জীব জন্তুরা মুসলমানদের বন ছেড়ে দিয়েছিল
মো.আবু রায়হান:আরব উপদ্বীপের বাইরে,আফ্রিকা মহাদেশ প্রথম যেখানে ইসলাম ৭ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এই মহাদেশে বাস করে। ২০০২ সালের হিসাব অনুসারে, আফ্রিকার মোট জনসংখ্যার ৪৫% মুসলিম।উত্তর আফ্রিকায় ইসলামের একটি বড় উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়াও হর্ন অব আফ্রিকা (ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, জিবুতি,সোমালিয়া) সোয়াহিলি কোস্ট ও অনেকাংশ পশ্চিম আফ্রিকা ইসলাম আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যালঘু কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে।মুসলমানদের প্রথম হিজরত ছিল আফ্রিকার আবিসিনিয়ায়(বর্তমানের ইথিওপিয়ায়)।বর্তমানের জিবুতি, সোমালিয়া ও ইরিত্রিয়া অতিক্রম করে হিজরতের সময় মুসলমানেরা ইথিওপিয়ায় আশ্রয় নেয়।Following the conquest of North Africa by Muslim Arabs in the 7th century CE, Islam spread throughout West Africa via merchants, traders, scholars, and missionaries, that is largely through peaceful means whereby African rulers either tolerated the religion or converted to it themselves. In this way, Islam spread across and around the Sahara Desert.আফ্রিকার অধিকাংশ মুসলমান সুন্নি। সেখানে ইসলামের জটিলতা চিন্তার বিভিন্ন ধারা, ঐতিহ্য, এবং অনেক আফ্রিকান দেশের মত দ্বারা উন্মোচিত হয়। আফ্রিকান ইসলাম স্থবির নয় এবং ক্রমাগত প্রচলিত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার দ্বারা রূপায়িত হচ্ছে। সাধারণত আফ্রিকায় ইসলাম প্রায়ই আফ্রিকার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে অভিযোজিত হয়।
আফ্রিকায় ইসলামের আগমন ঘটে কয়েকটি পর্যায়ে- উল্লেখ্য আরবগণ নীলনদের নিম্ন উপত্যকায় অবস্থিত মিসর, আধুনিক লিবিয়া ও তিউনিসিয়াকে ইফরিকিয়া এবং আধুনিক আলজিরিয়া, লিবিয়া তিউনিসিয়া ও মরক্কো অঞ্চলকে আল-মাগরেব নামে অভিহিত করতেন। হযরত ওমর (রা.)-এর মুসলিম বাহিনী সর্বপ্রথম মিসর জয় করে ইফরিকিয়া অঞ্চলে প্রবেশ করে।হযরত উসমান (রা.)-এর খেলাফতের সময় সৈন্যগণ বার্কা পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং প্রাচীন কার্থেজের অনতিদূরে বাইজানটাইন শাসক গ্রেগরিয়াসকে পরাজিত করে উত্তর আফ্রিকা দখল করে নেয়। রোমকগণ বার্ষিক কর আদায় করতে সম্মত হলে মুসলিমগণ জাবিলা ও বার্কা ঘাটিতে ক্ষুদ্র সৈন্যদল রেখে দেশে ফিরে আসে। হযরত আমীর মোয়াবিয়া (রা.)-এর শাসন আমলে তিনি সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রকে দশটি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন এবং প্রত্যেক প্রদেশের জন্য পৃথক পৃথক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। মিসর ও উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা ছিলেন যথাক্রমে হযরত আমর ইবনে আস ও হযরত উকবা বিন নাফে।Islam first came to Africa with Muslim refugees fleeing persecution in the Arab peninsula. This was followed by a military invasion, some seven years after the death of the prophet Mohammed in 639, under the command of the Muslim Arab General, Amr ibn al-Asi. হযরত ওসমানের সময় দখল করা পরিত্যাক্ত অঞ্চলগুলো রোমকগণ পুনর্দখল করে নেয় এবং সেখানে তাদের অত্যাচারে স্থানীয় বার্কার অধিবাসীগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। তারা পার্শ্ববর্তী মিসরের শাসনকর্তা আমর ইবনে আসের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। আমর ইবনে আস হযরত আমীর মোয়াবিয়া (রা.) কে এই ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন। এই খবর পেয়ে আমীর মোয়াবিয়া (রা.) তাঁর বিশিষ্ট সেনাপতি হযরত উকবা বিন নাফের নেতৃত্বে ১০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী আফ্রিকার দিকে প্রেরণ করেন। এই বাহিনী সকল প্রতিবন্ধকতার অপসারণ করে এই দেশ আরবদের করতলগত করেন। তিনি হিজরী ৫২ সালে হযরত আমীর মোয়াবিয়া (রা.) কর্তৃক আফ্রিকার গভর্ণর নিযুক্ত হন। আমর ইবনে আস মিসর বিজেতা হলে উকবা বিন নাফে হলেন আফ্রিকা বিজেতা ।
উকবা বিন নাফে নির্মিত মসজিদ |
উকবা বিন নাফে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় মুসলিম সেনাপতি।তিনি হিজরতের এক বছর আগে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার নাম নাফে ইবনে কায়েস। উকবা ছিলেন হযরত আমর ইবনুল আস (রা.) এর ভাগ্নে।তিনি উমাইয়া খলিফা প্রথম মুয়াবিয়া ও প্রথম ইয়াজিদের শাসনামলে সেনাপতি ছিলেন। উকবা বিন নাফে মুসলিমদের উত্তর আফ্রিকা বিজয়ের সূচনা করেন। কুরাইশ বংশের বনু ফিহরি শাখার সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে তাকে অনেক সময় আল-ফিহরি পদবী দ্বারা সম্বোধন করা হয়। তার বংশধরদেরকে উকবি বা ফিহরি বলা হত। হযরত উকবা বিন নাফে ফিহরি ছিলেন একজন কুরাইশ বংশীয় তাবেঈ। কেউ কেউ তাকে সাহাবি বলেছেন।তিনি মুসলিম বিশ্বের আলেকজান্ডার হিসেবে খ্যাত।
হিজরী ৫০ সালে ওকবা দুঃসাহসী বার্বারদের দমন ও সমুদ্র পথে রোমকদের অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য কায়রোওয়ান নামক স্থানে এক বিরাট সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করেন। যে সকল রোমক মরক্কো দখল করে রেখেছিল, তারা বার্বারদের সাহায্যার্থে উত্তর আফ্রিকার উপর আক্রমণ চালাত। এসকল হানাদারকে সময়োচিত শিক্ষাদানের জন্য হযরত উকবা বিন নাফে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কোন বাঁধা ছাড়াই তিনি অরক্ষিত একটি শহর দখল করে নেন। শহরবাসী তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে। অতঃপর তিনি রোমক অধিকৃত আরও কতিপয় এলাকা দখল করে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে গিয়ে উপনীত হন।
এই বিশাল সমুদ্র হযরত উকবার বিজয় যাত্রার পথে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সমুদ্রের তীরে পদার্পণ করে তিনি খুবই নিরাশ হলেন। গতিপথে তিনি সমুদ্রের এই প্রতিবন্ধকতাকেও তুচ্ছ মনে করলেন। সেনাপতি উকবা তাঁর ঘোড়া আটলান্টিক মহাসাগরে নামিয়ে দিলেন এবং পানি যখন তাঁর গলায় গলায় পৌঁছে, তখন তিনি সমুদ্র থেকে প্রত্যাবর্তন করে সমুদ্রের তীরে অবতরণ করেন। এই সময় তিনি অত্যন্ত নিরাশ হয়ে পড়েন। আল্লাহর দরবারে হাত তুলে মোনাজাত করেন- ‘ইয়ারাব্বি, লাওলা হাজাল বাহ্রু লামাশতু ফিল- বালাদি মোজাহেদান ফিসাবিলিকা’। অর্থাৎ হে রব, আমার সামনে যদি সাগর না থাকতো তাহলে আমি তোমার পথে তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য যুদ্ধ করতে করতে বিজয়ী বেশে এই দেশের প্রান্ত সীমায় উপনীত হয়ে যেতাম। (O Lord be Thou witness, that I have taken Thy Message up to the end of the land and if this ocean were not in my way I would have proceeded to fight the pagans until none would be worshipped except Thee.”) এই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘দশত তু দশত হেঁ, দরিয়াভী নাছোড়ে হামনে, বাহরে জুলমাত মে, দৌড়াদিয়ে ঘোড়ে হামনে।’হযরত ওকবার এই সাফল্যজনক সামরিক অভিযান ও বার্বারদের শোচনীয় পরাজয়ের পর সেখানে তিনি কায়রোয়ান শহর প্রতিষ্ঠা করে তাকে আফ্রিকার রাজধানী করেন। ʿUqbah founded the town of Kairouan, which became the first centre of Arab administration in the Maghrib.তাছাড়া সেখানে তিনি একটি জামে মসজিদও কায়েম করেন। As the first step Uqba laid the foundation of a grand mosque, which became a center for scholars and the first Muslim institute on the continent. The mosque is known as the Mosque of Uqba in Kairouan or the grand mosque of Kairouan.
আফ্রিকার বার্বার জাতি বীরত্বের সাথে লড়লেও অবশেষে পরাজয় বরণ করে। তাদের নিয়ম ছিল পরাজিত হবার সাথে সাথে বিজয়ী শক্তির কাছে আনুগত্য স্বীকার করে নিতো, এমনকি ইসলামও গ্রহণ করতো। মুসলিম বাহিনী প্রস্থান করা মাত্র তারা আবার বিদ্রোহ করতো এবং মুরতাদ হয়ে যেত। এ কারণে হযরত উকবা সে এলাকায় স্থায়ীভাবে সেখানে সেনা অবস্থানের ব্যবস্থা করেন এবং একটি নতুন শহর গড়ে তোলেন এবং কায়রোয়ান শহরেরও ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।স্থানটি ছিল গহীন জঙ্গলে পরিপূর্ণ সর্বপ্রকারের ক্ষতিকর, বিষাক্ত, হিংস্র জীবজন্তু এবং কীট-পতঙ্গে ভরা। জীবিত হিংস্র সিংহ-বাঘ ইত্যাদি চতুষ্পদ এবং সাপ-অজগর বিচ্চুর বিচরণ ক্ষেত্র এ ভয়ানক ভীতিকর স্থানে মানুষের চলাচল ছিল না, প্রাণের ভয়ে তারা সেখান থেকে দূরে অবস্থান করতো। হযরত উকবা ছিলেন অত্যন্ত খোদাপ্রেমিক সাধক ব্যক্তিত্ব তিনি দোয়া করলে তা কবুল হতো। এ ভীতিকর স্থানে তিনি অতি বিনয়ের সাথে এসব হিংস্র জীবজন্তু, কীট-পতঙ্গ দূর করে দেয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, ‘আইয়্যুহাল হিয়াদা ওয়াস-সিবা! ইন্না আস্হাবু রাসূলুলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ইরহালুআল্লা, ফা ইন্না নাজেলুন। ওয়া মান-ওয়াজ নাহু বা’দা জালিকা কাতাল্লাহু। অর্থাৎ এই অরণ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিচরণকারী হিংস্র হে জন্তুকূল, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (স.) এর সাহাবা, তোমরা আমাদের কাছ থেকে দূরে চলে যাও। আমরা এখানে অবতরণ করবো। এ ঘোষণার পর যাকে এখানে আমরা পাবো তাকে হত্যা করবো। বার্বার জাতি এ ঘোষণা শুনে হাসাহাসি করতে থাকে ।
কিন্ত হযরত উকবা এর মর্মস্পর্শী ঘোষণা বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সকল চতুষ্পদ জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ, সাপ-অজগর প্রভৃতি তাদের বাচ্চা-ছা পোনা সকলকে নিজ নিজ কাঁধে উঠিয়ে সাপের সারিতে সাপ,সিংহ এর সারিতে সিংহ প্রস্থান করতে থাকে এবং তাদের বিচরণের জায়গা খালি করতে থাকে। এবং সাপ-বিচ্চুসহ সকল বিষাক্ত জীব-কীট-পতঙ্গ মুহুর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।এ এক অদ্ভুত অভাবনীয় দৃশ্য। সেনাপতি হযরত উকবা-এর দোয়া এইভাবে কবুল হতে দেখে সেখানকার বার্বার জাতি সহ সকলেই বিস্মিত। এ অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করে অধিকাংশ বার্বার জাতি স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সাগ্রহে ইসলাম গ্রহণ করে।এ বার্বার জাতি অরণ্য কাটতে, পরিষ্কার করতে এবং শহর নির্মাণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পরিণতিতে জামে মসজিদ ও হাজার হাজার বসতবাড়ী নির্মিত হয়ে যায়। শহর নির্মাণকালেও হযরত উকবা এখানে সেখানে তাঁর বাহিনী প্রেরণ করতে থাকেন এবং শত্রুদের শক্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে থাকেন। কায়রোয়ান শহর নির্মিত হয়ে যাওয়ার ফলে আফ্রিকায় মুসলমানদের স্থায়ী সেনানিবাস স্থাপিত হয়ে যায়। বর্তমান তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস থেকে ১৬০কিমি দক্ষিণে কায়রোয়ান শহর।এই শহর পরবর্তীতে তার সামরিক কর্মকাণ্ডের ঘাটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।আফ্রিকার ভয়ঙ্কর অরণ্যের হিংস্র জীব-জন্তু ও অধিবাসীরা হযরত উকবা্র ঈমানী শক্তির ডাকে সাড়া দিয়ে জঙ্গল খালি করে সেখান থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও বিস্ময়কর বটে।কিন্তু বিজিত এলাকাগুলো সুসংহত করার পর রোমক ও বার্বারগণ কায়রোয়ান শহরে যৌথ আক্রমণ চালায়। রাজধানী কায়রোয়ানের একজন বার্বারনেতা কোসাইলা মুসলমান হয়েছিল। হযরত ওকবার (রা.)-এর সাথে তিনি বিভিন্ন জেহাদেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কোসাইলা মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও মোনাফেকি করে রোমকদের সাথে মিলে যান এবং অতর্কিত মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালান। তারা সদর মোকাম ঘিরে ফেলে। হযরত উকবা মুসলিম বাহিনীকে নির্দেশ দেন, ‘মৃত্যু অথবা বিজয় এই দুইয়ের মধ্যে তোমাদেরকে একটি বেছে নিতে হবে, কেউ পশ্চাদপসরণ করতে পারবে না।’ এই বলে তিনি শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেন। মাত্র কয়েকজন মুসলমান ব্যতীত তাঁর প্রায় সকল সঙ্গীকেই এই যুদ্ধে প্রাণ হারাতে হয়। অতঃপর কায়রোয়ান আবার বার্বারদের দখলে চলে যায়। এটি ৬৮২ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। এর মাত্র সাত বছর পর আফ্রিকা আবার আরবদের দখলে চলে আসে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন