হযরত সুলাইমান ও সাবা রাণী বিলকিস





ইয়ামেন তথা সাবা রাজ্যের রাণী ছিলেন বিলকিস। তার পুরো নাম বিলকিস বিনতুস সারাহ বিন হাদাহিদ বিন শারাহীল।
সাবা জাতির এ সমাজ্ঞীর নাম কোন কোন বর্ণনায় বিলকীস বিনত শারাহীল বলা হয়েছে। (ইবন কাসীর)।রানি বিলকিসের পূর্বপুরুষরা ইয়েমেনের সাবা অঞ্চল শাসন করতেন। সাবা এক ব্যক্তির নাম, যা পরে এক জাতি ও এক শহরের নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইয়ামানের সানা্র উত্তরপূর্বে ৫৫ কিমি. । যা এখন মারাবুল ইয়ামান নামে প্রসিদ্ধ। (ফতহুল কাদীর)।গ্রহণযোগ্য মতানুসারে বিলকিস ছিলেন জি-শারাহর কন্যা। যদিও কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন, তাঁর পিতার নাম ইলি-শারাহ।তিনি ছিলেন সাম বিন নূহ (আ.)-এর ১৮তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর ঊর্ধ্বতন ৯ম পিতামহের নাম ছিল সাবা। সম্ভবত তাঁর নামেই সাবা সাম্রাজ্যের নামকরণ হয়। দুনিয়াবী দিক দিয়ে এই সাবা সাম্রাজ্য খুবই সমৃদ্ধ এবং শান-শওকতে পরিপূর্ণ ছিল।আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমান ইয়েমেনই হচ্ছে দক্ষিন আরবের রাজ্য সাবা। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন সাবা নামক রাজ্যটি আসলে পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া। রাজ্যেটির সঠিক সীমা নিয়ে বিতর্ক আছে বহুকাল ধরে। ইথিওপিয়ায় ছিল সাবা, আরবরা সাবা রানীকে বিলকিস আর ইথিওপিয়ানরা মাকেদা বলে সম্বোধন করে থাকে। রানি বিলকিস সাবার রানি হওয়ার পর নারী হওয়ার কারণে গোত্রের লোকেরা তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।ভারতীয় ঊপমহাদেশে আমির ওমরা যেমন সুলতানা রাজিয়ার ক্ষমতায় আরোহণ মেনে নিতে পারেনি তেমন।তারা মেনে নিতে পারছিল না, একজন নারী তাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে। ফলে তারা বিলকিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল এবং ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটাল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রানি তাঁর ভাইকে নিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে যান এবং জাফর ইবনে কুরত আল আসাদির আশ্রয় নেন।কিন্তু রাজ্য উদ্ধারের জন্য বিলকিস অভিনব এক কৌশল অবলম্বন করেন। তা হলো তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ আমরের কাছে গেলেন, বিলকিস পালিয়ে আসার পর যিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। আমর রানির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেন এবং তাঁকে জীবনসঙ্গী করতে প্রলুব্ধ হলেন। রানিকে একত্রে মদপানের আমন্ত্রণ জানালেন। বিলকিস তাতে সাড়া দেন। আমর মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে বিলকিস তাঁকে হত্যা করেন। কিন্তু আমরের লাশ লুকিয়ে রেখে তিনি রাজদরবারে যান এবং বলেন, ‘রাজা আমাকে বিয়ে করেছেন। তিনি সব শ্রেণির নাগরিককে একটি স্থানে একত্র হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ যখন মানুষ নির্ধারিত স্থানে একত্র হলো, বিলকিস  বললেন, ‘আমি রাজার স্ত্রী। তোমরা জানো তাঁর সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই তিনি আমাকে উত্তরাধিকার নিযুক্ত করেছেন। তিনি আমাকে এ বিষয়ে তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছেন।’ লোকেরা বিলকিসের কথা বিশ্বাস করল এবং তাঁর হাতে বাইয়াত হলো। বাইয়াত শেষে তিনি জানালেন, রাজাকে খুন করা হয়েছে। কিন্তু আগেই তাঁর আনুগত্যের শপথ করায় তাদের কিছুই করার থাকল না। রাজত্ব স্থায়ী হওয়ার পর রানি বিলকিস সেনাবাহিনী পুনর্বিন্যাস করেন এবং একে একে হামির, ব্যাবিলন, নাহাউন্দা ও আজারবাইজান জয় করেন।মারাব বাঁধের পুনর্নির্মাণকে রানি বিলকিসের অন্যতম সাফল্য মনে করা হয়, দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় যা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কুরআনে বর্ণিত রাজপ্রাসাদ রানি বিলকিসের অমর কীর্তি, হযরত সুলাইমান (আ.) যার বিবরণ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রানি বিলকিসের ছিল একাধিক পুরুষ ও নারী দেহরক্ষী। এ ছাড়া তাঁর কাছে হামিরের ৩৬০ জন সম্মানিত নারী অবস্থান করতেন।
হুদহুদ পাখি
কুরআনে সুরা আল-নামল এ সুলাইমান (আ.) এবং সাবার রানী সম্পর্কে আয়াত আছে।যদিও কুরআনে কোনো নামে তাকে সম্বোধন করা হয়নি। সুরা আল-নামল এর ৩২ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে উঠে এসেছে সাবার রানী ও রাজা সুলাইমানের কাহিনী। নবি হিসেবে হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে আল্লাহ অসীম ক্ষমতা, জ্ঞান আর প্রজ্ঞার অধিকারী বানিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষ, জ্বীন এবং পাখি এই তিন প্রজাতি ছিল সুলাইমান (আঃ) এর সেনাবাহিনীর অংশ। সুলাইমান (আঃ) পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন। আল্লাহ হযরত সুলাইমান (আ.)-কে বিরল ক্ষমতার অধিকারী করেছিলেন। প্রবাহিত বাতাস পর্যন্ত তাঁর অনুগত ছিল। সাবা রানী নিজেও অত্যাধিক জ্ঞান, সম্পদ এবং ক্ষমতার অধিকারিণী ছিলেন। আরব ইতিহাসের কিংবদন্তি নারী রানি বিলকিস। কুরআনের বর্ণনা থেকেও তাঁর মেধা, বিচক্ষণতা ও ক্ষমতার প্রতাপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।তাঁর শাসনামলে ইয়েমেনের প্রভূত উন্নয়ন হয়। আর্থিক উন্নয়নের ফলে সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পরও তা দীর্ঘকাল পর্যন্ত টিকে ছিল।আল্লাহ তাদের সামনে জীবনোপকরণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং নবীগণের মাধ্যমে এসব নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রানী ছিলেন সূর্য-পূজারী আর রাজা সলোমন তওহি্দবাদি।সাবা বিলকিস সম্পর্কে হযরত সুলাইমানের কিছুই জানা ছিল না বলেই কুরআনের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয়। হুদহুদ পাখি তাদের সম্পর্কে হযরত সুলায়মানের নিকটে এসে প্রথম খবর দেয়।একদিন হযরত সুলাইমান (আ.) তাঁর অনুগত গোয়েন্দা পাখি হুদহুদকে অনুপস্থিত দেখলেন। এতে রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, যথাযথ কারণ দর্শাতে না পারলে হুদহুদ কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবে। কিছুক্ষণ পর হুদহুদ ফিরে এলো এবং রানি বিলকিসের রাজ্য, রাজত্ব, ক্ষমতা, প্রাসাদ ও সিংহাসন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল।তার বর্ণিত প্রতিবেদনটি ছিল কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ :
সে (হুদহুদ) দেরী না করে এসে পড়ল ও বলল, ‘আমি এমন সব তথ্য লাভ করেছি যা তোমাদের জানা নেই, আর সাবা থেকে সঠিক খবর নিয়ে এসেছি। আমি এক নারীকে দেখলাম সেই জাতির উপর রাজত্ব করছে। তাকে সবই দেয়া হয়েছে ও তার আছে এক বিরাট সিংহাসন। আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্য্যকে সিজদা করছে। শয়তান ওদের কাছে ওদের কাজকর্ম শোভন করেছে ও ওদের সৎপথ থেকে দূরে রেখেছে যেন ওরা সৎপথ না পায় এবং যিনি আকাশ ও পৃথিবীর গোপন বিষয়কে প্রকাশ করেন, যিনি জানেন যা তোমরা গোপন কর ও যা তোমরা প্রকাশ কর, সেই আল্লাহকে যেন ওরা সিজদা না করে। আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তিনিই মহা আরশের অধিপতি।’

সুলায়মান বলল, ‘আমি দেখব, তুমি সত্যি বলছ না মিথ্যে বলছ? তুমি আমার এ চিঠি নিয়ে যাও। এ তাদের কাছে দিয়ে এসো। তারপর তাদের কাছ থেকে সরে পড় ও দেখ তারা কি উত্তর দেয়।’-(সুরা নামল,২০-২৮)হুদহুদ বাদশা শলোমনের মোহরকৃত পত্র নিয়ে সাবার রাজপ্রসাদে পৌঁছিল। অতঃপর জানালা দিয়ে রানী বিলকিসের শয়নকক্ষে প্রবেশ করল। বিলকিস এ সময় নিদ্রামগ্ন ছিলেন। হুদহুদ পত্রখানা বিলকিসের বুকের উপর রেখে জানালার উপর অংশে বসে রইল এ জানার অপেক্ষায় যে, বাদশার আদেশ মত প্রাপককে তার পত্রখানা নিশ্চিত বুঝিয়ে দিতে পেরেছে।
একসময় ঘুম ভাঙ্গল বিলকিসের। তিনি একখানা মোহরকৃত পত্র তার বুকের উপর পড়ে থাকতে দেখতে পেলেন। বিষ্মিত হলেন তিনি। পত্র এল কোথা থেকে? তার অনুমতি ব্যতিত কারও তো কক্ষে প্রবেশ করার কথা নয়! তিনি উঠে বসে পত্রটি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন। অতঃপর কক্ষের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করলেন। এ সময় জানালার উপর বসে থাকা হুদ হুদের প্রতি দৃষ্টি পড়ল তার। পাখীটি তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এসময়ই জানালা দিয়ে পাখিটি উড়ে চলে গেল।
রানী বিলকিস মোহর খুলে পত্র পাঠে মনোনিবেশ করলেন। অতঃপর পাঠ শেষে তৎক্ষণাৎ এক জরুরী পরামর্শে তার পরিষদবর্গকে ডাকলেন তিনি। পরামর্শ সভায় তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘পরিষদবর্গ! আমাকে এক সম্মানিত পত্র দেয়া হয়েছে, সুলাইমানের  কাছ থেকে। আর তা এই-বিলকিস বলল, হে সভাসদ বর্গ! আমাকে একটি মহিমান্বিত পত্র দেওয়া হয়েছে’ (সরা নামল-২৯)। ‘সেই পত্র সুলায়মানের পক্ষ হতে এবং তা হল এই,করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে (শুরু করছি)’ (সুরা নামল -৩০)। ‘আমার মোকাবেলায় তোমরা শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার নিকটে উপস্থিত হও’ (সুরা নামল -৩১)। ‘বিলকিস বলল, হে আমার পারিষদ বর্গ! আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দিন। আপনাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না’ (সুরা নামল -৩২)। ‘তারা বলল, আমরা শক্তিশালী এবং কঠোর যোদ্ধা। এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। অতএব ভেবে দেখুন আপনি আমাদের কি আদেশ করবেন’ (সুরা নামল ৩৩)।‘রাণী বলল, রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে, তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত লোকদের অপদস্থ করে। তারাও এরূপ করবে’ (সুরা নামল -৩৪)। ‘অতএব আমি তাঁর নিকটে কিছু উপঢৌকন পাঠাই। দেখি, প্রেরিত লোকেরা কি জওয়াব নিয়ে আসে’ (সুরা নামল -৩৫)।
রানী বিলকিসের দূত নিজেদের মূল্যবান উপঢৌকনাদি সম্পর্কে গর্বিত ছিল। যখন তারা প্রাসাদ দ্বারে পৌঁছিল, তখন তারা দেখতে পেল প্রাসাদ থেকে নেমে আসা পথটি সম্পূর্ণ স্বর্ণ এবং রৌপ্যের স্কয়ার ব্লকসমূহ দ্বারা সুসজ্জ্বিত করে নির্মিত। এই পথের দু‘ধারে সাঁরিবদ্ধ ভাবে নিশ্চল দাঁড়িয়ে অলস সময় কাটাচ্ছে বিভিন্ন ধরণের পশু, যাদের কিছু মলমূত্র ত্যাগ করেছে ঐ সুসজ্জ্বিত পথের উপর। এসব দেখে তারা যেমন বিষ্মিত হল, তেমনি নিজেদের আনীত উপঢৌকনাদিকে নগণ্য মনে করে লজ্জিতও হয়ে পড়ল।
দূতেরা দরবারে প্রবেশ করল। সুলাইমান  তাদেরকে হাসিমুখে গ্রহণ করলেন। অতঃপর তারা তাদের উপঢৌকনাদি প্রদান করল। এই উপঢৌকনাদির মধ্যে ছিল কয়েক তাল স্বর্ণ, কিছু হীরা। আর ছিল একশত গোলাম ও একশত দাসী। এই সকল দাস-দাসীর নারীদেরকে পুরুষ বেশে এবং পুরুষদেরকে নারী বেশে সজ্জ্বিত করে আনয়ন করা হয়েছিল।সুলাইমান  উপঢৌকনাদি দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে দূতদেরকে বললেন, ‘তোমরা কি আমাকে ধন-সম্পদ দিয়ে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার চেয়ে উত্তম জিনিস দিয়েছেন আমাকে, অথচ তোমরা তোমাদের উপঢৌকন দিয়ে উৎফুল্ল বোধ করছ। তোমরা ফিরে যাও, আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে এমন এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হব যা রুখবার শক্তি ওদের নেই। আমি ওদেরকে সেখান থেকে অপমান করে বের করে দেব ও তাদেরকে দলিত করব।’
‘অতঃপর যখন দূত সুলাইমানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বলল, তোমরা কি ধন-সম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদের দেওয়া বস্ত্ত থেকে অনেক উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক’ (সুরা নামল -৩৬)। ‘ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী সহ আগমন করব, যার মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। আমরা অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কার করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত’ (সুরা নামল -৩৭)।
সাবার রাজদরবার। বাদশা শলোমন উপঢৌকনাদি ফেরৎ পাঠিয়েছেন। এ কারণে রানী বিলকিসের এই জরুরি অধিবেশন আহবান। বিলকিস দূতদের সকল কথা মনোযোগ সহকারে শুনলেন। অতঃপর তিনি সভাষদদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার পূর্ব হতেই ধারণা হয়েছিল তিনি কোন সাধারণ বাদশাহ নন।’রানী বিলকিস শীঘ্রই সুলাইমানের  সঙ্গে দেখা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন এবং একসময় জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তার সঙ্গে ছিল বাদশাহ সুলাইমানের জন্যে উপহার স্বরূপ এক‘শ পঞ্চাশ তালন্ত স্বর্ণ, কিছু দু:ষ্প্রাপ্য মণি এবং প্রচুর পরিমানে সুগন্ধি।
রানী বিলকিসের উট বহর জেরুজালেমের উপকন্ঠে এসে পৌঁছিল। তার আগমনের কথা জানার পর তার বিশাল সিংহাসনের কথা মনে পড়ল সুলাইমানের। তিনি তখন তার পরিষদবর্গের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘হে আমার পরিষদবর্গ! তারা আমার কাছে আত্মসমর্পন করতে আসার পূর্বে তোমাদের মধ্যে কে তার সিংহাসন আমাকে এনে দেবে?’এক শক্তিশালী জ্বীন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি আপনার স্থান থেকে উঠবার আগেই আমি তা এনে দেব। এ ব্যাপারে আমি এমনই শক্তি রাখি। আর আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।’অপর এক জ্বিন যার কিতাবের জ্ঞান ছিল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি চোখের পলক ফেলার আগেই আমি তা এনে দেব।’
সে মূহুর্তের মধ্যে রানী বিলকিসের সিংহাসন সুলাইমানের সামনে উপস্থিত করল। সুলাইমান  যখন তা তার সামনে রাখা দেখলেন তখন তিনি বললেন, ‘এ আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ যেন তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কৃতজ্ঞ না অকৃতজ্ঞ। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তা নিজের জন্যে করে, আর যে অকৃতজ্ঞ সে জেনে রাখুক যে, আমার প্রতিপালকের অভাব নেই, তিনি মহানুভব।’কথিত আছে যে, সিংহাসনটি ছিল ৮০ হাত লম্বা আর ৪০ হাত চওড়া ও ৩০ হাত উঁচু। যার মধ্যে ছিল মুক্তা, লাল রঙের পদ্মরাগ ও সবুজ রঙের পান্না ইত্যাদির কারুকার্য। আর আল্লাহই ভালো জানেন। (ফাতহুল কাদীর) তবে মনে হয় এ কথায় অতিরঞ্জন রয়েছে। ইয়ামানে রাণী বিলকীসের প্রাসাদের যে ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, তার মধ্যে এত বিশাল সিংহাসন সংকুলান হওয়ার জায়গাই নেই।একাগ্রচিত্তে সুলাইমান  সিংহাসনটা দেখতে লাগলেন। অতঃপর উক্ত জ্বিনকে বললেন, ‘তার সিংহাসনের আকৃতি বদলে দাও; দেখি সে ঠিক ধরতে পারে- নাকি ভুল করে।’

‘অতঃপর সুলাইমান বলল, হে আমার পারিষদবর্গ! তারা আত্মসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে আছ বিলকিসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে?’ (সুরা নামল -৩৮) ‘জনৈক দৈত্য-জ্বিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে ওঠার পূর্বেই আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে শক্তিবান ও বিশ্বস্ত’ (সুরা নামল -৩৯)। ‘(কিন্তু) কিতাবের জ্ঞান যার ছিল সে বলল, তোমার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা এনে দিব। অতঃপর সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত দেখল, তখন বলল, এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি শুকরিয়া আদায় করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে নিজের কল্যাণের জন্য তা করে থাকে এবং যে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে জানুক যে, আমার পালনকর্তা অভাবমুক্ত ও কৃপাময়’ (সুরা নামল -৪০)।
‘সুলাইমান বলল, বিলকিসের সিংহাসনের আকৃতি বদলিয়ে দাও, দেখব সে সঠিক বস্ত্ত চিনতে পারে, না সে তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা সঠিক পথ খুঁজে পায় না? (সুরা নামল -৪১) ‘অতঃপর যখন বিলকিস এসে গেল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো: আপনার সিংহাসন কি এরূপই? সে বলল, মনে হয় এটা সেটিই হবে। আমরা পূর্বেই সবকিছু অবগত হয়েছি এবং আমরা আজ্ঞাবহ হয়ে গেছি’ (সুরা নামল -৪২)। ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহর পরিবর্তে সে যার উপাসনা করত, সেই-ই তাকে ঈমান থেকে বিরত রেখেছিল। নিশ্চয়ই সে কাফের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল’ (সুরা নামল -৪৩)। ‘তাকে বলা হ’ল, প্রাসাদে প্রবেশ করুন। অতঃপর যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল, তখন ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। ফলে সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলাইমান বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। বিলকিস, হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলাইমানের সাথে বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করলাম’ (নামল) ।সূরা নামল ২২ হ’তে ৪৪ আয়াত পর্যন্ত উপরে বর্ণিত ২৩টি আয়াতে রাণী বিলকিসের কাহিনী শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৪০তম আয়াতে ‘যার কাছে কিতাবের জ্ঞান ছিল’ বলে কাকে বুঝানো হয়েছে, এ বিষয়ে তাফসীরবিদগণ মতভেদ করেছেন। তার মধ্যে প্রবল মত হ’ল এই যে, তিনি ছিলেন স্বয়ং হযরত সুলায়মান (আঃ)। কেননা আল্লাহর কিতাবের সর্বাধিক জ্ঞান তাঁরই ছিল। তিনি এর দ্বারা উপস্থিত জিন ও মানুষ পারিষদ বর্গকে বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমাদের সাহায্য ছাড়াও আল্লাহ অন্যের মাধ্যমে অর্থাৎ ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করে থাকেন। ‘আর এটি হ’ল আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ’ (সুরা নামল- ৪০)। দ্বিতীয়তঃ গোটা ব্যাপারটাই ছিল একটা মু‘জেযা এবং রাণী বিলকিসকে আল্লাহর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বস্ত্ততঃ এতে তিনি সফল হয়েছিলেন এবং সুদূর ইয়ামন থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে বিলকিসতার সিংহাসনের আগাম উপস্থিতি দেখে অতঃপর স্ফটিক স্বচ্ছ প্রাসাদে প্রবেশকালে অনন্য কারুকার্য দেখে এবং তার তুলনায় নিজের ক্ষমতা ও প্রাসাদের দীনতা বুঝে লজ্জিত ও অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করে মুসলমান হয়ে যান। মূলতঃ এটাই ছিল হযরত সুলায়মানের মূল উদ্দেশ্য, যা শতভাগ সফল হয়েছিল।
এর পরবর্তী ঘটনাবলী, যা বিভিন্ন তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে যেমন সুলাইমানের সাথে বিলকিসের বিবাহ হয়েছিল। সুলাইমান তার রাজত্ব বহাল রেখে ইয়ামনে পাঠিয়ে দেন। প্রতি মাসে সুলাইমান একবার করে সেখানে যেতেন ও তিনদিন করে থাকতেন। তিনি সেখানে বিলকিসের জন্য তিনটি নযীরবিহীন প্রাসাদ নির্মাণ করে দেন- ইত্যাদি সবকথাই ধারণা প্রসূত। যার কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নেই।জনৈক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উৎবাকে জিজ্ঞেস করেন, সুলায়মান (আঃ)-এর সাথে বিলকিসের বিয়ে হয়েছিল কি? জওয়াবে তিনি বলেন, বিলকিসের বক্তব্য وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ ِللهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করলাম’ (সুরা নামল (সুরা নামল ৪৪)-এ পর্যন্তই শেষ হয়ে গেছে। কুরআন এর পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চুপ রয়েছে। অতএব আমাদের এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন নেই (তাফসীর বাগাভী)।
গ্রন্থনায় -মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল