েকটি মৌলিক কারণ বিদ্যমান। ১. শ্রেনি, ২. গাত্রবর্ণ, ৩. ধর্ম, ৪. ভাষা, ৫. জন্মভূমি, ৬. উগ্রবাদী লেখকদের রচনা, ৭. সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক, ৮. যুদ্ধগত দিক।শুধু জর্জ ফ্লয়েডদের হত্যা কেন ? বর্ণবাদ আমেরিকায় ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে আছে ৪০০ বছর ধরে । এই ভাইরাসের কোনও ভ্যাক্সিন এখনও আবিস্কার তারা করতে পারেনি ।আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, এ কথা শুধু জর্জ ফ্লয়েডের মুখ থেকে বেরোয়নি। এরিকের জন্যও ঠিক একই রকমভাবে বের হয়েছিল। যার হত্যায় ২০১৪ সালে সারা আমেরিকা জুড়ে বর্ণবাদবিরোধী মিছিল বেরিয়েছিল। একই রকমভাবে মানুষ তখন স্লোগান দিয়েছিল আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। এখন যেমন জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানুষ প্ল্যাকার্ডে লিখছে, ‘কালোদের জীবনও জীবন’। ২০১৪ সালেই মিসৌরির ফার্গুসনে এক সাদা পুলিশ মাইকেল ব্রাউন নামের কালো একটি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছিল। ছয়টি বুলেট ঢুকেছে মাইকেলের শরীরে। আমেরিকার বর্ণবাদ শুধু কালোদের বিরুদ্ধে নয়, যে সাদা নয় তার বিরুদ্ধেই। বাদামি হলুদদের বিরুদ্ধে। যে খ্রিস্টান নয়, তার বিরুদ্ধেও। আরব, মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
জর্জ ফ্লয়েডদের মৃত্যু বারবার বর্ণবাদ ও বর্ণবাদী নিপীড়নের বিদ্যমানতার কথা প্রমাণ করে। বিশ্ব লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, মুগাবের ,বারাক ওবামাদের উত্থান দেখেছে। আশ্বস্ত হয়েছে, কিন্তু স্বস্তি পায়নি। মুগাবে বলছেন, ‘বর্ণবাদকে বর্ণবাদ দিয়ে নয়, ঐক্য দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।’ যত দিন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিভাজন সৃষ্টিকারী নেতা বিশ্বের দেশে দেশে থাকবেন, তত দিন বর্ণবাদ থেকে আমেরিকানদের নিস্তার নাই। যে কিনা পরিস্থিতি শান্ত করতে সেনাবাহিনী নামানোর কথা বলে। বিক্ষোভকারীদের ভয়ে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে।‘বর্ণবাদ তত দিন থাকবে, যত দিন সাদা গাড়িগুলোর চাকা কালোই থাকবে। দুর্ভাগ্য বোঝাতে কালো, আর শান্তি বোঝাতে সাদার ব্যবহার যত দিন থাকবে, তত দিন থাকবে বর্ণবাদ। বিয়ের পোশাক সাদা, আর শবযাত্রায় কালো পোশাকের চল যত দিন থাকবে, তত দিন থাকবে বর্ণবাদ। করখেলাপি বা মন্দ লোকেদের যত দিন সাদা নয়, কালোতালিকাভুক্ত করা হবে, তত দিন বর্ণবাদ থাকবে। এমনকি স্নুকার খেলায়ও কালো বলটিকে গর্তে না ফেলা পর্যন্ত কেউ জিততে পারে না, আর সাদা বলটিকে বরাবর টেবিলের ওপরই থাকতে হয়।’ কথাটি বর্ণবাদের সঙ্গে মিশে আছে।
আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেন এবং দাসদের মুক্তির ঘোষণা দেন। কাগজে-কলমে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলে, কিন্তু মগজে-মননে রয়ে গেলে। কালোদের পক্ষ নেওয়ায় দাসপ্রথার সমর্থকরা ১৮৬৫ সালে আব্রাহাম লিঙ্কনকে গুলি করে হত্যা করে।একটা সময় ছিল যখন কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গরা চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করত। শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে মিশত না। খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন, চলাফেরা- দৈনন্দিন জীবনের ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে দেশটির সাদা চামড়ার অধিবাসীদের কাছ থেকে নিগ্রহের শিকার হচ্ছিলেন তারা।এমনকি, শ্বেতাঙ্গ মানুষ বাসে উঠলে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে সিট ছেড়ে দিতে হতো, একই সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাবার খেত না। বর্ণ বৈষম্য ছিল প্রকট। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে রোসা পার্কস নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। পার্কসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি অফিস থেকে বাসে করে ফেরার সময় আরেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান যাত্রীকে কেন নিজের আসন ছেড়ে দেননি। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকায় আনুষ্ঠানিক সিভিল রাইটস মুভমেন্ট শুরু হয়। তখন মার্টিন লুথার কিং এবং সোসাইটির সবাই মিলে এর প্রতিবাদ স্বরূপ আন্দোলন শুরু করেন।মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রই প্রথম ব্যক্তি, যিনি আমেরিকায় কালো মানুষের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ শুরু করেন। তারা বাস সার্ভিস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন, কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ নিজের গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাতায়াত করতে থাকেন। এই আন্দোলন অনেক দিন চলার পর অ্যালাবামা রাজ্যে যানবাহনে শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গদের ভেদাভেদকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসির লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক মুক্তি, চাকরির ক্ষেত্রসহ সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের দাবিতে এক বিশাল সমাবেশ করেন। এই সমাবেশ ছিল আমেরিকার ইতিহাসে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ। ওয়াশিংটন থেকে লিঙ্কন মেমোরিয়াল পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তাঁর দেওয়া বিখ্যাত ভাষণ ‘অ্যাই হেভ অ্যা ড্রিম’—জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক স্মরণীয় ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি তাঁর ভাষণে তুলে ধরেন কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণ, বিদ্বেষ, নির্যাতনের কথা। বলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো প্রাপ্তি নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত কালোরা নির্যাতনের শিকার হবে, হোটেলে, মোটেলে থাকার অধিকার না পাবে, কেবল শ্বেতাঙ্গদের জন্য—‘এমন সাইন বোর্ড থাকবে’। আমি জানি, আজ বা কাল আমাদের সময় সংকটময়। তবুও আমি স্বপ্ন দেখি, এ জাতি জাগ্রত হবে, মানুষের বিশ্বাসের মূল্যায়ন হবে। জাতিগত বৈষম্যের অবসান হবে। সব মানুষ জন্মসূত্রে সমান। আলোড়ন তোলা ‘অ্যাই হেভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণের প্রভাবেই ১৯৬৪ সালে আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়।মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে মার্টিন লুথার কিং নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। যত দিন বেঁচে ছিলেন, নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, সাদা-কালো নয়, সব মানুষ সমান—এমন আদর্শ বাস্তবায়নে লড়েছিলেন। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী আততায়ীর গুলিতে এই মহান নেতা নিহত হন। তিনি বলেছিলেন, যদি উড়তে না পার তবে দৌড়াও, যদি দৌড়াতে না পার তবে হাঁটো, যদি হাঁটতে না পার তবে হামাগুড়ি দাও, যাই করো না কেন সামনে এগিয়ে যেতে হবেই। মার্টিন লুথার কিং নিহত হওয়ার তিন বছর আগে ১৯৬৫ সালে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের আরেক অবিসংবাদিত নেতা ম্যালকম (মালিক আল শাব্বাজ) শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কে একটি হলরুমে বক্তৃতা করতে দাঁড়ালে হঠাৎ একসঙ্গে কয়েকটি বন্দুক গর্জে ওঠে। বুকে ৯৫টি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ম্যালকম তথা মালিক আল শাব্বাজ। এভাবেই যুগে যুগে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানবতার পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠস্বরগুলোকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে।সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আজ সাদা-কালোর দূরত্ব এখনো অপরিবর্তিত। যার প্রমাণ সর্বশেষ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু । আমেরিকার কালো মানুষদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ, অথচ কারাগারে মোট বন্দির ৪০ শতাংশই হলো এ দেশের কালো মানুষ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস এর এক সামপ্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০-৩৪ বছর বয়সী এমন প্রতি নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন এখন জেলে। আরেকটি গবেষণা বলছে, প্রতি তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। যে অপরাধে এরা জেলে, একই অপরাধে সাদা বা বাদামি রঙের মানুষেরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। আমেরিকায় কালোদের সামান্য অপরাধেই বড় সাজা পেতে দেখা যায়। সাদাদের ক্ষেত্রে বড় অপরাধেও তা হয় না। অনেক বছর আগে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নিউ জার্সির নিউ হার্লেম-এর কৃষ্ণাঙ্গ বাসিন্দাদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যেখানে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের গড় আয়ু ৭৯ বছর সেখানে নিউ হার্লেম-এর বাসিন্দাদের গড় আয়ু ৪০ বছর, যা দরিদ্র রাষ্ট্র বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর চেয়েও কম। যুক্তরাষ্ট্রে অন্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের মধ্যে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, উইসকনসিন অঙ্গরাষ্ট্রের Milwaukee County-i ২৬ শতাংশ মানুষ কালো, কিন্তু এ কাউন্টিতে করোনায় মোট মৃত্যুর ৭৩ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। লুইজিয়ানায় ৩২ শতাংশ কালো মানুষের বসবাস, অথচ করোনায় মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। শিকাগোতে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী ৩২ শতাংশ, আর করোনায় মৃত্যু হার ৬৭ শতাংশ। শিকাগোতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর হার ৬ গুণ বেশি। জর্জিয়ার Dougherty County-তে করোনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যু হার ৯০ শতাংশের বেশি।
মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি মানুষের মাঝে রাখেননি কোনো বৈষম্য। ইসলাম মানব জীবনের এক অনুপম জীবনাদর্শ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবনের সকল অধিকার সমানভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। যেখানে সাদা-কালো, উচু-নিচুর মতো কোনো বর্ণ বৈষম্যের স্থান নেই। সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে মানব জাতি অতি মর্যাদাবান।এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল - আয়াত ৭০)।
জন্মগতভাবে মানুষ কেন সাদা-কালো হয়, এর একটি ব্যাখ্যা হাদিসে এসেছে। গায়ের রং ঠিক কি কারণে আলাদা বর্ণের হয়েছে।বিজ্ঞান এর নানা রকম বর্ণনা দিয়েছে। তবে অনেকের আগ্রহ কুরআন ও হাদিস এ প্রসঙ্গে কী বলেছে।এ প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদিসের বেশ কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। আবু মুসা আশয়ারী রা. থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। রাসুল সা. বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আদমকে এক মুঠো মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং এই মাটি তিনি জমিনের সব জায়গা থেকে নিয়েছেন,যার কারণে আদম সন্তান হয়েছে জমিনের প্রকৃতির মতো, কেউ লাল, কেউ কালো, কেউ সাদা ও কেউ হলুদ এমন নানা বর্ণের । এভাবে কেউ হয়েছে নরম স্বভাবের, কেউ হয়েছে কঠিন, কেউ ভালো, আবার কেউবা খারাপ।’(তিরমিযি, ইবনে হিব্বান) বিজ্ঞান বলে, আমাদের ত্বকে তো অনেক উপাদানই থাকে। এরকমই একটি উপাদান হলো মেলানিন। মানুষের গায়ের রং সাদা বা কালো হয় মূলত ত্বকে এই মেলানিনের উপস্থিতির কারণে। মেলানিনের কম বা বেশি থাকার উপরই নির্ভর করে একজন মানুষ সাদা হবে, না কালো হবে। যার শরীরে মেলানিন যতো বেশি, সে ততো কালো।পবিত্র কুরআনের ৪৯ নং সূরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে মানবজাতি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একজন নারী ও একজন পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সর্বজ্ঞ ও সবকিছুর খবর রাখেন। (সুরা হুজুরাত আয়াত-১৩)।
ইসলামে বহু দল-উপদল রয়েছে। রয়েছে বহু মত ও মতভেদ । তবুও মুসলমানদের জীবনাচারে এহেন বিদ্বেষ ও বৈষম্য কখনো দানা বাঁধতে পারেনি। এর মূলে রয়েছে ইসলামের কৌশলী কর্মপন্থা। প্রথমত, ইসলামের শিক্ষা হলো- সব মানুষ এক আল্লাহর পরিবারভুক্ত। মানুষের মধ্যে ভাষাগত ও বর্ণগত পার্থক্য আল্লাহর অসীম কুদরতের নিদর্শন মাত্র। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে'- (সুরা রুম, আয়াত ২২) । একই পিতা-মাতা (আদম ও হাওয়া) থেকে জন্মলাভের পরেও রঙ ও বর্ণে এক অপর থেকে পৃথক। কেউ কৃষ্ণকায়, কেউ শ্বেতকায়, কেউ নীলবর্ণের, আবার কেউ শ্যাম ও গৌরবর্ণের। অতঃপর কালো-সাদার মাঝেও এত স্তর রয়েছে যে, অধিকাংশ মানুষ এই দুই রঙে বিভক্ত হয়েও অনেক ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে এবং এক অপর থেকে একেবারেই ভিন্ন ও পৃথক মনে হয়। অতঃপর মানুষের চেহারার আকারও শ্রী, শরীরের গঠন এবং উচ্চতাতেও এমন পার্থক্য রাখা হয়েছে যে, বিভিন্ন দেশের মানুষকে আলাদাভাবে সহজেই চেনা যায়। একজন অপরজনের সাথে কোন মিল নেই; এমনকি সহোদর ভাই আপন ভাই থেকে আলাদা। এ সত্ত্বেও আল্লাহর কুদরতের পরিপূর্ণতা এই যে, কোন এক দেশের বসবাসকারী অন্য দেশের বসবাসকারী থেকে পৃথক হয়।অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তুমি কি দেখো না, আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত করেন; আর আমি তা দিয়ে বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উদ্গত করি। আর পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে বিচিত্র বর্ণের পথ-শুভ্র, লাল ও নিকষ কালো। এভাবে রংবেরঙের মানুষ, কীটপতঙ্গ ও জন্তু'- (সুরা ফাতির, আয়াত ২৭-২৮)।
বিদায় হজের ভাষণে রাসুল (সা.) স্পষ্ট করে বলেন, 'আরবের ওপর যেমন কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তেমনি অনারবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোনো আরবের। এমনকি শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কিংবা কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব বা বৈশিষ্ট্য নেই। শ্রেষ্ঠত্ব, বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার একমাত্র ভিত্তি হলো তাকওয়া।' অন্য হাদিসে এসেছে, 'আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা-সুরত, ধন-সম্পদের দিকে তাকান না; কিন্তু তিনি তোমাদের কর্ম ও অন্তরের অবস্থা দেখেন।' এ বাণীগুলোকে রাসুল (সা.) নিছকই 'গুরুজনের বাণী' হিসেবে উচ্চারণ করেননি। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর ২১ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র ঘোষণা করে মানুষে মানুষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। অথচ আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে মানবতার নবী মহানবী (সা.) বর্ণবৈষম্য রোধে যৌক্তিক, কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বিদায় হজ্জ্বের সময় মুহাম্মদ (সা.) এর শেষ ভাষণেও তিনি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে গিয়েছেন। তার বক্তব্যে তিনি বলেন,“কোন অনারবের উপর কোন আরবের, কোন আরবের উপর কোন অনারবের উচ্চ মর্যাদা নেই…….একজন শেতাঙ্গ একজন কৃষ্ণাঙ্গের তুলনায় এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ একজন শেতাঙ্গের তুলনায় উচ্চতর নয়। পার্থক্য শুধু মানুষের চরিত্র ও কর্মের মাধ্যমে।”মুসলমানদের বাস্তব জীবন কাঠামোকেও তিনি এই ধাঁচে গড়ে তুলেছেন। আজকের পশ্চিমারা যে কালো আফ্রিকানদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, তাদেরই বংশোদ্ভূত হযরত বেলাল (রা.)-কে ইসলামের প্রথম ও প্রধান মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে অমানবিক নির্যাতন সহ্য করেও এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী সাহাবির নাম হযরত বিলাল ইবনে রাবাহ আল হাবাসি (রা.)। হযরত বেলাল (রা.) ছিলেন কালো, লম্বা, মোটা ঠোঁট, চ্যাপ্টা নাক এবং কোঁকড়ানো চুলবিশিষ্ট। তবে তার কণ্ঠ ছিল ভরাট ও শ্রুতিমধুর।! একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়ায় এবং অধিকতর আমল করায় তিনি শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানের আসনে ভূষিত হয়েছিলেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, আমি মে’রাজে জান্নাতের মধ্যে বেলালের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছি।
আরও কয়েকজন আলোকিত কৃষ্ণাঙ্গের সন্ধান ইসলামে মিলে।ইসলামের প্রথম নারী শহিদ সুমাইয়া,তার পরিবার ইয়াসির ,আম্মার ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ।হযরত সাদ সালামি আল্লাহর নবীর একজন সাহাবী ছিলেন।তিনি অত্যন্ত গরীব সাহাবী ছিলেন।গায়ের রং ছিল খুবই কালো এবং মুখের মধ্যে ছিল বসন্তের দাগ।মিহজা বিন সালেহ ,মহানবী (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবি। বদরের যুদ্ধে প্রথম শহীদ মুসলমান। উম্মে আয়মান ,মহানবী (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম দিককার নারী, যিনি মহানবী (সা.)- এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন ও যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা করতেন।উবদা ইবনে আস সামিত, ইসলামের প্রাথমিক যুগে ধর্মান্তরিত হন, বদর ও ওহুদের যুদ্ধে অংশ নেন এবং মিসর জয়ে মুসলমান সেনাদের নেতৃত্ব দেন।উসামা ইবনে জায়েদ,মহানবী (সা.)-এর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সাহাবি এবং ১৭ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ করেন।সাদ আল আসওয়াদ , মহানবী (সা.)-এর সাহাবি, যিনি এক যুদ্ধে শহীদ হন। মহানবী (সা.) তার মৃতদেহ কোলে নিয়ে কেঁদে ছিলেন বলে বর্ণিত আছে।জুলাইবিব,মহানবী (সা.) কে সার্বিক সেবা করতেন। মৃত্যুর পর মহানবী (সা.) স্বয়ং তার কবর গর্ত করেন এবং গোসল ছাড়াই সমাহিত করে তাকে শহীদ আখ্যা দেন। তারিক বিন জিয়াদ , ৭১১ সালে স্পেন ও পর্তুগাল জয়ে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন।
লোকমান হাকিম যার নামে কুরআনের একটি সুরার নামকরণ করা হয়েছে তিনি কৃষ্ণবর্ণের প্রথম জীবনে ক্রীতদাস ছিলেন এ বিষয়ে সব গবেষকরা একমত।সেই আমলে পশু-পাখির মতো দরিদ্র ও অনুন্নত দুর্গম এলাকা থেকে ক্রীতদাস শিকার বা বন্দী করা হতো।লোকমান হাকিমকেও একইভাবে বন্দী করা হয় এবং এক মনিবের কাছে বিক্রি করা হয়।পবিত্র কোরআন শরিফের ৩১ নম্বর সূরার নাম সূরা লোকমান।লোকমান হাকিমের জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করতে মহান আল্লাহ ৩১ নং সূরা লোকমানের ১২ নং আয়াতে বলেছেন, ‘আমিই লোকমানকে হিকমত দান করেছিলাম এই বলে, (যে) আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ লোকমান হাকিম তার ছেলেদের যেসব উপদেশ দিয়েছেন,তা সূরা লোকমানে উল্লিখিত এবং পবিত্র কুরআনের অংশ। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধ করার জন্য।জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করার নির্দেশ- তাও ধনী-গরিব,বাদশাহ-গোলাম, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বৈষম্য ঘুচিয়ে আনার জন্য। সাম্য ও ঐক্যের ধারণাকে সামনে রেখেই সবাইকে কেবলামুখী হয়ে নামাজ ও কাবায় গিয়ে একই পোশাকে হজ আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে পবিত্র ঘর কাবার দেয়াল ও পর্দার কালো রং সব মুসলমানের শ্রদ্ধার পাত্র। ইসলামের ঈদ ও কোরবানি প্রথা- এ তো সাম্যেরই জয়ধ্বনি। ইসলাম মতে, সব মানুষ এক পিতার সন্তান। তাই ভাইয়ে ভাইয়ে বৈষম্য থাকতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকেই সৃষ্টি করেছেন'- (সুরা নিসা, আয়াত ১) একবার বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী (রা.) তর্কের সময় বিলাল (রা.) কে ‘কালো মায়ের সন্তান’ বলে গালমন্দ করলে রাসূল (সা.) এতে বিরক্ত হন। তিনি তখন আবু যর (রা.) কে বলেন, ‘তুমি এমন ব্যক্তি, যার মধ্যে এখনো জাহেলিয়াতের চিহ্ন রয়েছে”। রাসূল (সা.) এখানে হযরত আবু যর গিফারী (রা.) এর বক্তব্যকে ‘জাহিলিয়াতে’র সাথে তুলনা করেছেন। শব্দটি মূলত রাসূল (সা.) এর নবুওয়াতের পূর্বকালীন অবস্থাকে বুঝাতে ব্যবহার করা হয়, যখন সমগ্র পৃথিবী খোদায়ী নির্দেশনার অভাবে মূর্খতা ও বর্বরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। মুহাম্মদ (সা.) এর বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষ বিরোধী শিক্ষা পরবর্তীতে আরবদের এধরনের কুসংস্কারমূলক মনোভাবের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায় ও সাম্যের পথে চলতে নির্দেশনা প্রদান করে। অতএব, রাসুল (সা.)-এর ভাষ্যমতে, বর্ণবৈষম্য জাহেলিয়াত ও বর্বরতার অন্তর্ভুক্ত।। বিখ্যাত ইংরেজ পণ্ডিত জর্জ বার্নার্ড শ ইসলাম ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে বলেছেন, ‘চমৎকার প্রাণবন্ততার কারণে মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি আমি সবসময় সুউচ্চ ধারণা পোষণ করি। আমার কাছে মনে হয় এটাই একমাত্র ধর্ম যেটা সদা পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে, যা প্রত্যেক যুগেই মানুষের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম। আমি মুহাম্মদকে নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেছি। তিনি অতি চমৎকার একজন মানুষ এবং আমার মতে খ্রিষ্টানবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাকে অবশ্যই মানবতার ত্রাণকর্তা বলতে হবে’। (Sir George Bernard Shaw, ÔThe Genuine IslamÕ, Vol. 1, No. 8, 1936)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন