আবু রায়হান আল বেরুনী বিস্মৃত এক মুসলিম মনীষী
মো.আবু রায়হান:বেরুনী ছিলেন মধ্যযুগের বিশ্বখ্যাত একজন মুসলিম মনীষী। তিনি অত্যন্ত মৌলিক ও গভীর চিন্তধারার অধিকারী ছিলেন। Abu Rayhan al-Biruni was an Iranian scholar and polymath during the Islamic Golden Age. He has been variously called as the "founder of Indology", "Father of Comparative Religion", "Father of modern geodesy", and the first anthropologist. দশম শতকের শেষ এবং একাদশ শতকের শুরুর দিকে বিশ্বের যে সকল মনীষী সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজেদেরকে উজাড় করে দিয়েছেন তাদের মধ্যে আল-বেরুনী অন্যতম। তিনি ছিলেন গণিত, জ্যোতিঃপদার্থবিদ, রসায়ন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পারদর্শী। অধিকন্তু ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক, পঞ্জিকাবিদ, দার্শনিক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্বের নিরপেক্ষ বিশ্লেষক।( Al-Biruni is regarded as one of the greatest scholars of the medieval Islamic era and was well versed in physics, mathematics, astronomy, and natural sciences, and also distinguished himself as a historian, chronologist and linguist.)স্বাধীন চিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, সাহসিকতা, নির্ভীক সমালোচক ও সঠিক মতামতের জন্য যুগশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। Bīrūnī is one of the most important Muslim authorities on the history of religion. Al-Biruni was a pioneer in the study of comparative religion. He studied Zoroastrianism, Judaism, Hinduism, Christianity, Buddhism, Islam, and other religions.
তার পূর্ণ নাম আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বেরুনী। তিনি নিজের নাম আবু রায়হান লিখতেন কিন্তু ইতিহাসে তিনি আল বেরুনী নামে অধিক পরিচিতি পান। ইতিহাসের পাতা থেকে যতদূর জানা যায়,আল-বেরুনী ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর পুরাতন অক্সাস নদীর তীরে (বর্তমান আমু দারিয়া নদী নামে পরিচিত) খোরাসানের একটি জায়গা খাওয়ারিজমে (বর্তমানে এটি উজবেকিস্তানের একটি স্থান) জন্মগ্রহণ করেন ।শহরটি খাওয়ারিজিমের রাজধানীর কাছে ছিল। বর্তমানে শহরটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন এ স্থানটি আল-আল-বেরুনী শহর নামে অভিহিত। তিনি সর্বপ্রথম প্রাচ্যের জ্ঞানবিজ্ঞান, বিশেষ করে ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অধ্যাপক মাপা বলেন,আল-বেরুনী শুধু মুসলিম বিশ্বেরই নন, বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন।
তার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছিলো আল-ইরাক বংশীয় রাজপতি বিশেষ করে আবু মনসুর বিন আলী বিন ইরাকের তত্ত্ববধানে। এখানে তিনি সুদীর্ঘ ২২ বছর রাজকীয় অনুগ্রহে কাটিয়েছিলেন।।তিনি গণিতশাস্ত্র "আবু নাস -এর ইবন আলি ইবন ইরাক জিলানি এবং এমন আরো কিছু বিদ্বান ব্যক্তির কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। অধ্যয়নকালেই তিনি তার কিছু প্রাথমিক রচনা প্রকাশ করেন ।আল আল-বেরুনীর মাতৃভাষা ছিল খাওয়ারিজিম আঞ্চলিক ইরানি ভাষা। কিন্তু তিনি তার রচনাবলি আরবিতে লিখে গেছেন। আরবি ভাষায় তার অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তিনি আরবিতে কিছু কবিতাও রচনা করেন। অবশ্য শেষের দিকে কিছু গ্রন্থ ফার্সিতে অথবা আরবি ও ফার্সি উভয় ভাষাতেই রচনা করেন। তিনি গ্রিক ভাষাও জানতেন। হিব্রু ও সিরীয় ভাষাতেও তার জ্ঞান ছিল। (He was conversant in Khwarezmian, Persian, Arabic, Sanskrit, and also knew Greek, Hebrew and Syriac.) সেখানে অবস্থানকালেই আস্তে আস্তে তাঁর বিচিত্র প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ে। আব্বাসীয় খলিফাদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বহু স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব ঘটে। এ সময় খাওয়ারিজম প্রদেশেও দু’টি রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রদেশের দক্ষিণাংশে রাজত্ব করতেন আল বেরুনীর প্রতিপালক আল ইরাক বংশীয় আবু আবদুল্লাহ এবং উত্তরাংশে রাজত্ব করতেন মামুন বিন মাহমুদ।
৯৯৪-৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মামুন বিন মাহমুদ আবু আবদুল্লাহকে হত্যা করে রাজ্য দখল করে নিলে আল বেরুনীর জীবনে নেমে আসে দুঃখ দুর্দশা। যাদের তত্ত্বাধধানে তিনি সুদীর্ঘ ২২টি বছর কাটিয়েছেন তাঁদেরকে হারিয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ত্যাগ করেন খাওয়ারিজম এবং চলতে থাকেন আশ্রয়হীন ও লক্ষ্যহীন পথে। দিনের পর দিন রাতের পর রাত তিনি অর্ধহারে অনাহারে কাটাতে লাগলেন। এ সময় আল বেরুনী জুরাজানের সুলতান কাবুসের সুনজরে পড়েন। সুলতান কাবুস ছিলেন বিদ্যুৎসাহী। জ্ঞানী ব্যক্তিদের তিনি খুব ভালবাসতেন ও সমাদর করতেন। তিনি ইতোপূর্বে আল বেরুনীর সুনাম শুনেছিলেন।সুলতান কাবুস তার প্রাসাদে আল বেরুনীর উন্নত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানে আল বেরুনীর ক্যাস্পিয়ান সাগরের নিকট গুরগান শহরে দেখা হয় বিশ্বের আরেক মহান মনীষী দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনার (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) সঙ্গে। যিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। আজও চিকিৎসাশাস্ত্রের কথা এলে তার নাম প্রথম দিকেই থাকবে।এখানের দিনগুলো আল বেরুনী সুখে কাটলেও যাদের আদর স্নেহ তিনি ২২টি বছর কাটিয়েছিলেন সেই আল ইরাক বংশীয় অভিভাবকদের কথা ক্ষণিকের জন্যেও ভুলতে পারেননি। এখানে অবস্থানকালে ১০০১-১০০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আসারুল বাকিয়া এবং তাজরী দুশ শুয়াত নামক দু’টি গ্রন্থ রচনা করেন। রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তিনি আসারুল বাকিয়া গ্রন্থটি সুলতান কাবুসের নামে উৎস্বর্গ করেন।
খাওয়ারিজমের সুলতান মামুন বিন মাহমুদ ছিলেন বিদ্যুৎসাহী এবং তিনি আল বেরুনীর জ্ঞানে ও গুণে মুগ্ধ ছিলেন। একসময় সুলতান মামুন এক পত্রে আল বেরুনীকে দেশে ফিরে আসার অনুরোধ জানান। তিনিও সুলতানের অনুরোধে ১০১১ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভূমি খাওয়ারিজমে ফিরে আসেন এবং সুলতানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আল বেরুনী সুলতান মামুন বিন মাহমুদের ইন্তেকালের পর তার ভ্রাতার পৃষ্ঠপোষকতাও লাভ করেন।রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার সাথে সাথে তিনি জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার কাজও চালিয়ে যেতে থাকেন। মানমন্দির নির্মাণ করে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণ কাজ চালান। এখানে তিনি ৫/৬ বছর অবস্থান করেছিলেন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন।
গজনীর দিগ্বিজয়ী সুলতান মাহমুদ জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের খুব সম্মান করতেন। তাঁর দরবারে সব সময় প্রায় ৪০০ জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি থাকতেন।শাহী দরবারে প্রায় প্রতিদিন দেশ বিদেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে সমকালীন জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্য চর্চা নিয়ে আলোচনা হত। সুলতান মাহমুদ খাওয়ারিজম অধিপতি সুলতান মামুনের দরবারস্থ জ্ঞানী ব্যক্তিদের গজনীতে পাঠানোর জন্যে একটি সম্মানজনক পরোক্ষ নির্দেশপত্র লিখে পাঠান। পত্র পাবার পর আল বেরুনী ১০১৬ খ্রিঃ গণিতবিদ আবু নাসের মানসুর ইবন আলি ও চিকিৎসক আবুল খায়ের আল-হুসায়ন ইবন বাবা আল-খাম্মার আল-বাগদাদদির সাথে গজনীতে সুলতান মাহমুদের শাহী দরবারে উপস্থিত হন। কিন্তু মামুনের দরবারের অন্যতম বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ইবনে সিনা এ প্রস্তাবকে অপমান ও আত্মমর্যাদাহানীকর আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেন এবং কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে খাওয়ারিজম ত্যাগ করেন। ফলে সুলতান মাহমুদ ইবনে সিনাকে না পেয়ে এবং ইবনে সিনার বিদ্রোহের অজুহাতে খাওয়ারিজম রাজ্য দখল করে নেন। আল বেরুনী সুলতান মাহমুদের একান্ত সঙ্গী হিসেবে ১০১৬ হতে ১০২০ খ্রিঃ পর্যন্ত গজনীতে অবস্থান করেন।এখানেই তার জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। গজনিতে অবস্থান করার সময় আল-বিরুনী পরিচিত হন বিখ্যাত পণ্ডিত আবুল খায়েরের সাথে। আবুল খায়েরের নিকট তিনি শিক্ষা নেন গ্রিক ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে।একদিন তিনি গাজনি শাহী দরবারে সম্ভবত রাজ জ্যোতির্বিদ হিসেবে অবস্থান করতে থাকেন। এসময় প্রখ্যাত দার্শনিক ও চিকিৎসাশাস্ত্রজ্ঞ ইবন সিনার সাথে তার পত্র বিনিময় হতো।
জাবির আল বেরুনী হল |
আমরা জানি,সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন এবং আল বেরুনী কয়েকবার সুলতানের সাথে ভারত এসেছিলেন। তিনি তৎকালীন ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের সমৃদ্ধি দেখে বিস্মিত হন। পরবর্তীতে রাজসমন নিয়ে ১০২০-১০৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভারতে অবস্থান করেন।গজনির সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ভারতে প্রায় ১০ বছর অবস্থান করে সংস্কৃত ভাষা শিখে হিন্দু ধর্ম, ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি, দেশাচার, সামাজিক প্রথা, রাতিনীতি, কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। আল বেরুনী ভারতীয় কিছু আঞ্চলিক ভাষায়ও জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তিনি সেখানকার জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে মিলিত হন এবং তাঁদের সঙ্গে ভূগোল, গণিত ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ মত বিনিময়ের মাধ্যমে সেখানকার জ্ঞান বিজ্ঞানসমৃদ্ধ গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন। আর ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি প্রায় এক যুগের অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা রচনা করেন তার বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ কিতাবুল হিন্দ।পুরো নাম কিতাব ফি তাহকিকে মালইল হিন্দে মিন মাকালাতুন মুকবুলাতুন ফিল-আকলিয়েও মারজুলাতুন। আল-বেরুনীর ভারততত্ত্ব নামে এটি বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। এই বইটি লেখার পটভূমি সম্পর্কে জানা যায়-"বর্বর জাতির ইতিহাসে ক্ষীর সমুদ্র ও দধি সমুদ্র ছাড়া আর কী আছে?” ভারতবর্ষ ভ্রমণ শেষ করে আল-বেরুনী তখন তার নিজ দেশে ফিরেছেন। তার এক বন্ধুর সাথে ভারতবর্ষ, এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন বন্ধুর মুখ থেকে এমন মন্তব্য শোনার পর তার মনে ভাবোধয় হয়। মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণা তিনি চাইলেই ভাঙতে পারেন। কারণ তিনি ভারতবর্ষে শুধু বেড়াতেই আসেননি। এখানে এসেছেন জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে, এখানকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে। এবার তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতবর্ষ নিয়ে বই লিখবেন। তিনি এমন এক বই লিখলেন যেটি ভারতবাসীর জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে আছে। Kitab-ul-Hind was a voluminous text written in simple and lucid language, divided into 80 chapters on subjects such as religion and philosophy, festivals, astronomy, alchemy, manners and customs, social life, weights and measures, iconography, laws and metrology.তৎকালীন সময়ের ভারতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মীয় অনুশাসন জানার জন্যে এটি একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। অধ্যাপক হামারনেহের লিখেছেন,As a result of his profound and intimate knowledge of the country and its people, the author lett us in his writing the wealth of information of undying interest on civilization in the sub-continent during the first half at the eleventh century.বইটির গুরুত্ব সম্বন্ধে বলা হয়- Kitab al Hind by Al Baruni is important because it provides us detailed information about the Indian life, various religions, languages spoken in India, different cultures followed in India and it also includes many observations on geography. এ গ্রন্থখানি হিন্দু সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনধারা সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। আল-বেরুনীর রচনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি অত্যন্ত উদারতার সঙ্গে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতীয় হিন্দু সমাজের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটির চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি তার বর্ণনায় হিন্দুদের প্রতি যেমন বিজাতীয় বিদ্বেষ পোষণ করেননি, তেমনি স্বজাতীয় মুসলমানদের প্রতিও অহেতুক উচ্ছ্বাস দেখাননি। AL-BIRUNI tried to explain the caste system by looking for parallels in other societies. He attempted to suggest that social divisions were not unique to India. The conception of social pollution ,intrinsic to the caste system was according to him contrary to the laws of nature.
আল বেরুনী ভারত থেকে গজনি প্রত্যাবর্তন করার কিছু দিন পর সুলতান মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেন। সুলতান মাহমুদের পর তার দুই ছেলের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে জয়ী হন মাসউদ।মাসউদ ১০৩০ খিস্টাব্দে সিংহাসন আরোহন করেন।তিনি ১০৩০-১০৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিংহাসনে ছিলেন। সুলতান মাসউদ আল-বিরুনিকে খুব সম্মান করতেন।এ সময়ে আল বেরুনী রচনা করেন তার আরেক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কানুনে মাসউদ। A Persian by birth, a rationalist in disposition, this contemporary of Avicenna and Alhazen not only studied history, philosophy, and geography in depth, but wrote one of the most comprehensive of Muslim astronomical treatises, the Qanun Al-Masu'di.( David C. Lindberg, Science in the Middle Ages, University of Chicago Press, p. 18)এ সুবিশাল গ্রন্থ’খানা সর্বমোট ১১ খণ্ডে সমাপ্ত। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গ্রন্থটিতে আলোচনা করা হয়। ১ম ও ২য় খণ্ডে আলোচনা করা হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে; ৩য় খণ্ডে ক্রিকোণমিতি; ৪র্থ খণ্ডে Spherical Astronomy; ৫ম খণ্ডে গ্রহ, দ্রাঘিমা, চন্দ্র সূর্যের মাপ; ৬ষ্ঠ খণ্ডে সূর্যের গতি; ৭ম খণ্ডে চন্দ্রের গতি; ৮ম খণ্ডে চন্দ্রের দৃশ্যমানতা ও গ্রহণ; ৯ম খণ্ডে স্থির নক্ষত্র; ১০ম খণ্ডে ৫টি গ্রহ নিয়ে এবং একাদশ খণ্ডে আলোচনা করা হয়েছে জ্যোতিষ বিজ্ঞান সম্পর্কে। এ অমূল্য গ্রন্থটি সুলতানের নামে নামকরণ করায় সুলতান মাসউদ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে আল বেরুনীকে এক উট বোঝায় বহু মূল্যবান রৌপ্য সামগ্রী উপহার হিসাবে পাঠান। কিন্তু সহজাত নির্লোভ এ মহান মনীষী উপহারে পুরো অর্থই রাজকোষে জমা দিয়ে দেন। মন্তব্য করেন, তার এত ধনসম্পদের কোনো প্রয়োজন নেই।
সোভিয়েত রাশিয়া্র ডাকটিকেট |
আল বেরুনী রচিত জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতার বহু ইতিহাস, মৃত্তিকা তত্ত্ব, সাগর তত্ত্ব এবং আকাশ তত্ত্ব মানবজাতির জন্য এক অনবদ্য অবদান। ইউরোপীয় পন্ডিতদের মতে বেরুনী নিজেই একটা বিশ্বকোষ। একজন ভাষাবিদ হিসেবেও তিনি ছিলেন বিখ্যাত। আরবী, ফারসী, সিরিয়া, গ্রীক, সংস্কৃত, হিব্রু প্রভৃতি ভাষার উপর ছিল তাঁর পন্ডিত্য। ত্রিকোণমিতিতে তিনি বহু তথ্য আবিষ্কার করেছেন। কোপার্নিকাস বলেছিলেন, পৃথিবীসহ গ্রহগুলো সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে অথচ কোপার্নিকাসের জন্মের ৪২৫ বছর পূর্বেই আল বেরুনী বলেছেন, “বৃত্তিক গতিতে পৃথিবী ঘুরে”। তিনি টলেমি ও ইয়াকুবের দশমিক অংকের গণনায় ভুল ধরে দিয়ে এর সঠিক ধারণা দেন। তিনিই সর্ব প্রথম প্রাকৃতিক ঝর্ণা এবং আর্টেসীয় কূপ এর রহস্য উদঘাটন করেছিলেন। জ্যোতিষ হিসেবেও তার প্রসিদ্ধি ছিল অত্যধিক। তিনি যেসব ভবিষ্যৎ বাণী করতেন সেগুলো সঠিক হত। তিনি শব্দের গতির সাথে আলোর গতির পার্থক্য নির্ণয় করেছিলেন। তিনি এরিস্টটলের ‘হেভেন’ গ্রন্থের ১০টি ভুল আবিষ্কার করেছিলেন। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের অনবদ্য সম্পর্কও তিনিই আবিষ্কার করেন। (Αl-Biruni was an astronomer, mathematician and philosopher, studying physics and natural sciences too. He was the first able to obtain a simple formula for measuring the Earth's radius. Moreover, he thought possible the Earth to revolve around the Sun and developed the idea the geological eras succeed one another)সূক্ষ্ম ও শুদ্ধ গণনায় আল বেরুনী একটি বিস্ময়কর পন্থা আবিষ্কার করেন যার বর্তমান নাম The Formuła of Intarpolation. যদিও পাশ্চাত্য পন্ডিতবর্গ এটিকে নিউটনের বলে প্রচার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন; কিন্তু ধ্রুব সত্য হলো এই যে, নিউটনের জন্মের ৫৯২ বছর পূর্বেই আল বেরুনী এটির আবিষ্কার, ব্যবহার বিধি নির্ধারণ এবং বিশুদ্ধ সাইন তালিকা প্রস্তুত করে রেখে ছিলেন। এরপর এ ফর্মুলা পূর্ণতা দান করে তিনি একটি টানজেন্ট তালিকাও তৈরি করেন। তিনিই এ সত্য আবিষ্কার করেন যে, বিভিন্ন প্রকার ফুলের পাপড়ি সংখ্যা হয় ৩, ৪, ৫, ৬ এবং ১৮ হবে কিন্তু কখনো ৭ বা ৯ হবে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তাঁর অবদান ছিল সর্বাধিক। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তিনি একটি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন, যে গ্রন্থে বহু রোগের ঔষধ তৈরির কলাকৌশল বর্ণিত রয়েছে। অধ্যাপক হামারনেহ বলেছেন, “শুধু মুসলিম জগতেই নয় পৃথিবীর সমস্ত সভ্য জগতের মধ্যে আল বেরুনীই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি খ্রিস্টপূর্বকাল থেকে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত ঔষধ তৈরী করার পদ্ধতি ও এর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন।”
ইউরোপীয় পন্ডিতদের মতে, আল-বেরুনী ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকোষ, তার প্রত্যেকটি গ্রন্থ ছিল জ্ঞানের আধার। ভারতীয় পন্ডিতরা আল-বিরুনিকে বলতেন জ্ঞানের সমুদ্র। বিজ্ঞানী আল বেরুনী বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন।কোনো অবস্থাতেই তার এসব অমূল্য গ্রন্থের পরিচয় কম কথায় দেয়া সম্ভব নয়।মৃত্যুর ১৩ বছর পূর্বে তিনি তাঁর রচিত গ্রন্থের যে তালিকা দিয়েছেন সে অনুযায়ী তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ১১৪টি। ১৩ বছরেও তিনি আরো বহু গ্রন্থ রচনা করেন।এর মধ্যে ১০৩টি গ্রন্থ সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ১০টি অসম্পূর্ণ গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে। আবু নাসের মানসুর ১২টি, আবু সাহল আ-মাসিহি ১২টি, আবু সাহল আল-মাসিহি ১২টি, আবু আলি আল-হাসন ইবন আলি আল-জিলি একটি পুস্তক তার নামে আরোপিত করে উল্লেখ করেছেন। ফলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৮টি। উপরিউক্ত রিসালায় রচনার পরে তিনি আরো কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য হতে প্রতীয়মান হয়, তার রচিত গ্রন্থের সর্বমোট সংখ্যা ১৮০টি। এগুলো তথ্য, তত্ত্ব ও পরিসরের দিকে হতে বিভিন্ন। কোনোটি পুস্তক, কোনোটি গবেষণামূলক সন্দর্ভ আবার কোনোটি বৃহদাকার গ্রন্থ, যাতে জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার বিধৃত ধারণ করা হয়েছে।আল ইয়াকুতির মতে তার বইয়ের তালিকা ৬০ পৃষ্ঠার। ।আরো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘কিতাবুত তাফহিম’। এটি ৫৩০ অধ্যায়ে বিভক্ত। এতে গণিত, জ্যামিতি ও বিশ্বের গঠন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর “ইফরাদুল ফা’ল ফিল আমরিল আযলাল” শীর্ষক গ্রন্থে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ছায়াপথ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ‘আল আছারুল বাকিয়া আলাল কুবানিল কালিয়া’-গ্রন্থটিতে পৃথিবীর প্রাচীন কালের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তার রচিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ-‘যিজে আব্বকন্দ (নভোম-ল ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত), ‘আলাল ফি যিজে খাওয়ারিজমি (যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে)। এইসব বিশাল আকৃতির শতাধিক গ্রন্থ এক ব্যক্তির পক্ষে রচনা করা কত যে দুঃসাধ্য ব্যাপার তা ভাবতেও অবাক লাগে।
আল বেরুনী ছিলেন সর্বকালের জ্ঞানী শ্রেষ্ঠদের শীর্ষ স্থানীয় এক মহাপুরুষ। তাঁর ও অন্যান্য মুসলিম বিজ্ঞানীদের মৌলিক আবিষ্কারের উপরই গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক বিজ্ঞান। আল বেরুনী আজ বেঁচে নেই; কিন্তু তাঁর নাম ভাস্বর হয়ে থাকবে উজ্জ্বল তারকার ন্যায়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। আল বেরুনী বিশ্বাস করতেন, আল্লাহ্ই সকল জ্ঞানের অধিকারী। এ মহান মনীষী ৬৩ বছর বয়সে গুরুতর রোগে আক্রান্ত হয়ে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়েন। কোন চিকিৎসাতেই তাঁকে আর সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ৪৪০ হিজরীর ২ রজব মোতাবেক ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর রোজ শুক্রবার ৭৫ বছর বয়সে আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল বেরুনী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পৃথিবীর পরিধি ও ব্যাসার্ধের উপর কাজ |
জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনি যে কত উচ্চস্তরে স্থান লাভ করেছিলেন, এ সম্বন্ধে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। সুলতান মাহমুদ একদিন তার বাগানে অবস্থিত ঘরের ছাদে বসে ছিলেন। সেখানে থাকা সেই মনীষীকে বললেন, সেই বাড়ির চারটি দরজার মধ্যে কোন দরজা দিয়ে সুলতান মাহমুদ বের হবেন, তা যেন সেই পণ্ডিত গুনে ঠিক করেন। তারপর পণ্ডিত যেন তার অভিমত একটি কাগজে লিখে সুলতান মাহমুদের কম্বলের নিচে রেখে যান। সেই পণ্ডিত অঙ্ক কষে বের করেন এই প্রশ্নের উত্তর। তা একটি কাগজে লিখে কম্বলের নিচে রেখে যান। এদিকে, সুলতান মাহমুদ একজন রাজমিস্ত্রীকে ডেকে নিয়ে আসেন। তাকে দিয়ে নতুন করে একটি দরজা বানান তিনি। তারপর বের হয়ে দ্রুত ছুটেন তার কম্বলের নিচের কাগজটি দেখতে। সেখানকার লেখা দেখে তাজ্জব বনে যান সুলতান মাহমুদ। লেখা রয়েছে-“আপনি পূর্ব দিকের দেয়াল কেটে একটি নতুন দরজা বানিয়ে সেটি দিয়ে বের হবেন। ”কাগজের লেখা পাঠ করে সুলতান রেগে গিয়ে ছাদ থেকে আল-বিরুনিকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ার জন্য আদেশ দিলেন। নিচে মশামাছি প্রতিরোধের জন্য জাল পাতা ছিল। সুলতানের আদেশ কার্যকর হওয়ার পর আল-বিরুনি সেই জালে আটকে গিয়ে মাটিতে আস্তে পড়ার ফলে বেশি আঘাত পেলেন না। সুলতান আল-বিরুনিকে আবার ডেকে আনলেন এবং তার চাকরের কাছ থেকে আল বিরুনির দৈনিক ভাগ্য গণনার ডায়েরিটা নিয়ে সুলতান দেখলেন, তাতে লিখা আছে "আমি আজ উঁচু জায়গা থেকে নিচে পড়ে গেলেও বিশেষ আঘাত পাব না"। এ দেখে সুলতান আরো রেগে গিয়ে আল-বিরুনিকে জেলে পাঠালেন। এর পর আল-বিরুনিকে কারগার থেকে মুক্তির সুপারিশ করতে কেউ সাহস পেলেন না। ছয় মাস পর সুলতানের মনমর্জি বুঝে প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাসান একদিন আল-বিরুনির প্রতি সুলতানের নেক নজর আকর্ষণ করলেন। সুলতান মাহমুদের এ কথা স্বরণই ছিল না। তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে মুক্তি দিলেন। তার নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নামকরণ করা হয়। আল-বেরুনির জীবনী নিয়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৪ সালে একটি মুভি তৈরি করে। ১৯৭৩ সালে আল বিরুনীর একটি কল্পিত ছবি দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ডাকটিকেট প্রকাশ করে।২০০৯ সালে ইরান সরকারের সহযোগিতায় ভিয়েনায় জাতি সঙ্ঘের অফিসের সামনে Scholars Pavilion নির্মাণ করা হয়।যেখানে ইবনে সিনা ,বেরুনী,আল রাজি ও ওমর খৈয়ামের ভাস্কর্য রয়েছে।
1. https://youtu.be/-9EP1mAhcnA
2.https://youtu.be/6mQ-3chi9zs
3.https://youtu.be/6XXCiHJOULQ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন