সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শহিদ বুদ্ধিজীবী ও বর্তমানের মেরুদন্ডহীন বুদ্ধিজীবী সমাজ

১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ সময় জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়।ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবদান ছিল অগ্রগন্য। বুদ্ধিজীবীর বিভিন্ন সমার্থক শব্দ প্রচলিত রয়েছে। পণ্ডিত, বিদ্বান টাইপের মানুষ। কার্ল মার্কসের তত্ত্ব এবং গোষ্ঠীভিত্তিক যে শ্রেণিবিশ্লেষণ তা সম্ভবত বুর্জোয়ার সঙ্গে এই intelligentsia-কে এক করে দিয়েছেন।উইকিপিডিয়া মতে, বুদ্ধিজীবীর ইংরেজি প্রতিশব্দ Intellectual. বুদ্ধিজীবী হলেন এমন ব্যক্তি যিনি সমাজ সম্পর্কিত জটিল চিন্তা, গবেষণা ও প্রভাব-বিস্তারে জড়িত থাকেন, সমাজের মূল সমস্যাগুলোর সমাধান ও সমাধানের পদ্ধতির প্রস্তাব দেন, এবং একজন জনপ্রিয় ব্যক্তির স্বীকৃতি অর্জন করেন।বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা হলো, বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কন্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। Oxford English Dictionary শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে, ‘The class consisting of the educated portion of the population and regarded as capable of forming public opinion.’ (এমন একটি সম্প্রদায় যা জনসংখ্যার শিক্ষিত অংশ দ্বারা গঠিত এবং যারা জনমত সৃষ্টিতে সক্ষম)।এই শ্রেণীকে ব্রিটেন ও মার্কিন আমেরিকায় প্রায়ই বাচাল শ্রেণি(chattering class) বলে আখ্যায়িত করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের মূল দায়িত্ব কী? বুদ্ধিজীবীদের কাজ হচ্ছে আমাদের সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতিগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরা।এসব সমস্যা সমাধানে সুপারিশ করা, পদ্ধতি বাতলে দেওয়া। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যাবলীর ধরন ও উদ্দেশ্য কি রকম হওয়া সেই সম্পর্কে বিজ্ঞচিত পরামর্শ দেওয়া। আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব পূর্ব পাকিস্তান আমলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন জাতির দিকপাল। তাঁদের ধ্যান ধারণা, সুচিন্তিত লেখা, যৌক্তিক বক্তব্য কূলহারা জাতিকে দিয়েছে সঠিক দিক নির্দেশনা। ভলতেয়ার, মন্তেস্কু, রুশো, দিদেরো প্রমুখ দার্শনিকরা তাঁদের রচনা দ্বারা ফরাসি জনসাধারণকে নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তুলেছিলেন।যার ফলে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছিল তা ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলেছিল। তেমনি স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্গাতা। তাদের লিখনী ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যচর্চা বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের ছিল সঞ্জীবনী শক্তি।১৯৪৭ সালে পাক ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাষা নিয়ে যে সংকটের সূত্রপাত হয় সেখানে এদেশীয় বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে সবচেয়ে অগ্রগামী। দেশ বিভাগের কয়েকদিন আগে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ প্রথম উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন।অথচ
পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই পূর্ব পাকিস্তানের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। তার এ দাবির বিরুদ্ধে প্রথমে সোচ্চার হয়েছিলেন বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সেই সময় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখে ড. জিয়াউদ্দীন আহমদের অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে লিখে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ভাষা আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে ও আরো গতিশীল করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বরে ঢাকায় তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়।সেহিসাবে তমদ্দুন মজলিস ছিল ভাষা আন্দোলনের দাবিতে গড়ে উঠা প্রথম সংগঠন।
১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে তমদ্দুন মজলিস একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যার নাম ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু? এই পুস্তিকার লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমেদ এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম বাংলা ভাষাকে পূর্ব বাংলায় ভাব বিনিময়, অফিস ও আদালতের একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো মতামত তুলে ধরেন। তারা বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষেও জোরালো দাবি জানান।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর জেলে বসে মুনীর চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত কবর নাটক রচনা করেন। যে নাটকে তিনি ভাষা আন্দোলনকারীদের করুণ পরিণতি তুলে ধরেন।
জহির রায়হানের ভাষা আন্দোলন নিয়ে
আরেক ফাল্গুন উপন্যাস লিখেন। তিনি একজন শহিদ বুদ্ধিজীবী। ১৯৫৫ সালে একুশে উদযাপনের সময় তাঁকে আবার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫৫ সালে শহিদ দিবস পালনের প্রস্তুতি, সরকারী বাধা ইত্যাদি অবরুদ্ধতাকে কেন্দ্র করে ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে।
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বহুল আলোচিত একুশ দফার রচয়িতা ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী। তিনি হলেন সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদ। জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান রচনা করেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ক্রীতদাসের হাসি’। তিনি এই রূপক উপন্যাসের মাধ্যমে তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী নীতির বাস্তব চরিত্র তুলে ধরেন। পাকিস্তান আমলে প্রথম শহিদ বুদ্ধিজীবী হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শহিদ শামসুজ্জোহা। ১৯৬৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করে। আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করলে অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা থাকায় প্রক্টর শামসুজ্জোহা নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন পাক সেনা সদস্যদের। কিন্তু সেনাদের ছোঁড়া গুলি বিদ্ধ হয়েই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ, ভাষা সংস্কৃতির ওপর দমন নিপীড়নমূলক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। প্রয়োজনে তারা রক্ত লেখা লিখে গেছেন। কখনো নিজেদের জীবনের মায়া ভুলে রক্ত ঝরিয়েছেন। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ছিল পাক শাসক গোষ্ঠীর মূর্তিমান আতঙ্ক। তাদের নির্ঘুম রাতের কারণ। প্রতিটি অযৌক্তিক কাজের বিরুদ্ধে তারা ছিলেন প্রতিবাদী কন্ঠ। এসবের কারণে ১৯৭১ সালে পরাজয়ের শেষ সময় হানাদার পাক বাহিনীর নির্মম জিঘাংসার শিকার হলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বুদ্ধিজীবীরা।
কেন বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করা হলো?
পূর্ববাংলার জনগণকে বুদ্ধিজীবীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজে বরাবরই ছিলেন তৎপর এবং তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচারী মনোভাব ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণকে আন্দোলনে নানানভাবে অনুপ্রাণিত করেন।সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকতেন সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরা
এসব কারণে পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই ছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের নির্ভুল টার্গেটের লক্ষ্যবস্তু ।
যেভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়?
মূলত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানী সেনারা অপারেশন সার্চলাইট চলাকালীন সময়ে ঢাকায় তালিকা ধরে খুঁজে-খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে।তাদের একাজে সহযোগিতা করে এদেশীয় সহযোগী আল বদর, আশ শামস বাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫শে মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে, পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষের মাত্র কয়েকদিন আগে।১০ ডিসেম্বর হতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নিতে থাকে।জানা যায় ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন করা হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখক-সহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মত বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা হতে ধরে নিয়ে যায়। বুদ্ধিজীবীদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ আরো অনেক স্থানে অবস্থিত হানাদার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে তাদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।
শহিদ বুদ্ধিজীবী কতজন?
বাংলাপিডিয়া হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা, শিক্ষাবিদ - ৯৯১ জন, সাংবাদিক - ১৩ জন, চিকিৎসক - ৪৯ জন,আইনজীবী - ৪২,সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী- ১৬ জন।
আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।যদি সেদিন দেশের এতগুলো শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা করা না হতো তাহলে বাংলাদেশ শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে আরো এগিয়ে যেত। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তারা বাংলাদেশকে অপূরণীয় ক্ষতিতে ফেলেছে। আজ বুদ্ধিজীবী তৈরি হচ্ছে না। সাধু সজ্জন ব্যক্তিরা অকাল প্রয়াত হচ্ছেন। কিন্তু মেধাবী,বুদ্ধিমান সন্তানের আবির্ভাব সেভাবে ঘটছে না। যারা আগামীতে দেশটাকে এগিয়ে নেবে।
বুদ্ধিজীবীদের কেন হত্যা করা হলো? প্রথমত: বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন করা এবং দ্বিতীয়ত:স্বাধীন বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দেউলিয়ায় পরিণত করা।বুদ্ধিজীবীদের হত্যা প্রসঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে যে যুক্তিটি দেয়া হয়েছে তা প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিযুক্ত,"এটা অবধারিত হয়, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাদের রচনাবলীর মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে। একটি জাতিকে নির্বীজ করে দেবার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়া। ২৫ মার্চ রাতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতর্কিতে, তারপর ধীরে ধীরে, শেষে পরাজয় অনিবার্য জেনে ডিসেম্বর ১০ তারিখ হতে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রুতগতিতে।"
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রায় অর্ধশতাব্দী হতে চলেছে। পদ্মা মেঘনা যমুনার অনেক পানি গড়িয়েছে কিন্তু এখনো অনেক স্বপ্নই অধরা।অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক সুবিচার, গণতান্ত্রিক পরিবেশ এখনো এদেশে পূর্ণতা পায়নি। যে বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য অবদান রেখে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিলেন, পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন সেইসব সূর্য সন্তানদের উত্তরসূরীরা স্বাধীন দেশে নীরব। আমরা কি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র পেয়েছি? সুশাসন পেয়েছি? তবে কেন তাদের মৌনতা ভেঙ্গে বিঘোষিত হয় না?
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।
আজ সুশীল সমাজ বলি, বুদ্ধিজীবী বলি তারা নিজেদের পদ স্বার্থ নিয়ে বেশি তৎপর। বর্তমান দেশের দুএকজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী বাদে বাকিরা আছেন ব্যাঙের শীতনিদ্রায়। চরম সত্যর মুখোমুখি হতে তারা ভীত। আহমেদ ছফার মতো গাভী বিত্তান্ত লিখতে তারা অপারগ। তেলবাজি মোহসাহেবিতে তারা অনন্য উচ্চতায়। কেউ কেউ কারণে অকারণে হড়হড় করে বমি আর টুথপেস্ট নিয়ে ব্যস্ত।আজকাল দেশে বুদ্ধিজীবীর চেয়ে বুদ্ধিজীবীর নামে আঁতেল সংখ্যা বেশি। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বাঙালির আত্মপ্রকাশ ঘটে, যারা নিয়মিত কফি হাউসে বসতেন, পাঞ্জাবি পরতেন ও নিজেদের সেরা মনে করতেন, এসব বুদ্ধিজীবীকে দেখে অন্যান্যদের বিদ্রুপ এবং প্রতিক্রিয়াতেই ‘আঁতেল’ শব্দটির প্রয়োগ ঘটে।বর্তমান বোধহয় সেই চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের আঁতেল বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব ঘটেছে। সেই সময়ে তারা সংখ্যায় কম ছিলেন। বর্তমানে তাদের সংখ্যাধিক্যই পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশে চরম দুর্দিনেও তারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। মেরুদন্ডহীন প্রাণীর মতো আচরণ করেন।অথচ আহমদ ছফা বুদ্ধিজীবীদের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে বলেন “একজন বুদ্ধিজীবীকে চিন্তা করতে হয়। চিন্তার বদলে তিনি যদি চিন্তা করার ভান করেন, পরিণতি ভয়ংকর হতে বাধ্য। অথচ আমাদের সমাজে যাদের ভাবার দায়িত্ব তাদের অনেকের ভাবনাযন্ত্র বিকল।" আজকের এই দিনে আসুন শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নীতি আদর্শ বুকে ধারণ করে ন্যায় ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে এগিয়ে যাই।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...