সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কাবা ঘরের চাবি কার কাছে থাকে ?


পবিত্র কাবাকে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলা হয়। বর্তমান কাবা ঘরটি যেখানে অবস্থিত সে স্থানটিই পৃথিবীর প্রথম জমিন। বিশাল সাগরের মাঝে ধীরে ধীরে ভরাট হতে হতে এই ভূমির সৃষ্টি হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল এক মহাদেশ। এভাবেই পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় সাত মহাদেশ। ভৌগোলিকভাবে গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থানে অবস্থিত এই পবিত্র কাবা ঘর আল্লাহ-তায়ালার জীবন্ত নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। কাবাঘরের সেবা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। ফলে সমকালীন শাসকরা কাবার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছেন। এরই অংশ হিসেবেই কাবা ঘরের দরজা তৈরি করা হয়েছে স্বর্ণ দিয়ে।এ ঘরের দেখভাল এবং চাবি কার কাছে থাকে তা জানার আগ্রহ কমবেশি সবারই আছে। আজকের লেখা কাবা ঘরের চাবি কার কাছে থাকে তা নিয়ে - কাবাঘরের দরজার তালার চাবি বনি শাইবাহ গোত্রের কাছে সংরক্ষিত থাকে। পূর্ব থেকেই এ রীতি চলে আসছে। The Bani Shaiba or the sons of Shaiba are the tribe that hold the keys to the Kaaba today. They are in charge of the ‘Sudnah’ of the Kaaba which means the complete care of it including opening and closing it, cleaning and washing it, and caring for its Kiswah or cladding.৮ম হিজরি ২০ রমজান ,৬৩০ সালে মক্কা বিজয়ের পর অনেক কিছুতে পরিবর্তন হলেও রাসুল(সা.) এই গোত্রের হাতেই কাবাঘরের চাবিটি রেখে দেন। ফলে তারাই কাবাঘরের আনুষ্ঠানিক সেবক।

মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত কাবার তত্ত্বাবধায়ন ও চাবি রক্ষকের দায়িত্ব ছিল ওছমান বিন তালহার উপর । মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল (সা.) কাবার ভেতরে প্রবেশের জন্য তার নিকট চাবি চাইলেন । ওছমান বিন তালহা বাড়ি গিয়ে তার মায়ের নিকট চাবি চাইলে তার মা চাবি দিতে অস্বীকার করে, ওছমান বিন তালহা জোর করে চাবি নিয়ে আসেন । রাসুল(সা.) কাবার দরজা খুলে ওছমান বিন তালহাকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন এবং কাবা শরীফ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বের হয়ে আসেন।এরপর কাবা শরীফের চাবির দায়িত্ব চিরদিনের জন্য ওছমান বিন তালহার গোত্রের উপর অর্পণ করলেন । যদিও এই চাবির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আলী ও আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিব চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়।মক্কা বিজয়ের দিন ভাষণ শেষে আল্লাহর রাসুল(সা.) মসজিদুল হারামে বসে পড়লেন। এমন সময় চাবি হাতে নিয়ে হযরত আলী (রা) এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল(সা.) আমাদেরকে হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্বের সাথে সাথে কাবার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্বটাও অর্পণ করুন। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, এই দাবীটি চাচা হযরত আববাস (রা) করেছিলেন।
রাসুল(সা.) বললেন, ‘ওছমান বিন তালহা কোথায়? অতঃপর তিনি এলে তাকে বললেন ‘এই নাও তোমার চাবি হে ওছমান! আজ হলো সদাচরণ ও ওয়াদা পূরণের দিন। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহর রাসূল (সা) একথাও বলেন ‘তোমরা এটা গ্রহণ কর চিরদিনের জন্য। তোমাদের কাছ থেকে কেউ এটা ছিনিয়ে নেবে না যালেম ব্যতীত। হে ওছমান! আল্লাহ তাঁর গৃহের জন্য তোমাদেরকে আমানতদার করেছেন, অতএব এই গৃহ থেকে ন্যায়সঙ্গত ভাবে যা তোমাদের কাছে আসবে, তা তোমরা ভক্ষণ করবে ।উল্লেখ্য যে, জাহেলি যুগ থেকেই বনু হাশিমের উপরে এবং সে হিসাবে ইসলামী যুগের প্রাক্কালে হযরত আববাস-এর উপরে হাজীদের পানি পান করানোর এবং ওছমান বিন তালহার উপরে কাবার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল। ওছমান বিন তালহা ৭ম হিজরীর ১ম দিকে মদিনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন। সেই থেকে আজও কাবার চাবি দায়িত্ব মক্কার বনি শাইবাহ গোত্রের উপর । এই বনি শাইবাহ ওছমান বিন তালহার চাচাতো ভাই শাইবা ইবন উসমান ইবন আবি তালহার বংশধর।মক্কা বিজয়ের পর হযরত উসমান ইবন তালহা মদীনায় চলে যান এবং রাসুল(সা.) এর মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন।
১৩৯৬ হিজরি সালে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ খালেদ ২৮৬ কেজি স্বর্ণ দিয়ে বর্তমান দরজাটি তৈরি করেছেন। দরজায় আল্লাহ তায়ালার নাম এবং কুরআনের আয়াত লেখা রয়েছে। কাবা শরিফের দরজাটি দুই পাল্লার। মাঝে আছে তালা লাগানোর ব্যবস্থা। বনি শাইবাহ গোত্রের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি কাবার চাবি বহন করেন। চাবিটি বিশেষ ব্যাগে রাখা হয়। এই ব্যাগটি পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির কারখানায় বানানো। এখন পর্যন্ত কাবার চাবি কখনও হারায়নি। তবে বহু বছর পূর্বে এক ব্যক্তি চাবি চুরির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে সফল হয়নি।প্রথম আমলের তালা যেমন এখন আর নেই, চাবিও নেই। তবে সেই পুরনো যুগের চাবিগুলো অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়।কাবা শরিফে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৮টি তালা ব্যবহার করা হয়েছে। এ সব তালা ও চাবি বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ঐতিহাসিক তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরেই রয়েছে ৫৪টি চাবি।The shape of the key changes every now and then. There is a museum in Turkey with 48 keys to the Kaaba since the Ottoman era, while in Saudi Arabia there are two replicas of the key that are made of pure gold.এ ছাড়া প্যারিসের বিশ্বখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামেও পবিত্র কাবার ২টি চাবি রয়েছে। আরেকটি চাবি সংরক্ষিত আছে কায়রোতে অবস্থিত ইসলামিক আর্ট মিউজিয়ামে।
২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর, সর্বশেষ কাবা ঘরের চাবি পরিবর্তন করা হয়।’ সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সির বরাত দিয়ে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘২০০৯ সালে সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজ সিটি সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিকে (KACST) কাবা ঘরের পুরাতন তালাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।রাজকীয় ফরমান বলে, কাস্টের একটি বিশেষজ্ঞ দল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২০১৩ সালের শেষের দিকে ৩০ বছরের পুরনো মরচে ধরা তালা পরিবর্তন করে। তারা ১৮ ক্যারট সোনা দিয়ে তৈরি একটি নতুন তালা লাগিয়ে দেন। বর্তমান এই তালাটির চাবির দৈর্ঘ্য ৩৫ সেন্টিমিটার। পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির কারখানায় তৈরি একটি বিশেষ ব্যাগে করে এ চাবিটি সংরক্ষণ করা হয়।

গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...