মুসলিম জাগরণের আল কুদস দিবস আজ
কুদস অর্থ পবিত্র।জেরুযালেম শহরের অপর নাম কুদস বা আল-কুদস। মুসলমানদের কাছে জেরুজালেম শহরটি আল-কুদস নামে পরিচিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আল কুদসের (জেরুজালেম) এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে একজন নবী নামাজ আদায় করেননি বা কোনো ফেরেশতা দাঁড়াননি।’ (তিরমিজি)। আল কুদস হলো ফিলিস্তিনের জেরুজালেম পবিত্র ভূমিতে অবস্থিত পবিত্র মসজিদ, যা মসজিদুল আকসা ও বায়তুল মোকাদ্দাস নামে পরিচিত। মুসলমানদের কাছে বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা সব সময় সম্মানিত। মহানবী (সা)-এর নবুওয়াতের ঘোষণার পর থেকে মুসলমানদের কাছে বায়তুল মোকাদ্দাস পবিত্র স্থান হিসাবে গণ্য হতে থাকে। কুরআন শরিফে বায়তুল মোকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘(স্মরণ করো, মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন, এতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাৎপসারণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-২১)।হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, হযরত আদম (আ.) মক্কায় কাবাঘর নির্মাণের চল্লিশ বছর পর বায়তুল মুকাদ্দাসে মসজিদুল আকসা নির্মাণ করা হয়। হযরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবা ঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর, তদীয় পুত্র হযরত ইসহাক (আ.)–এর সন্তান হযরত ইয়াকুব (আ.) ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নামক স্থানে আল আকসা মসজিদটি নির্মাণ করেন। অতঃপর তদীয় পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.)–এর বংশধর হযরত দাউদ (আ.)–এর সন্তান হযরত সুলাইমান (আ.) তা পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জেরুজালেম নগর প্রতিষ্ঠা করেন।
রাসুল (সা.) মিরাজ রজনীতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাস প্রথম সফর করেন, যা ইসরা নামে পরিচিত। রাসুল (সা.)-এর পবিত্র মেরাজ বেহেশতি বাহন বোরাকে চড়ে শুরু হয়েছিল এখান থেকেই। পবিত্র আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত- যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’(সূরা আল ইসরা- ১) প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজ গমনের সময় বায়তুল মুকাদ্দাসে সব নবী রাসুলের ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন। এতে তিনি ইমামুল আম্বিয়া সব নবীর ইমাম ও সাইয়েদুল মুরসালিন সব রাসুলের সরদার হিসেবে স্বীকৃত হন।
প্রথমে কাবা কিবলা থাকলেও মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস স্থাপনের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ওহি লাভ ও নবুওয়ত প্রকাশের সময় বায়তুল মুকাদ্দাসই কিবলা ছিল। মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই কিবলা পরিবর্তন হয়ে পুনরায় কাবা কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়। মদিনা থেকে মক্কা দক্ষিণ দিকে এবং বায়তুল মুকাদ্দাস উত্তর দিকে। নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কিরামসহ জামাতে জোহরের নামাজে আদায়রত অবস্থায় কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ আসে।তখন নামাজ অবস্থায় নবীজি (সা.) ও সাহাবাগণ উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে ঘুরে গিয়ে কাবামুখী হয়ে কিবলা পরিবর্তন করে নামাজ সম্পন্ন করেন। মদিনা শরিফে মসজিদুল কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদও রয়েছে। ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে তাহবিলে কিবলা বা কিবলা পরিবর্তন বলা হয়। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত ১৪২-১৫১)। এই থেকেই ইসলামের দ্বিতীয় কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কিবলা হিসেবে পরিচিত হয়। পবিত্র নগরী বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মক্কা মু’আজ্জামা ও মদিনা মুনাওয়ারার পর ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান। এ এলাকা অসংখ্য নবী রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত, এর আশপাশে অনেক নবী রাসুলের সমাধি রয়েছে। এটি দীর্ঘকালের ওহি অবতরণস্থল, ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ও ইসলাম প্রচারের লালনক্ষেত্র। বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন- এ পবিত্র নামগুলো মুসলমানদের ঈমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।এই পবিত্র ভূমির ভালোবাসা প্রোথিত রয়েছে প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ের গভীরে।যে তিনটি মসজিদের উদ্দেশে ইবাদতের নিয়তে সফরের অনুমতি আছে, তার মধ্যে একটি হলো বায়তুল মুকাদ্দাস । বাকি দুটি হলো- মসজিদে হারাম (মক্কা) ও মসজিদে নববী (মদিনা)। (বুখারি-১১৮৯; মুসলিম-১৩৯৭)। এর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ঘরে নামাজ পড়লে এক গুণ, মসজিদে ২৫ গুণ, মসজিদে নববী ও আকসায় ৫০ হাজার গুণ, মসজিদে হারামে এক লাখ গুণ সওয়াব।’(ইবনে মাজাহ)।
খলিফাতুল মুসলিমিন ফারুকে আজম হজরত উমর (রা.)–এর খিলাফতকালে ৬৩৮ সালে বাইতুল মুকাদ্দাস ও জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অধিকারে আসে। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ক্রুসেডার খ্রিস্টানরা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার পর বায়তুল মুকাদ্দাসের বিভিন্ন ইসলামী স্থাপনায় পরিবর্তন করে, বিশেষ করে মসজিদুল আকসাকে গির্জায় পরিণত করে।ইউরোপীয়রা বায়তুল মুকাদ্দাস দখলের জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করে। প্রায় ২০০ বছর পর্যন্ত ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাত-আটটি ক্রুসেড পরিচালনা করে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ক্রুসেডাদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে আবারও মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন।এরপর থেকে খ্রিষ্টান ও ইহুদি চক্র ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে; অল্প সময়ের মধ্যে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দাঙ্গা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এ সময় ব্রিটিশরা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ফিলিস্তিন ভূমিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়।ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইহুদিরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের কচুকাটা করতে থাকে। তাদের অত্যাচারে জর্জরিত আরবরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এ সত্ত্বেও তখনও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের দখলে ছিল। কিন্তু আরবদের দুর্বলতার মুখে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তা মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়।১৯৬৯ সালে ইহুদিরা বায়তুল মুকাদ্দাসে অগ্নিসংযোগ করে।ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের আবাসভূমি ও আল-কুদস (বায়তুল মুকাদ্দাস) উদ্ধারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের সংগ্রামে দিশেহারা হয়ে ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে কিছুসংখ্যক নেতাকে আপসকামী ভূমিকায় নিয়ে আসে। তথাকথিত শান্তি আলোচনার সুযোগে তারা একে একে ফিলিস্তিনের প্রকৃত সংগ্রামী নেতাদের হত্যা করে চলেছে এবং ফিলিস্তিনের নতুন নতুন এলাকা দখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে, এমনকি ফিলিস্তিনে মানবিক ত্রাণসহায়তা পৌঁছাতে পর্যন্ত বাধা দিচ্ছে। এ ধরনের অমানবিক কার্যক্রম তারা এখনও অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া তারা ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে বারবার বিমান হামলা চালিয়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ এ পর্যন্ত কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার বাড়িঘর, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল ধ্বংস করেছে। ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসলীলা আজ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক, ইয়ামেন, লিবিয়া, বাহরাইনসহ গোটা আরব বিশ্বে মুসলিম দেশগুলোর জায়নবাদী আগ্রাসন ছড়িয়ে পড়েছে। জায়নবাদী ষড়যন্ত্রের ফাঁদে কোনো কোনো মুসলিম শাসক পতিত হয়েছেন। ফলে লাখ লাখ মুসলিম হত্যার শিকার হয়েছে। কোটি মুসলিম নিজ বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এবং সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকে সাগরে ডুবে মরছে। আবার বোমা মেরে বিভিন্ন স্থাপত্যশিল্প মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
ইহুদিবাদীদের পরিকল্পনা ছিল গোটা আরববিশ্ব দখল করার। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সংগ্রামের পাশাপাশি অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের জনগণও আজ জেগে উঠছে। তারা নিজ নিজ দেশে শান্তি ও মুক্তির সংগ্রামের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইহুদি আগ্রাসনের শুরুর দিন থেকেই কোনো না কোনো গ্রুপ প্রতিরোধ সংগ্রাম করে যাচ্ছে। হামাস, আল জিহাদ, হিজবুল্লাহ এক্ষেত্রে আশাজাগানিয়া ভূমিকা রাখছে। ফলে সাম্প্রতিক দশকে তিনবার ইসরাইল যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। অন্যদিকে ওআইসি, ন্যাম, জাতিসংঘ সবসময়ই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে আসছে। বিশ্বজনমত আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং আরববিশ্বের ক্যান্সার খ্যাত ইসরাইলের বিপক্ষে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আল কুদস মুক্তির দাবিতে সোচ্চার বিশ্বের সব ইসলামী পক্ষ। শিয়া-সুন্নি, আরব-অনারবসহ সবাই বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও আল কুদস-ফিলিস্তিনের মুক্তির কথা বলে। এ ঐক্যে ফাটল ধরানোর বহুবিধ প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। এরই পাশাপাশি ইহুদিবাদী চক্রের এজেন্টরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো সৃষ্টি করেছিল। যারা পরস্পরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে থাকে। এসব জঙ্গিগোষ্ঠী নিজেদের ইসলামী বলে দাবি করলেও ফিলিস্তিন-আল কুদসের ব্যাপারে যেমন কোনো কথা বলে না, তেমনি ইসরাইলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেরও প্রতিবাদ করে না। উপরন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তাদের উগ্র হাঙ্গামার কারণে ফিলিস্তিন ও আল কুদস ইস্যু ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। এতে আল কুদসের মুক্তির ব্যাপারটা মুসলমানদের দৃষ্টির অন্তরালে চলে যাচ্ছে। আবার ইসলামের দোহাই দিয়ে মাজহাবি বিতর্ক চাঙ্গা করে ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা নিরীহ নারী-পুরুষ এবং শিশুদেরও নির্বিচারে হত্যা করছে। ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন নতুন দল ও উপদল সৃষ্টি করে সমরাস্ত্র, অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে যুদ্ধের বিস্তার ঘটানোর মাধ্যমে মুসলমানদের শক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছে। একই সঙ্গে তারা এ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের মূল সমস্যা ফিলিস্তিনের বিষয়টি থেকে মুসলমানদের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে দেয়ার এবং মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে মোড়লিপনা করে যাচ্ছে আমেরিকা। ইতিমধ্যে ইসরাইল তাদের রাজধানী তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের ঘোষণা দেয় এবং আমেরিকা সেই ঘোষণা সমর্থন করে। গত বছরের ১৪ মে আমেরিকার দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের সময় নিরস্ত্র প্রতিবাদী ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের বর্বর সেনাবাহিনীর গুলিতে শতাধিক ফিলিস্তিনি মুসলিম শহীদ হন এবং বর্বোরচিত হামলায় আহতের সংখ্যা প্রায় ২,৫০০। গত বছরের ১৫ মে ছিল ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি দখলদারিত্বের তথা মহাবিপর্যয়ের (নাকাবা) ৭০ বছর। এদিন উপলক্ষে আয়োজিত তাদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চালানোর কোনো বৈধতা ইসরাইলের নেই। সম্পূর্ণ অন্যায় ও বর্বরোচিতভাবে ফিলিস্তিনিদের যুগের পর যুগ হত্যা করে আসছে ইসরাইল। এর প্রতিবাদে সমগ্র মুসলিমবিশ্ব প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছু আরব শাসক ইসরাইলি এ নৃশংসতার প্রতিবাদ না করে পরোক্ষভাবে তাদের ঘৃণ্য কাজে সহযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে।
সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামকে চিরতরে নিঃশেষ করার লক্ষ্যে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি (ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি/শতাব্দীর সেরা চুক্তি) স্বাক্ষর করেছে। যে মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ বিশ্বের প্রায় সব পক্ষ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে মেনে নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছার জন্য তৎপর, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কতিপয় আরব রাষ্ট্রের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রকে সমূলে বিনাশ করার লক্ষ্যে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে শতাব্দীর সেরা চুক্তি (!) স্বাক্ষর করে তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
এ চুক্তি মোতাবেক স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। গাজা উপত্যকা, জিহুদিয়া পার্বত্য অঞ্চল ও পশ্চিম তীরের সামারিয়া অঞ্চল নিউ প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত হবে। আর বাকি সব অঞ্চল, এমনকি এসব এলাকার ইহুদি বসতিগুলো সব স্বাধীন রাষ্ট্র ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। জেরুসালেম ইসরাইল ও নিউ প্যালেন্টাইনের যৌথ রাজধানী হবে। আরবরা নিউ প্যালেস্টাইন এবং ইহুদিরা ইসরাইলের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। নিউ প্যালেস্টাইনের কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। হালকা অস্ত্রধারী পুলিশ থাকবে। বহিঃশত্রু থেকে তাদের রক্ষার দায়িত্বে থাকবে ইসরাইল। অর্থাৎ সেনাবাহিনী অস্ত্রভাণ্ডার সবই থাকবে ইহুদিদের ও ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরাইলি পৌরসভার হাতে।
পিএলও, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি করে এর বাস্তবায়ন করা হবে। পিএলও যদি চুক্তিতে রাজি না হয়, তাহলে তাদের সব সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হবে। অন্যদিকে হামাস যদি রাজি না হয়, তাহলে সরাসরি যুদ্ধ করে হামাসকে নির্মূল করে দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে ইসরাইলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশগ্রহণ করবে। সৌদি আরব, মিসর, আমিরাত ও জর্ডান এ চুক্তির পক্ষে ইতিমধ্যে প্রচারণা শুরু করেছে। সৌদি যুবরাজ পিএলওকে বিশাল অঙ্কের অর্থ আর সাহায্যের কথা বলে চাপ সৃষ্টি করছে।
মূলত পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস তথা আল কুদসের মুক্তি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সংগ্রামকে সমূলে বিনাশ করার জন্যই ইসরাইলের জন্মদাতা ব্রিটিশ, আমেরিকা এবং ইহুদিদের বন্ধু কতিপয় আরব রাষ্ট্র এক মহাষড়যন্ত্রের খেলায় মাঠে নেমেছে। তাই আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং এ নতুন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের কবল থেকে আল কুদস আল শরিফের মুক্তি এবং স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির একমাত্র পথ। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পূর্বে ফিলিস্তিনে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টানরা একত্রে শান্তিতে বসবাস করছিল। যখন ইসরাইল ফিলিস্তিন দখল করে তখনই ফিলিস্তিন সমস্যা তৈরি হয়। ইসরাইল ফিলিস্তিন ইস্যুকে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। এ কারণেই ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনি (র.) এটিকে সারা বিশ্বের মুসলমানদের সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে মসজিদুল আকসাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে রমজান মাসের শেষ শুক্রবার ‘বিশ্ব কুদস দিবস’ ঘোষণা করেন। তিনি ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে বিষাক্ত টিউমার বা ক্যান্সার বলে অভিহিত করে ফিলিস্তিনের সংগ্রামী জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের অধিকারের প্রতি সাহায্য-সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার জন্য রমযানের শেষ শুক্রবারে নানা কর্মসূচি, অনুষ্ঠান ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন ঘোষণার আহ্বান জানান। বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব তার এই আহবানে ব্যাপক সাড়া দেয় এবং এই দিনকে কুদস দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে।
গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন