মুসলমানদের পিতা কয়জন ?

হযরত আদম (আ.)
হযরত আদম (আ.) একাধারে মানবজাতির পিতা, এ পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত খলিফা (প্রতিনিধি) এবং প্রথম নবী। সমগ্র মানবজাতির আদি পিতা হলেন হযরত আদম (আ.) । মানবজাতির বিস্তার তাঁর মাধ্যমেই হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম, বর্ণ ও মতে বিশ্বাসী লোকেরা তাঁর সন্তান।

হযরত নুহ (আ.)
মানবজাতির দ্বিতীয় আদি পিতা হলেন হযরত নুহ (আ.)নুহ (আ.)কে আবুল বাশার সানী বা দ্বিতীয় আদম বলা হয়। আদম (আ) থেকে নুহ (আ) পর্যন্ত দশ শতাব্দির ব্যবধান ছিল। যার শেষ দিকে মানবকূল শিরক ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল এবং তা বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ তাআলা নুহ (আ)কে তাদের মাঝে রাসুল রূপে প্রেরণ করেন। তিনি ৯৫০ বছরে দীর্ঘ বয়স লাভ করেছিলেন এবং সারা জীবন পথভোলা মানুষকে সুপথে আনার জন্য দাওয়াতি কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।কিন্তু তার স্ব-জাতি তাকে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে আল্লাহর গজব মহা প্লাবনে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।পরবরতীতে বেঁচে থাকা ঈমানদারদের মধ্য থেকে নতুন করে বংশ বিস্তার করে। এ জাতির ঘটনা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে এবং কুরআনের মাধ্যমে জগতবাসী জানতে পেরেছে। তার চারটি পুত্র ছিল। হাম, সাম, ইয়াফিস ও ইয়াম বা কেনান। প্রথম তিন জন নুহ (আ.) এর প্রতি ঈমান আনেন, শেষজন কাফের হয়ে মহা প্লাবনে ডুবে মারা যায়। (তাফসীরে কুরতুবী) মহাপ্লাবনের শেষে তার তিন পুত্র হাম, সাম, ও ইয়াফিস এর বংশধর বেঁচে ছিলেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, সূরা ছাফফাত-৭৭) ।আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি তার (হযরত নুহ (আ)) বংশধরগণকেই অবশিষ্ট রেখেছি।(সূরা ছাফ্ফাত-৭৭)। রাসূল (সা) বলেন, সাম আরব জাতির আদি পিতা, হাম আফ্রিকীয়দের আদি পিতা ও ইয়াফিস রোমকদের (গ্রীক) আদি পিতা। (আহমদ,হা- ১৯৯৮২)। ফলে ইহুদী খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্মের লোকেরা হযরত নুহ (আ) কে তাদের আদি পিতা হিসেবে মর্যাদা দিয়ে থাকে।
হযরত ইব্রাহিম (আ.)
পবিত্র কুরআনে হযরত ইব্রাহিম (আ) কে মুসলমান জাতির পিতা বলে আখ্যায়িত করা হয়। যেহেতু আমাদের ইসলাম ধর্ম হযরত ইব্রাহিম (আ) এর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত, তথা দ্বীনে ইব্রাহীমের সাথে ইসলামের পুরোপুরি মিল রয়েছে, তাই, হযরত ইব্রাহিম (আ) কে মুসলিম মিল্লাতের পিতা বলে সম্বোধন করা হয়।যেমন এরশাদ হচ্ছে-তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের দ্বীন, আল্লাহ্‌ তোমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন।(সূরা হজ্ব আয়াত-৭৮)।হযরত ইব্রাহিম (আ) এদিক দিয়ে সবার পিতা। কারণ, আল্লাহ্ তাআলা সমগ্র মানব জাতির জন্য হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে নেতা হিসাবে মনোনীত করেন। তিনি আনুগত্যের চরম পারাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, সুতরাং সমস্ত আনুগত্যকারীদের তিনি পিতা।তাছাড়া হযরত ইব্রাহিম (আ) এর সম্মান করা তেমনি অবশ্য কর্তব্য যেমনি সন্তান তার পিতার সম্মান করা একান্ত কর্তব্য। কারণ তিনি তাদের নবীর পিতা।মুসলিম জাতির পিতা বলার কারণ ক) মহান আল্লাহর ঘোষণা- আল্লাহ বলেন,....এই দ্বীন তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের দ্বীনের অনুরূপ। আল্লাহ এর আগে তোমাদের নামকরণ করেছেন- ‘মুসলিম’ এবং এই কিতাবেও তা করেছ।(সূরা হজ্ব আয়াত-৭৮)।খ) তিনি আমাদের জাতির নাম দিয়েছেন- হযরত ইব্রাহিম (আ)ই কুরআনের পূর্বে উম্মতে মুহাম্মদী এবং সমগ্র বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য মুসলিম’ নামকরণ করেছেন; যেমন, হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর এই দোয়া কুরআনে বর্ণিত আছে- (رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا) (সুরা আল-বাকারা- ১২৮)-কুরআনে মুমিনদের নামকরণ করা হয়েছে মুসলিম।ইসমাঈল (আ.)-কে আরব জাতির পিতা বলা হয়। তাঁর বংশধররা আরবসভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন তাঁর বংশধর। তিনি আমালিক ও জুরহুম গোত্রের লোকদের মধ্যে এবং ইয়ামান অধিবাসীদের দ্বীনের দাওয়াত দেন।
নবি মুহাম্মদ (সা.)
আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব (সা.)-এর মাধ্যমে নবি-রাসুলের ধারাক্রমের ইতি টানেন। তিনি ছিলেন ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর। মক্কার কোরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষের নবি। তাঁর পরে আর কোনো নবি আগমন করবেন না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন, তবে তিনি আল্লাহর রাসুল এবং সর্বশেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে অবগত।’(সুরা আহজাব, আয়াত-৪০)। নবী (সা) এর সাথে মুসলিমদের এবং মুসলিমদের সাথে নবি (সা) এর যে সম্পর্ক তা অন্যান্য সমস্ত মানবিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বের এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক। নবি ও মুমিনদের মধ্যে যে সম্পর্ক বিরাজিত, অন্য কোন আত্মীয়তা ও সম্পর্ক তার সাথে কোন দিক দিয়ে সামান্যতমও তুলনীয় নয়। নবি (সা) মুসলিমদের জন্য তাদের বাপমায়ের চাইতেও বেশী স্নেহশীল ও দয়ার্দ্র হৃদয় এবং তাদের নিজেদের চাইতেও কল্যাণকামী। তাদের বাপ-মা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা তাদের ক্ষতি করতে পারে, তাদের সাথে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করতে পারে, তাদেরকে জাহান্নামে ঠেলে দিতে পারে, কিন্তু নবি (সা) তাদের পক্ষে কেবলমাত্র এমন কাজই করতে পারেন যাতে তাদের সত্যিকার সাফল্য অর্জিত হয়। তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করতে পারে।কিন্তু নবি (সা) তাদের জন্য তাই করবেন যা তাদের জন্য লাভজনক হয়। আসল ব্যাপার যখন এই মুসলিমদের ওপরও নবি (সা) এর এ অধিকার আছে তখন তারা তাকে নিজেদের বাপ-মা ও সন্তানদের এবং নিজেদের প্রাণের চেয়েও বেশী প্রিয় মনে করবে। দুনিয়ার সকল জিনিসের চেয়ে তাকে বেশী ভালোবাসবে। নিজেদের মতামতের ওপর তার মতামতকে এবং নিজেদের ফায়সালার ওপর তার ফায়সালাকে প্রাধান্য দেবে। তার প্রত্যেকটি হুকুমের সামনে মাথা নত করে দেবে। তাই হাদীসে এসেছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ (পূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান এবং অন্যান্য সকল মানুষ থেকে প্রিয়তম হব।’ (বুখারী ও মুসলিম)। রাসুল (সা) উম্মত হিসেবে নবি আমাদের রূহানী পিতা আর তার সম্মানিতা স্ত্রীগণ মুমিনদের আম্মাজান।কুরআনে এরশাদ হয়েছে,নবি মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা। (সুরা আহযাব-৬)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য, তোমাদেরকে আমি দ্বীন শিক্ষা দিয়ে থাকি। সুনান আবু দাউদ, হাদীস-৮)। সামন্য গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, রাসূল (সা.) এর সাথে মুমিনের আত্মীয়তার সম্পর্ক অন্যদের চেয়ে বেশি। কেননা অন্যদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক জিসমানী বা শারীরিক আর রাসূলের সাথে রুহানি বা আত্মিক। আত্মাহীন দেহ মূল্যহীন।
জন্মদাতা পিতা-
জন্মদাতা বা যার ঔরসে বা যার বীর্যে জন্মলাভ করেছি সে হলো জন্মদাতা পিতা। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে উফ্ (বিরক্তিসূচক ও অবজ্ঞামূলক কথা) বলবে না এবং তাদেরকে ধমক দেবে না; তাদের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে কথা বলবে। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার ডানা প্রসারিত করো এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৩-২৪)।

গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল