নফস ও কুরআনের দৃষ্টিতে নফসের তিনটি রূপ
১. নফসে আম্মারা (প্রতারক আত্মা)- যে নফস মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করে। এটির নাম নফসে আম্মারা।আল্লাহ তায়ালা বলেন, إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلاَّ مَا رَحِمَ رَبِّيَ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ নিশ্চয় মানুষের নফস মন্দ-কর্মপ্রবণ কিন্তু সে নয়-আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সুরা ইউসুফ আয়াত- ৫৩)।মিসরের আযীয-পত্নী কর্তৃক ইউসুফ (আ)-এর নির্দোষিতা ঘোষিত হয়েছে। আযীয-পত্নীর আত্মা অবশ্যই নফসে আম্মারা ছিল। নফসে আম্মারা হচ্ছে প্রতারক ও প্রলুব্ধকারী প্রবৃত্তি, এককথায় বলা যায় কুপ্রবৃত্তি। এই নফস ব্যক্তিকে এমনভাবে বশীভূত করে যে ব্যক্তির নিজের ওপর কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তার প্রবৃত্তি যা আদেশ করে তাই সে সম্পাদন করে, এর ওপর শয়তানের প্রবল প্রভাব বিরাজমান থাকে। ফলে এ নফস ব্যক্তিসত্তাকে সব ধরনের অন্যায়, অপকর্ম ও মন্দ পথের দিকে ধাবিত করে। সোজা কথায় নফসে আম্মারায় আবেষ্টিত ব্যক্তিসত্তার মধ্যে এমন একটা মনোভাব থাকে যে পাপ আবার কী? নফসে আম্মারাধারী ব্যক্তি মৃত্যুর পর যে পুনরুত্থিত হয়ে শেষ বিচারের মুখোমুখি হতে হবে, তা যেন সম্পূর্ণ ভুলে থাকে।
২. নফসে লাউয়ামাহ (অনুশোচনাকারী আত্মা) -যে নফস ভুল বা অন্যায় কাজ করলে অথবা ভুল বা অন্যায় বিষয়ে চিন্তা করলে কিংবা খারাপ নিয়ত রাখলে লজ্জিত হয় এবং সেজন্য মানুষকে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করে। এটির নাম নফসে লাউয়ামাহ। এই নফস কিঞ্চিৎ পবিত্র। এর ভালো-মন্দ বোধশক্তি থাকে।আল্লাহ তায়ালা বলেন,وَلَا أُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ আরও শপথ করি সেই নফসের যে নিজেকে ধিক্কার দেয়। (সুরা কিয়ামাহ আয়াত-২)।লাউয়ামাহ শব্দটি لوم থেকে উদ্ভুত। অর্থ তিরস্কার ও ধিক্কার দেয়া। নাফসে লাউয়ামাহ বলে এমন নফস বোঝানো হয়েছে, যে নিজের কাজকর্মের হিসাব নিয়ে নিজেকে ধিক্কার দেয়। অর্থাৎ কৃত গোনাহ অথবা ওয়াজিব কর্মে ত্রুটির কারণে নিজেকে ভর্ৎসনা করে বলে যে, তুই এমন করলি কেন? সৎকর্ম সম্পর্কেও নিজেকে এই বলে তিরস্কার করে যে, আরও বেশী সৎকাজ সম্পাদন করে উচ্চমর্যাদা লাভ করলে না কেন? সারকথা, কামেল মুমিন ব্যক্তি সর্বদাই তার প্রত্যেক সৎ ও অসৎ কাজের জন্যে নিজেকে তিরস্কারই করে। গোনাহ অথবা ওয়াজিব কর্মে ত্রুটির কারণে তিরস্কার করার হেতু স্পষ্ট। সৎকাজে তিরস্কার করার কারণ এই যে, নফস ইচ্ছা করলে আরও বেশী সৎকাজ করতে পারত। সে বেশী সৎকাজ করল না কেন? তাফসিরে মারেফুল কোরআনে নফসে লাউয়ামাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, নফসে লাউয়ামাহ এমন একটি নফস, যে নিজের কাজকর্মের হিসাব নিয়ে নিজেকে ধিক্কার দেয়। অর্থাৎ কৃত গুণাহ অথবা ওয়াজিব কর্মে ত্রুটির কারণে নিজেকে ভৎসনা করে। সৎকর্ম সম্পর্কেও নিজেকে এই বলে তিরস্কার করে যে, আরও বেশী সৎকাজ সম্পাদন করে উচ্চমর্যাদা লাভ করলে না কেনো? হযরত হাসান বসরি (রাহ.) নফসে লাউয়ামাহ- এর তাফসির করেছেন, নফসে মুমিনা। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! মুমিন তো নিজেকে সর্বদা সর্বাবস্থায় ধিক্কায় দেয়। সৎকর্মসমূহেও সে আল্লাহর শানের মোকাবেলায় আপন কর্মে অভাব ও ত্রুটি অনুভব করে। কেননা আল্লাহর হক পুরোপুরি আদায় করা সাধ্যাতীত ব্যাপার। ফলে তার দৃষ্টিতে ত্রুটি থাকে এবং তার জন্যে নিজেকে ধিক্কার দেয়।সাধারণত নাফসে আম্মারা বা খারাপ কাজে উদগ্ৰীবকারী আত্মা প্রতিটি মানুষেরই মজ্জগত ও স্বভাবগত। সে মানুষকে মন্দ কাজে লিপ্ত হতে জোরদার আদেশ করে। কিন্তু ঈমান, সৎকর্ম ও সাধনার বলে সে নফসে-লাওয়ামা হয়ে যায় এবং মন্দ কাজ ও ত্রুটির কারণে অনুতপ্ত হতে শুরু করে। এটাকেই অনেকে বিবেক বলে। কিন্তু মন্দ কাজ থেকে সে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয় না। অতঃপর সৎকর্মে উন্নতি ও আল্লাহর নৈকট্যলাভে চেষ্টা করতে করতে যখন শরীয়তের আদেশ-নিষেধ প্রতিপালন তার মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে যায় এবং শরীয়তবিরোধী কাজের প্রতি স্বভাবগত ঘৃণা অনুভব করতে থাকে, তখন এই নফসই মুতমায়িন্নাহ বা সন্তুষ্টচিত্ত উপাধি প্ৰাপ্ত হয়। নফসে লাউয়ামাহ দুই প্রকার- ক) নফসে লাউয়ামে মালুমাহ,খ) লাউয়ামে গায়রে মালুরে মালুমাহ।
৩. নফসে মুতমাইন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা) -যে ‘নফস’ সঠিক পথে চললে এবং ভুল ও অন্যায়ের পথ পরিত্যাগ করলে তৃপ্তি ও প্রশান্তি অনুভব করে তাকে বলে নফসে মুতমাইন্নাহ। নফসে মুতমাইন্না’ সেই নফস, যার মধ্যে পবিত্রতার সুরভি আছে এবং নুরানি তেজ আছে। এটাই হচ্ছে আলোকিত নফস। এ নফস সব সময় নেক কাজ ও কল্যাণের দিকে মানুষকে ধাবিত করে। মন্দ ও অকল্যাণ এ নফসের কাছ ঘেঁষা হতে পারে না। এটাই হচ্ছে প্রশান্ত এবং জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে এক অনন্য শান্ত প্রবৃত্তি। হাক্কানি পীর-আওলিয়ারা সাধারণত এই নফসে উন্নীত হন।আল্লাহ তায়ালা বলেন,يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً (হে প্রশান্ত মন,তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।) (সুরা ফাজর আয়াত-২৭, ২৮)।আর অবশ্যই আল্লাহ তা'আলা যারা খেয়ানত করে তাদের চক্রান্ত সফল হতে দেন না। আর আমি আমার নিজ আত্মাকে নির্দোষ বলছি না। আত্মা তো খারাপ কাজের নির্দেশই দেয়, অবশ্য যাদেরকে আল্লাহ করুনা করেছেন, তাদের কথা ভিন্ন। নিঃসন্দেহে আমার রব অতীব ক্ষমাশীল, দয়াময়।” এ তিনটি আয়াতই মিসরের আযীয-পত্নী বলেছিল। ইউসুফ (আ) এর আত্মা নফসে আম্মারা বা খারাপ কাজের আদেশদানকারী আত্মা নয়। এ ব্যাপারে সত্যাম্বেষী আলেমগণ সবাই একমত। এ ধরনের নাফস যাদের অর্জিত হয় তারা দ্বীনী ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ বা প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে মুক্ত হয়ে ‘কালবে সালীম’ বা সুস্থ হৃদয়ের অধিকারী হয়। আর এ সমস্ত লোকদের প্রশংসায় আল্লাহ্ তা'আলা অন্য আয়াতে বলেছেন, “যে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না, সে দিন উপকৃত হবে শুধু সে, যে আল্লাহর কাছে আসবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে।”(সূরা আশ-শু'আরা আয়াত ৮৮–৮৯)।
ইলমে তাসাওউফে নফসকে অবস্থাভেদে নফসে আম্মারা, নফসে লাউয়ামাহ, ‘নফসে মুতমাইন্না’ছাড়াও ‘নফসে মুলহিমা’ এই চারটি ভাগে বিভক্ত করা করেছে।৪. নফসে মুতমাইন্নায়- নফসে মুতমাইন্নায় উন্নীত নফস যখন পুণ্যে প্রেরণাদায়ক ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হয় তখন আল্লাহ তাআলার গোপন ভেদ ও আদেশ তার ওপর প্রতিফলিত হয়, সে ইলহাম বা প্রত্যাদেশ লাভে ধন্য হয়। এই নফসকেই বলা হয় নফসে মুলহিমা। নফস মূলত একটি যা পরিবর্তিত হয়ে যে কোনো একটি রূপ ধারণ করে।কেউ কেউ নফস ও রুহকে আলাদা করে দেখেছেন।
গ্রন্থনায়- মো. আবু রায়হান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন