মুসা (আ.) এর কওমের গো-বৎস পূজা
হযরত মুসা (আ.) বনু ইসরায়েলদের নিয়ে তূর পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন।তখন তিনি হারুন (আ)-কে নিজ কওমের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে পেছনে আসার নির্দেশ দিয়ে নিজে আগে চলে গেলেন। মুসা (আ.) সেখানে গিয়ে ৪০ দিন রোজা ও ইতেকাফে কাটানোর পর আল্লাহর পক্ষ হতে আসমানি কিতাব তওরাত লাভ করেন। মুসা (আ.) এর ধারণা ছিল যে, তার কওম নিশ্চয়ই তার পিছে পিছে তূর পাহাড়ের সন্নিকটে এসে শিবির স্থাপন করেছে। কিন্তু তাঁর ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। মুসা (আ.) এর তুর পাহাড়ে যাওয়ার পর সামেরি নামক এক ব্যক্তি বনু ইসরায়েলদের বাছুর পূজায় লাগিয়ে দিল। যার সংবাদ আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.) কে তুর পাহাড়েই দিলেন যে, সামেরি তোমার জাতিকে পথভ্রষ্ট করে ফেলেছে।আল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, -‘হে মূসা! তোমার সম্প্রদায়কে পিছনে ফেলে তুমি দ্রুত চলে এলে কেন?’ ‘তিনি বললেন, তারা তো আমার পিছে পিছেই আসছে এবং হে প্রভু! আমি তাড়াতাড়ি তোমার কাছে এলাম, যাতে তুমি খুশী হও’। আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি তোমার পর এবং সামেরি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে।’
(সুরা ত্বোয়াহা আয়াত ৮৩-৮৫)।
কে এই সামেরি ?
গো-বৎস পূজার নায়ক ছিল সামেরি নামক এক ইসরাইলী ইহুদি। তার আসল নাম নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, তার নাম ছিল মুসা, কেউ বলেন, সে ছিল কিবতী (ফেরাউন বংশীয়)। ইবনে কাসীরের বর্ণনা অনুযায়ী, ইসরাইলী গ্রন্থাবলীতে তার নাম হারুন লেখা আছে। প্রসিদ্ধ মতে, এ ব্যক্তি হযরত মুসা (আ.)এর যুগের মোনাফেক ছিল এবং মোনাফেকদের ন্যায় ধোকাবাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে মুসলমানদের গুমরাহ ও বিভ্রান্ত করার ধান্দায় লিপ্ত থাকত। কেউ বলেন,পারস্য অথবা ভারতবর্ষের অধিবাসী সামেরী গো-পূজারী সম্প্রদায়ের লোক ছিল। পরে মিসরে পৌঁছে সে মুসা (আ.) এর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে। অত্যন্ত চতুর এই ব্যক্তিটি পরে কপট বিশ্বাসী ও মুনাফিক হয়ে যায়। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না পাওয়ায় সে বনি ইসরাইলীদের সাথে সাগর পার হওয়ার সুযোগ পায়। মুসা (আ.) এর বিপুল নাম-যশ ও অলৌকিক ক্ষমতায় সে তার প্রতি মনে মনে ঈর্ষাপরায়ণ ছিল। মুসা (আ.) এর সান্নিধ্য ও নিজস্ব সুক্ষ্মদর্শিতার কারণে সে জিব্রাঈল ফেরেশতা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সেই আগ্রহের কারণেই সাগর পার হওয়ার সময় সে জিব্রাইলকে চিনতে পারে ও তার ঘোড়ার পদচিহ্নের মাটি সংগ্রহ করে। তার ধারণা ছিল যে, মুসার যাবতীয় ক্ষমতার উৎস হল এই ফেরেশতা। অতএব তার স্পর্শিত মাটি দিয়ে সেও এখন মুসার ন্যায় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে।কোন কোন মুফাসসির বলেন, সামেরি কোন ব্যক্তির নাম নয় বরং সে সময় সামেরি নামে এক গোত্র ছিল এবং তাদের এক বিশেষ ব্যক্তি ছিল বনী ইসরাঈলের মধ্যে স্বর্ণ নির্মিত গো-বৎস পূজার প্রচলনকারী এ সামেরী। সে তাদেরকে গো বৎস পূজার আহবান জানিয়েছিল এবং শিরকে নিপতিত করেছিল। (ফাতহুল কাদীর)।
মুসা (আ.) এলেন-
সামেরির এই পথভ্রষ্টের সংবাদ অবগত হয়ে মুসা (আ.) হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং দুঃখে ও ক্ষোভে অস্থির হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন। আল্লাহ বলেন,‘অতঃপর মূসা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন ক্রুদ্ধ ও অনুতপ্ত অবস্থায়। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের পালনকর্তা কি তোমাদের একটি উত্তম প্রতিশ্রুতি (অর্থাৎ তওরাত দানের প্রতিশ্রুতি) দেননি? তবে কি প্রতিশ্রুতির সময়কাল (৪০ দিন) তোমাদের কাছে দীর্ঘ হয়েছে? না-কি তোমরা চেয়েছ যে তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার ক্রোধ নেমে আসুক, যে কারণে তোমরা আমার সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করলে’?‘তারা বলল, আমরা আপনার সাথে কৃত ওয়াদা স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করিনি। কিন্তু আমাদের উপরে ফেরাউনীদের অলংকারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর আমরা তা নিক্ষেপ করে দিয়েছি এমনিভাবে সামেরিও নিক্ষেপ করেছে’। ‘অতঃপর সে তাদের জন্য (সেখান থেকে) বের করে আনলো একটা গো-বৎসের অবয়ব, যার মধ্যে হাম্বা হাম্বা রব ছিল। অতঃপর (সামেরি ও তার লোকেরা) বলল, এটাই তোমাদের উপাস্য এবং মুসারও উপাস্য, যা পরে মুসা ভুলে গেছে’ ( সুরা ত্বোয়াহা আয়াত ৮৬-৮৮)।
মূল ঘটনা-
ঘটনা ছিল এই যে, মিসর থেকে বিদায়ের দিন যাতে ফেরাউনীরা তাদের পেছনে ধাওয়া না করে এবং তারা কোনরূপ সন্দেহ না করে, (মুসাকে না জানিয়ে তার অগোচরে বনি ইসরাইলিরা প্রতিবেশী ক্বিবতীদের কাছ থেকে অলংকারাদি ধার নেয় এই কথা বলে যে, আমরা সবাই আনন্দ উৎসব পালনের জন্য যাচ্ছি। দু’একদিনের মধ্যে ফিরে এসেই তোমাদের সব অলংকার ফেরৎ দেব। কিন্তু সাগর পার হওয়ার পর যখন আর ফিরে যাওয়া হলো না, তখন কুটবুদ্ধি ও মুসার প্রতি কপট বিশ্বাসী সামেরি মনে মনে এক ফন্দি আটলো যে, এর দ্বারা সে বনি ইসরাইলিদের পথভ্রষ্ট করবে। অতঃপর মুসা (আ.) যখন তার সম্প্রদায়কে হারুনকে দায়িত্ব দিয়ে নিজে আগেভাগে তুর পাহাড়ে চলে যান, তখন সামেরি সুযোগ বুঝে তার ফন্দি কাজে লাগায়। সে ছিল অত্যন্ত চতুর। সাগর ডুবি থেকে নাজাত পাবার সময় সে জিব্রাইলের অবতরণ ও তার ঘোড়ার প্রতি লক্ষ্য করেছিল। সে দেখেছিল যে, জিব্রাইলের ঘোড়ার পা যে মাটিতে পড়ছে, সে স্থানের মাটি সজীব হয়ে উঠছে ও তাতে জীবনের স্পন্দন জেগে উঠছে। তাই সবার অলক্ষ্যে এ পদচিহ্নের এক মুঠো মাটি সে তুলে সযত্নে রেখে দেয়। মুসা (আ.) চলে যাবার পর সে লোকদের বলে যে, ‘তোমরা ফেরাউনীদের যেসব অলংকারাদি নিয়ে এসেছ এবং তা ফেরত দিতে পারছ না, সেগুলি ভোগ-ব্যবহার করা তোমাদের জন্য হালাল হবে না। অতএব এগুলি একটি গর্তে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দাও’। কথাটি অবশেষে হারুন (আ.)-এর কর্ণগোচর হয়। নাসাঈ-তে বর্ণিত ‘হাদিসুল ফুতূনে’ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা)-এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হারুন (আ.)-সব অলংকার একটি গর্তে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেবার নির্দেশ দেন, যাতে সেগুলি একটি অবয়বে পরিণত হয় এবং মুসা (আ.) এর ফিরে আসার পর এ সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণ করা যায়।সামেরিও হাতের মুঠি বন্ধ করে সেখানে পৌঁছল এবং হারুন (আ.)-কে বলল, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হৌক- এই মর্মে আপনি দোয়া করলে আমি নিক্ষেপ করব, নইলে নয়।’ হারুন (আ.)-তার কপটতা বুঝতে না পেরে সরল মনে দোয়া করলেন। আসলে তার মুঠিতে ছিল জিব্রাইলের ঘোড়ার পায়ের সেই অলৌকিক মাটি। ফলে উক্ত মাটির প্রতিক্রিয়ায় হোক কিংবা হারুন (আ.)-এর দোয়ার ফলে হোক- সামেরির উক্ত মাটি নিক্ষেপের পরপরই গলিত অলংকারাদির অবয়বটি একটি গো-বৎসের রূপ ধারণ করে হাম্বা হাম্বা রব করতে থাকে। মুনাফিক সামেরি ও তার সঙ্গী-সাথীরা এতে উল্লসিত হয়ে বলে উঠল, ‘এটাই হ’ল তোমাদের উপাস্য ও মুসার উপাস্য। যা সে পরে ভুলে গেছে’ ( সুরা ত্বোয়াহা আয়াত-৮৮)। মুসা (আ.) এর তূর পাহাড়ে গমনকে সে অপব্যাখ্যা দিয়ে বলল, মুসা বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে। এখন তোমরা সবাই গো-বৎসের পূজা কর’। কিছু লোক তার অনুসরণ করল। বলা হয়ে থাকে যে, বনি ইসরাইল এই ফিৎনায় পড়ে তিন দলে বিভক্ত হয়ে গেল। ফলে মুসা (আ.) এর পিছে পিছে তাদের তুর পাহাড়ে গমনের প্রক্রিয়া পথিমধ্যেই বানচাল হয়ে গেল।হারুন (আ) তাদেরকে বললেন, হে কওম! তোমরা এই গো-বৎস দ্বারা পরীক্ষায় পতিত হয়েছ। তোমাদের পালনকর্তা অতীব দয়ালু। অতএব তোমরা আমার অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল। কিন্তু সম্প্রদায়ের লোকেরা বলল, ‘মুসা আমাদের কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজায় রত থাকব’ (সুরা ত্বোয়াহা আয়াত ৯০-৯১)।অতঃপর মুসা (আ.) এলেন এবং সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে সব কথা শুনলেন। হারুন (আ)ও তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন। সামেরিও তার কপটতার কথা অকপটে স্বীকার করল। অতঃপর মুসা (আ.) আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী শাস্তি ঘোষণা করলেন।
গো-বৎস পূজার শাস্তি- মুসা (আ.) গো-বৎস পূজায় নেতৃত্ব দানকারী হঠকারী লোকদের মৃত্যুদন্ড দিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা গো-বৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করে নিজেদের উপরে যুলুম করেছ। অতএব এখন তোমাদের প্রভুর নিকটে তওবা কর এবং নিজেদেরকে পরস্পরে হত্যা কর। এটাই তোমাদের জন্য তোমাদের স্রষ্টার নিকটে কল্যাণকর’... (বাকারাহ আয়াত-৫৪)। এভাবে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয়, কিছু লোক ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়।
তূর পাহাড় তুলে ধরা হলো-
কপট বিশ্বাসী ও হঠকারী কিছু লোক ছিল, যারা তওরাতকে মানতে অস্বীকার করে। যখন মুসা (আ.) কে তুর পর্বতে তাওরাত প্রদান করা হল, তখন তিনি ফিরে এসে তা ইসরাঈল-বংশধরকে দেখাতে ও শোনাতে আরম্ভ করলেন। এতে হুকুমগুলো কিছুটা কঠোর ছিল - কিন্তু তাদের অবস্থানুযায়ীই ছিল। এ সম্পর্কে প্রথম তারা এ কথাই বলেছিল যে, যখন স্বয়ং আল্লাহ্ তা'আলা আমাদেরকে বলে দেবেন। যে, এটা আমার কিতাব' তখনই আমরা মেনে নেবো। মোটকথা যে সত্তরজন লোক মুসা (আ.) -এর সাথে গিয়েছিল, তারাও ফিরে এসে সাক্ষী দিল। কিন্তু ইসরাঈল-বংশধররা পরিস্কারভাবে বলে দিল, আমাদের দ্বারা এ গ্রন্থের উপর আমল করা সম্ভব হবে না। ফলে আল্লাহ্ তাআলা ফেরেশতাদেরকে হুকুম করলেন, তুর পর্বতের একটি অংশ তুলে নিয়ে তাদের মাথার উপর ঝুলিয়ে দাও এবং বল, হয় কিতাব মেনে নাও, নইলে এক্ষুণি মাথার উপর পড়লো। অবশেষে নিরুপায় হয়ে তা মেনে নিতে হলো। এ আয়াতে বর্ণিত তুর পাহাড় উঠানোর তাফসীর আল্লাহ্ তা'আলা অন্য আয়াতে করে দিয়েছেন। যেখানে বলা হয়েছে, “স্মরণ করুন, আমরা পর্বতকে তাদের উপরে উঠাই, আর তা ছিল যেন এক শামিয়ানা। তারা মনে করল যে, ওটা তাদের উপর পড়ে যাবে। বললাম, আমি যা দিলাম তা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং ওটাতে যা আছে তা স্মরণ কর” (সূরা আল-আ’রাফ আয়াত- ১৭১)।কিন্তু গো-বৎসের মহববত এদের হৃদয়ে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, এতকিছুর পরেও তারা শিরক ছাড়তে পারেনি। আল্লাহ বলেন, ‘কুফরের কারণে তাদের অন্তরে গোবৎস প্রীতি পান করানো হয়েছিল’ ( সুরা বাক্বারাহ আয়াত -৯৩)। যেমন কেউ সরাসরি শিরকে নেতৃত্ব দিয়েছে, কেউবা মুখে তওবা করলেও অন্তরে পুরোপুরি তওবা করেনি। কেউবা শিরককে ঘৃণা করতে পারেনি। কেউ বা মনে মনে ঘৃণা করলেও বাহ্যিকভাবে মেনে নিয়েছিল এবং বাধা দেওয়ার কোন চেষ্টা করেনি। আল্লাহ যখন তূর পাহাড় তুলে ধরে ভয় দেখিয়ে তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নেন, তখনও তাদের কেউ কেউ (পরবর্তীতে) বলেছিল, স্মরণ কর, যখন আমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম এবং তুরকে তোমাদের উপর উত্তোলন করেছিলাম, (বলেছিলাম,) যা দিলাম দৃঢ়ভাবে গ্রহণ কর এবং শোন’। তারা বলেছিল, “আমরা শোনলাম ও অমান্য করলাম”। আর কুফরীর কারণে তাদের অন্তরে গো-বৎস প্রীতি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। বলুন, যদি তোমরা ঈমানদার হও তবে তোমাদের ঈমান যার নির্দেশ দেয় তা কত নিকৃষ্ট! ( সুরা বাক্বারাহ আয়াত-৯৩)। যদিও অমান্য করলাম কথাটি ছিল পরের এবং তা প্রমাণিত হয়েছিল তাদের বাস্তব ক্রিয়াকর্মে। যেমন আল্লাহ এইসব প্রতিশ্রুতি দানকারীদের পরবর্তী আচরণ সম্বন্ধে বলেন,‘অতঃপর তোমরা উক্ত ঘটনার পরে (তোমাদের প্রতিশ্রুতি থেকে) ফিরে গেছ। যদি আল্লাহর বিশেষ করুণা ও অনুগ্রহ তোমাদের উপরে না থাকত, তাহলে অবশ্যই তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে।’(সুরা বাকারাহ আয়াত -৬৪)।
সামেরির কৈফিয়ত-
সম্প্রদায়ের লোকদের শাস্তি দানের পর মুসা (আ.) এবার সামেরিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে সামেরি! তোমার ব্যাপার কি?’ ‘সে বলল, আমি দেখলাম, যা অন্যেরা দেখেনি। অতঃপর আমি সেই প্রেরিত ব্যক্তির (অর্থাৎ জিব্রীলের) পদচিহ্নের নীচ থেকে এক মুষ্টি মাটি নিয়ে নিলাম। অতঃপর আমি তা (আগুনে গলিত অলংকারের অবয়বের প্রতি) নিক্ষেপ করলাম। আমার মন এটা করতে প্ররোচিত করেছিল (অর্থাৎ কারো পরামর্শে নয় বরং নিজস্ব চিন্তায় ও শয়তানী কুমন্ত্রণায় আমি একাজ করেছি)’। ‘মূসা বললেন, দূর হ, তোর জন্য সারা জীবন এই শাস্তিই রইল যে, তুই বলবি, ‘আমাকে কেউ স্পর্শ করো না’ এবং তোর জন্য (আখেরাতে) একটা নির্দিষ্ট ওয়াদা রয়েছে (অর্থাৎ জাহান্নাম), যার ব্যতিক্রম হবে না। এক্ষণে তুই তোর সেই ইলাহের প্রতি লক্ষ্য কর, যাকে তুই সর্বদা পূজা দিয়ে ঘিরে থাকতিস। আমরা ওটাকে (অর্থাৎ কৃত্রিম গো-বৎসটাকে) অবশ্যই জ্বালিয়ে দেব এবং অবশ্যই ওকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে ছিটিয়ে দেব’ ( সুরা ত্বোয়াহা আয়াত ৯৫-৯৭)।
সামেরি ও তার শাস্তি-
মুসা (আ.) সামেরির জন্য পার্থিব জীবনে এই শাস্তি নির্ধারণ করেন যে, সবাই তাকে বর্জন করবে এবং কেউ তার কাছে ঘেঁষবে না। তিনি তাকেও নির্দেশ দেন যে, সে কারও গায়ে হাত লাগাবে না। সারা জীবন এভাবেই সে বন্য জন্তুর ন্যায় সবার কাছ থেকে আলাদা থাকবে। এটাও সম্ভবপর যে, পার্থিব আইনগত শাস্তির ঊর্ধ্বে খোদ তার সত্তায় আল্লাহর হুকুমে এমন বিষয় সৃষ্টি হয়েছিল, যদ্দরুন সে নিজেও অন্যকে স্পর্শ করতে পারত না এবং অন্যেরাও তাকে স্পর্শ করতে পারত না। যেমন এক বর্ণনায় এসেছে যে, মুসা (আ.) এর বদদোয়া তার মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, সে কাউকে হাত লাগালে বা কেউ তাকে হাত লাগালে উভয়েই জ্বরাক্রান্ত হয়ে যেত’ (কুরতুবী, ত্বোয়াহা ৯৫)। এই ভয়ে সে সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ঘোরাফেরা করত। কাউকে নিকটে আসতে দেখলেই সে চীৎকার করে বলে উঠতো আমাকে কেউ স্পর্শ করো না। বস্ত্ততঃ মৃত্যুদন্ডের চাইতে এটিই ছিল কঠিন শাস্তি। যা দেখে অপরের শিক্ষা হয়। বলা বাহুল্য, আজও ভারতবর্ষের হিন্দুদের মধ্যে গো-মাতার পূজা অব্যাহত রয়েছে। যদিও উদারমনা উচ্চ শিক্ষিত হিন্দুগণ ক্রমেই এ অলীক বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসছেন এবং গাভীকে দেবী নয় বরং মানুষের ব্যবহারযোগ্য ও খাদ্যযোগ্য প্রাণী হিসাবে বিশ্বাস করেন।কুরতুবী বলেন, এর মধ্যে দলিল রয়েছে এ বিষয়ে যে, বিদ‘আতী ও পাপাচারী ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা জরুরী। তাদের সঙ্গে কোনরূপ মেলামেশা ও আদান-প্রদান না করাই কর্তব্য। যেমন আচরণ শেষনবী (সা) জিহাদ থেকে পিছু হটা মদীনার তিনজন ধনীলোকের সাথে (তাদের তওবা কবুলের আগ পর্যন্ত) করেছিলেন। (কুরতুবী)।
গ্রন্থনায়- মো. আবু রায়হান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন