সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হেরাগুহা যেখান থেকে বিচ্ছুরিত হলো হেদায়তের দ্যুতি

মো.আবু রায়হানঃ আল্লাহর অদৃশ্য ইশারায় রাসুল (সা.) প্রতিবছর হেরা গুহায় মাসখানেক গভীর ধ্যান ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকতেন।নির্জনে ধ্যান করাকে আরবি ভাষায় বলে তাহন্নুস। আর এর জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পান ফারান পর্বতের এই হেরা গুহা বা গারে হেরায়।জাবাল আল নুর পাহাড়টির আদি নাম ফারান। এ পাহাড়েই আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর সর্বপ্রথম বরকতময় আলোকিত কুরআন নাজিল হয়। যা শুধু মুসলিম উম্মাহ নয় বরং বিশ্ব মানবতার জন্য নূর বা আলো। সে কারণেই এ পাহাড় বিশ্বব্যাপী জাবাল আল নূর নামেই পরিচিত। মহানবী (সা.) ১৫ বছর একাধারে হেরা গুহায় ধ্যান বা মোরাকাবা করেছেন। নবীজি (সা.) হেরাগুহায় ধ্যান করে আপন হূদয়কে আলোকিত করেছেন এবং সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হয়ে আল্লাহর দিদার লাভ করেছেন। রাসুল (সা.)-এর ফরমান, ‘আমার প্রভুকে আমি অতি উত্তম সুরতে দেখেছি’ (তাফসীরে রুহুল বয়ান)।

জাবাল আল নুর পাহাড়টি পবিত্র মসজিদুল হারাম থেকে ৩ কিমি উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত।The Cave of Hira is located on top of Jabal Al-Nour about 3 km from Mecca.এ পাহাড়ের মূল উচ্চতা ৬৪০ মিটার ২১০০ ফুট।এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি গুহা হেরা গুহা।প্রতিবছর রমজান মাসটা রাসুল (সা) কাটিয়ে দিতেন এই গুহায়। খাদিজা (রা.) খাবার আর পানি পাঠিয়ে দিতেন আবার কখনো নিজে নিয়ে যেতেন।গুহাটি জাবালে নুর পর্বতের ২৭০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত।হেরা গুহা ৩.৭ মিটার দীর্ঘ এবং ১.৬০ মিটার প্রশস্ত।গুহার আয়তন ৬ থেকে ৭ বগফুট। একজন মানুষ অনায়াসে দাঁড়াতে পারে ভেতরে। লোকের ভিড়ে গুহায় প্রবেশ করা যেমন কষ্টকর, তেমন বের হওয়াটাও। প্রতিদিন হাজার পাঁচেক দর্শনার্থী এখানে আসেন। এ পাহাড়ে উঠার জন্য বর্তমানে পাথর কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও পাইপ বা রডের রেলিং দেয়া হয়েছে।বর্তমানে যেখানে ওঠতে শক্তিশালী ও সামর্থবান মানুষদের প্রায় ১ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। প্রায় ১০০০ ফুট উচ্চতার ভয়ংকর পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠতে বেশ কয়েকবার বিশ্রাম নিতে হয়।সমতল ভূমি থেকে পাহাড়ের ওপরের দিকে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ ফুট পথ গাড়িতে যাওয়া যায়। সেখান থেকে ৮৯০ ফুট উচ্চতায় হেরা গুহা অবস্থিত। হেরা গুহায় যেতে আরও প্রায় ১০০ ফুট রাস্তা পাড়ি দিতে হয়।

ভাবতে অবাক হতে হয়, আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে জাবাল আল নুরের চূড়ায় অবস্থিত হেরা গুহায় উঠার জন্য বর্তমানের মতো কোনো রাস্তা এবং সিঁড়ি ছিল না। ছিল না কোনো রেলিং। তখন এই পথ বেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ওপরে উঠতেন। আর উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা রাসূলের-এর জন্য নিয়মিত খাবার নিয়ে যেতেন। হজের সময় এখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়। যদিও হেরা গুহা পরিদর্শন হজের কোনো অংশ নয়।

মহানবীর ৪০ বছর বয়সে ৬১০ সালে রমজান মাসে লাইলাতুল কদর রাতে এখানেই সর্বপ্রথম অহি নাজিল হয়েছিল।হেরা গুহা ও জাবালে নূর এ দুটি স্থান মুসলমানদের কাছে খুবই প্রিয়। এই পাহাড়ের হেরা গুহায় প্রথম অহি নিয়ে আসেন হযরত জিবরাইল (আ.)। এক রাতে জিবরাইল (আ.) এলেন। তাঁর হাতে এক খণ্ড রেশমি কাপড়। তাতে কিছু লেখা। জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘পড়ুন।’ মুহাম্মদ (সা.)-এর জবাব—‘আমি পড়তে পারি না।’ এরপর জিবরাইল (আ.) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে চাপ দিলেন। পর পর তিনবার। এবার তিনি পড়তে পারলেন—‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন...। ’ নাজিল হলো সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। ।এভাবেই সূরা আলাকের পাঁচটি আয়াত নাজিলের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পবিত্র কুরআন নাজিল। সূচনা হয় নতুন ধর্ম- ইসলামের। জানা যায়, প্রথম ওহি লাভ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাড়িতে চলে আসেন। এরপর ফের তিনি (সা.) গারে হেরায় গমন করে এক মাসের নির্ধারিত অবশিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করেন (সিরাত ইবনে ইসহাক, পৃ. ৩৯)। এরপর আর তিনি (সা.) গারে হেরায় যাননি। রাসুল (সা.)-এর গারে হেরায় নির্জনবাস বিষয়ে কোরায়েশরা তাঁর সঙ্গে দুশমনি করেনি। কারণ রাসুলের দাদা আবদুল মুত্তালিবই সর্বপ্রথম এখানে নির্জনবাস করেছেন এবং তিনি এ প্রথার সূচনা করেছেন। বর্বরতার তিমির পরিবেশে কেউ পাপমুক্তি ও পরিশুদ্ধি অর্জন করতে চাইলে তার সংশোধনাগার ছিল এ গারে হেরা। (ইবনে হাজার , ফাতহুল বারি - ১৯/৪৪৯)।

বস্তুত হেরা গুহা বা গারে হেরা ইসলামের ইতিহাসে একটি আলোচিত জায়গার নাম। ইসলামের ঐতিহাসিক নির্দেশনাবলীর অন্যতম। মানব জাতির মুক্তির দিক নির্দেশনা সম্বলিত গ্রন্থ এবং প্রিয় নবীর শ্রেষ্ঠ মুজেজা, সর্বশেষ আসমানি কিতাব,আল কুরআনুল কারিম দুনিয়ার বুকে, সর্ব প্রথম এখানেই নাজিল হয়েছিল। পরবর্তীতে দীর্ঘ ২২ বছর ৫ মাস ১৪দিনে মানব জাতির হেদায়তের দিশা হিসেবে আল্লাহ তায়ালা পুরো কুরআনুল কারিম অবর্তীণ করেন।যে কারণে হেরা গুহা, মুসলমানদের কাছে এতো ভালোবাসার, এত আবেগের।ছড়িয়ে পড়ুক হেরার দ্যুতি সারা বিশ্বময়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...