সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইমাম আবু হানিফা নাম নিয়ে যত বানোয়াট গল্প


ইমাম আবু হানিফা ছিলেন ফিকহশাস্ত্রের একজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং হিজরী প্রথম শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব। ইসলামী ফিকহের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও পরিচিত চারটি সুন্নি মাযহাবের একটি হানাফি মাযহাব এর প্রধান ব্যক্তিত্ব তিনি। ইমাম আবু হানিফার নাম কেন নোমান বিন সাবিত থেকে ‘আবু হানিফা’ হলো, তা নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। অথচ গল্পটা সম্পূর্ণ বানোয়াট ।আরেকটি গল্প সেদিন এক বক্তার মুখে শুনলাম । দুটো গল্পের একটিও সঠিক নয়। আসলে ইমাম আবু হানিফার নাম সম্বন্ধে অনেক ফতোয়া দেয়া হয়, সেসবের সাথে ইমাম আবু হানিফার নামকরণের কোনো মিল নেই।
এক
একদিন ইরাকের কয়েকজন মহিলা ইমাম আযম আবু হানিফার কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, একজন পুরুষ যদি একত্রে চারজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে তাহলে একজন মহিলা একত্রে দুজন স্বামী গ্রহণ করতে পারেনা কেন? আবু হানিফা তখন এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ হলেন। তিনি তখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে উক্ত ঘটনাটি নিজ কন্যা হানিফার নিকট বললেন। সে বলল, “আব্বা! আমি যদি এর সমাধান দিতে পারি তাহলে আমার নামটি আপনার নামের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। প্রস্তাবে রাজি হয়ে আবু হানিফা মহিলাদেরকে স্বীয় কন্যার নিকট পাঠালেন। মেয়ে হানিফা আগত সকল মহিলার হাতে এক গ্লাস করে দুধ দিয়ে সকলের দুধ একত্রে একটি পাত্র রাখার জন্য বললেন। কিছুক্ষণ পর বললেন আপনাদের যার যার দুধ আলাদা করে নিয়ে নেন। মহিলারা বলল-“এটা কি করে সম্ভব?” হানিফা তখন বললেন, “তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে একজন মহিলার একাধিক স্বামী থাকার ফলে যখন সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, তখন উক্ত সন্তান কোন স্বামীর, এটা কিভাবে চিনা যাবে আপনারাই বলুন।” একথা শুনে মহিলারা আবু হানিফার কন্যা হানিফার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে প্রস্থান হলেন।অতঃপর ওয়াদা অনুযায়ী ইমাম নোমান ইবনে সাবিত নিজ নামের সাথে উনার কন্যার নাম সংযুক্ত করলেন।তাঁর নতুন নাম হল আবু হানিফা। অর্থাৎ হানিফার পিতা। সেই থেকে ইতিহাসের পাতায় পাতায় পিতা ও কন্যার নাম লেখা শুরু হয়ে গেল।এই ঘটনাটি তাযকেরাতুল আউলিয়া গ্রন্থে আছে।
দুই
ইমাম আযম আবু হানিফার মেয়ে হানিফা ইন্তেকালের পর তিমি খুব ভেঙ্গে পড়লেন তখন তার সাথিরা বললেন হুজুর মন খারাপ করবেন না । আজ থেকে আপনার মেয়ের নামে আপনি পরিচিত হবেন ।আপনাকে সবাই ডাকবো আবু হানিফা বলে ,অর্থাৎ হানিফার পিতা। এভাবে তাঁর মূল নাম ঢাকা পড়ে যায়।এই গেল দুটো ঘটনা । জানি না আর কত ঘটনা তাঁর নামে প্রচলিত আছে। তিনি যে তার মেয়ের নামে পরিচিত না ,তা নিয়ে এবারের আলোচনায় আসি ।
প্রথমতঃ গল্পে সুন্দর করে ইমাম আবু হানিফার নামকরণের পিছনে তাঁর কন্যার কথা উল্লেখ করা হলো। অথচ, ইমাম আবু হানিফার কোনো মেয়েই ছিল না। একথা সুনিশ্চিত যে, ইমাম আবু হানিফার নাম নোমান বাবার নাম সাবিত । বাবার সাথে মিলিয়ে উনার নাম নোমান বিন সাবিত।লকব ইমাম আযম। ইমামে আযম নোমান বিন সাবিত (রাহ).-এর কুনিয়াত তথা উপনাম আবু হানিফা। কিন্তু এই উপনামের কারণ কী তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল । তাঁর সন্তানাদির মধ্যে কেবল ‘হাম্মাদ’-ই হলেন প্রসিদ্ধ; যিনি নিজ পিতার কাছেই ইলম অর্জন করেন। এই ‘হাম্মাদ’ ছাড়া তাঁর অন্য কোনো সন্তান ছিল কি না এবং তাদের নাম ও জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না।কেউ কেউ বলেছেন যে, হানিফা নামে ইমাম আযম (রাহ).-এর একজন কন্যা সন্তান ছিলেন, সে হিসেবে তাঁর উপনাম আবু হানিফা হয়েছে। কিন্তু এ মতের পক্ষে শক্তিশালী কোনো দলীল পেশ করা হয়নি। এছাড়াও অন্যরা ভিন্ন কারণও উল্লেখ করেছেন। ( উক‚দুল জুমান, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ সালেহী পৃ. ৪১)।
দ্বিতীয়তঃ এখন প্রশ্ন হলো , ইমাম সাহেবের যেহেতু কোন মেয়েই ছিলো না তাহলে তিনি আবু হানিফা হলেন কিভাবে? আরবিতে আবুন অর্থ বাবা , উম্মুন মানে মা হলেও সব সময় আবুন মানে বাবা হয় না, উম্মুন মানে মা হয় না। যেমন, উম্মুহূ সিদ্দীক্বাহ -অর্থ তার মা সত্যবাদী । হযরত আয়েশা (রা)-এর উপনাম উম্মে আব্দুল্লাহ বা আব্দুল্লাহর মা; অথচ আয়েশা (রা)-এর কোনো সন্তান ছিল না। আবুন অর্থও সব সময় বাবা হয় না ।কখনো ওয়ালা অর্থেও আসে ।
হযরত আলী (রা) একদিন মসজিদে নববিতে শুয়ে ছিলেন । শরীর ছিল ধূলোমাখা । দেখে মনে হচ্ছিলো , সারা গায়ে বুঝি মাটি মেখে বসে আছেন । ঠিক সেই সময় রাসুল (সা) উপস্হিত হলেন।আলীকে এই অবস্হায় দেখে মজা করে বলে উঠলেন , ইয়া আবাত তুরাবা।হে মাটির বাপ ! হযরত আলী (রা) সন্তানদের মধ্যে কারো নাম তুরাব ছিল না । আর রাসুল (সা) যখন আলীকে আবু তুরাব বলেছিলেন তখন তো ফাতেমা (রা) এর গর্ভে জন্ম নেওয়া আলীর তিন ছেলের নাম ছিল হাসান, হোসাইন, এবং মুহসিন । কেউ তুরাব নামে পরিচিত ছিল না । থাকার কারণও ছিল না । মাটি কারো নাম হয় না । অবশ্য বাঙ্গালিদের মাঝে তুরাব আলী নামের মানুষেরও দেখা মিলে । এটা অর্থের দিকে খেয়াল না করেই কেউ কেউ রেখে দেয় হয়তো । রাসুল (সা) যে আলীকে হে আবু তুরাব বলেছিলেন , তার অর্থ হে মাটির বাবা নয় এর মানে হলো হে মাটিওয়ালা । আবু হুরায়রাহ (রা) এর মূল নাম ছিল আব্দুর রাহমান। এমন তো না যে , বিড়ালছানা তার মেয়ে ছিল । তারপরেও তিনি আবু হুরায়রাহ কেন?কারণ তিনি বিড়াল পছন্দ করতেন এবং সাথে সাথে রাখতেন ।একদিন হুজুর (সা) এর সামনে চাদরের নিচ থেকে বিড়ালের বাচ্চাটি বেরিয়ে পড়েছিল । হুজুর সা) মজা করে বলে উঠলেন , ' ইয়া আবা হুরাইরা '! সেদিন থেকে তিনি হয়ে গেলেন আবু হুরায়রাহ বা বিড়ালওয়ালা ।
তৃতীয়তঃমূলত আবু হানিফা উপনামটা এসেছে হানিফ শব্দ থেকে। ইব্রাহীম (আ)-এর ধর্মের নাম ছিল হানিফ ধর্ম। যারা একনিষ্ঠভাবে এবং শিরক মুক্তভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তাদেরকে হানিফ বা হানিফা বলা হতো। মুহাম্মাদ (সা) এর জাতি ভাই উমাইয়া বিন আবি সালাম এবং হযরত খাদিজা ও তাঁর চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফেল প্রমুখ ব্যক্তি সেই সময় একেশ্বরবাদ তথা হানাফি ছিল।ইমান আবু হানিফা যেহেতু তাওহীদ ও আকীদা বিষয়ে অনেক সমস্যার সমাধান দিয়েছেন, এবং অনেক হানিফ তাঁর অনুসরণ করেছিলেন, তাই তাঁকে আবু হানিফা নামে ডাকা হতো। । যেমন সুরা ইমরানে বলা আছে ,ইবরাহীম ইয়াহূদীও ছিল না, নাসারাও ছিল না; বরং সে ছিল একনিষ্ঠ(হানিফ)মুসলিম।আর সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।(আয়াত -৬৭)।এই আয়াতে হানিফ একনিষ্ঠ মুসলিম অর্থাৎ শিরক থেকে বিমুখ হয়ে কেবল এক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী।.হযরত রাসুল (সা) বলেছেন , আমি আমার বান্দাদেরকে হানিফ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ রুপে সৃষ্টি করেছি । অতঃপর শয়তান তার পিছে লেগে তাকে আল্লাহর পথ থেকে দুরে নিয়ে যায় ।( সহিহ মুসলিম , হাদিস নং ২৮৫৬)। According to Ibn Hajar al-Haythami, the name of Noman bin Sabit belongs to the founder of Hanafism, is Abu Hanifa. He is the father of those who have good faith (hanifs) and not, as might be believed, due to having a daughter called Hanifa.

গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...