মাছের পেটে হযরত ইউনুস (আ.) অতঃপর


ছবিঃ মসুলের একটি পাহাড়ের উপর হযরত ইউনুস (আ.)এর কবর অবস্থিত। 
হযরত ইউনুস (আ.) ছিলেন একজন আল্লাহর নবি।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় ইউনুসও ছিল রসূলদের একজন।( সুরা আস সাফফাত আয়াত-১৩৯)।তাঁর পিতার নাম ছিল 'মাত্তা'।বুখারী শরীফের একটি হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে এ কথা জানা যায়। হযরত ইউনুস (আ.) এর নাম 'ইউনাহ' এবং তাঁর পিতার নাম 'আমতা' বলা হয়েছে। কোরআনে ছয়টি সূরায় মোট ১৮ বার হযরত ইউনুস (আ.) এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সূরাগুলো হলো- আনআ'ম, ইউনুস, আস ছাফ্‌ফাত, আল আম্বিয়া, এবং আল ক্বলম।আল কুরআনে তাকে ইউনস,যুননুন ও সাহিবুল হুত নামে অভিহিত করা হয়েছে।সূরা ইউনুস ৯৮ আয়াতে তাঁর নাম ইউনুস, সূরা আম্বিয়া ৮৭ আয়াতে ‘যুননুন এবং সূরা ক্বলম ৪৮ আয়াতে তাঁকে ‘ছাহেবুল হূত বলা হয়েছে। ‘নূন’ ও ‘হূত’ উভয়ের অর্থ মাছ।যুননুন ও ছাহেবুল হূত অর্থ মাছওয়ালা। হযরত ইউনুস (আ.) কে আসিরিয়ানদের হেদায়াতের জন্য ইরাকে পাঠানো হয়েছিল। এ কারণে আসিরীয়দেরকে ইউনুসের কওম বলা হয়েছে। সে সময় এ কওমের কেন্দ্র ছিল ইতিহাস খ্যাত নিনোভা (বর্তমান মসুল) নগরী। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এ নগরীর ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। দাজলা নদীর পূর্ব তীরে আজকের মসুল শহরের ঠিক বিপরীত দিকে এ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এ জাতির রাজধানী নগরী নিনোভা প্রায় ৬০ মাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত ছিল। এ থেকে এদের জাতীয় উন্নতির বিষয়টি অনুমান করা যেতে পারে। এখানে আশুরীদের শাসন ছিল, যারা এক লক্ষ বানী ইস্রাঈলকে বন্দী করে রেখেছিল। ২৮ বছর বয়সে হযরত ইউনুস (আ.) নুবূয়্যত লাভ করেন এবং আসিরীয়দেরকে দাওয়াত দিতে আদিষ্ট হন।আল্লাহ বলেন , তাকে আমি এক লাখ বা তার বেশী লোকের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম। (সুরা আস সাফফাত -১৪৭) ।সুতরাং তাদের হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তাআলা তাদের নিকট হযরত ইউনুস (আ.) কে প্রেরণ করলেন।
ইউনুস মসজিদ মসুল ,ইরাক
 কিন্তু তারা তাঁর উপর ঈমান আনল না। শেষে তিনি নিজ সম্প্রদায়কে এই বলে ভীতিপ্রদর্শন করলেন যে, তোমরা অতি সত্বর আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে। হযরত ইউনুস (আ.) যখন আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তিন দিন পর আযাব আসার দুঃসংবাদ শুনিয়ে দেন। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় যে, আযাব আসেনি,নিনোভার অধিবাসীরা তারা তাদের রাসূলের মুখে যে আযাব আসার কথা শুনেছিল সেটার বিভিন্ন উপসর্গ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যখন মেঘের মত তাদের উপর আযাবের লক্ষণাদি দেখা দিল, তখন তারা শিশু, নারী এমনকি জীবজন্তু সমেত এক মাঠে সমবেত হল এবং আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতির সাথে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে আরম্ভ করল। আল্লাহ তায়ালা তাদের তওবা কবুল করে তাদের উপর থেকে আযাব রহিত করে দিলেন। আল্লাহ বলেন, সুতরাং কোন জনপদ বিশ্বাস করল না কেন, যাদের বিশ্বাস উপকারী হত; ইউনুসের সম্প্রদায়ের ব্যাপারটি স্বতন্ত্র, যখন তারা বিশ্বাস করল, তখন আমি তাদের থেকে পার্থিব জীবনে অপমানজনক শাস্তি বিদূরিত করে দিলাম এবং এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত তাদেরকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান করলাম। (সুরা ইউনুস আয়াত -৯৮)।হযরত ইউনুস (আ.) পথচারী পথিকের নিকট থেকে নিজ সম্প্রদায়ের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে থাকলেন। পরিশেষে তিনি যখন জানতে পারলেন যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্প্রদায়ের উপর থেকে আযাব রহিত করে দিয়েছেন, তখন যেহেতু সেই সম্প্রদায় তাকে মিথ্যাজ্ঞান করেছিল, তাই তিনি সেই সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে যাওয়া পছন্দ করলেন না।হযরত ইউনুস (আ.) নিজ সম্প্রদায়কে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বরং তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি অন্য কোন দিকে চলে গেলেন। হযরত ইউনুস (আ.) - আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদন আসার পূর্বেই হিজরতের উদ্দেশ্যে নৌকায় আরোহণ করে বসেন। সূরা আস-সাফফাতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে “স্মরণ করুন, যখন তিনি বোঝাই নৌযানের দিকে পালিয়ে গেলেন।” ( সুরা আস-সাফফাত আয়াত- ১৪০)। অন্য সূরায় এসেছে, “আর স্মরণ করুন, যুন-নূন-এর কথা, যখন তিনি ক্রোধ ভরে চলে গিয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন যে, আমরা তাকে পাকড়াও করব না।” (সুরা আল-আম্বিয়া আয়াত- ৮৭)। যাত্রী ও মাল-সামানে নৌকা পরিপূর্ণ ছিল। নৌকা সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে পড়ে যায় ও দাঁড়িয়ে যায়। সুতরাং তার ভার কম করার জন্য এক ব্যক্তিকে নৌকা থেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে নৌকার অন্য সব যাত্রীরা বেঁচে যায়। কিন্তু এই ত্যাগ করার জন্য কেউ তৈরী ছিল না, যেকারণে লটারি করতে হয়। সে লটারিতে হযরত ইউনুস (আ.)-এর নাম আসে এবং তিনি অসহায়দের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান; অর্থাৎ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পালিয়ে যাওয়া দাসের মত নিজেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে হয়। এদিকে আল্লাহ তায়ালা তিমি মাছকে আদেশ করেন যে, তাঁকে যেন পূর্ণ গিলে ফেলে। এই ভাবে হযরত ইউনুস (আ.) আল্লাহর আদেশে মাছের পেটে চলে যান।আল্লাহ বলেন, পরে (তাকে নৌকা হতে সমুদ্রে ঠেলে দেওয়া হলে) এক বিরাট মাছ তাকে গিলে ফেলল, তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। (আস সাফফাত-১৪২)।কাতাদাহ বলেন, তিনি নৌকায় উঠার পর নৌকাটির চলা থেমে গেল। তখন লোকেরা বুঝল যে, কোন ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে এটা আটকে গেছে। তখন তারা লটারি করল। তাতে হযরত ইউনুস (আ.) এর নাম আসল। তখন তিনি তার নিজেকে সাগরে নিক্ষেপ করলেন আর তখনি একটি বড় মাছ তাকে গিলে ফেলল। (তাবারী)।যখন তিনি মাছের পেটে পৌঁছলেন তখন আল্লাহকে স্মরণ করলেন এবং তারই প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করতে থাকলেন। অন্যত্র বলা হয়েছে, “তাই সে অন্ধকারের মধ্যে তিনি ডেকে উঠলেন, আপনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই,পাক-পবিত্র আপনার সত্তা, অবশ্যই আমি অপরাধী।” (সূরা আল আম্বিয়া আয়াত- ৮৭)।মাছের পেটে ৪০ দিন থাকার পর  হযরত ইউনুস (আ.) কে মাছ উগড়ে ফেলে।আল্লাহ বলেন-অতঃপর ইউনুসকে আমরা নিক্ষেপ করলাম এক তৃণহীন প্রান্তরে এবং তিনি ছিলেন অসুস্থ। (আস সাফফাত.১৪৫)। ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত, এর অর্থ,নদীর তীরে। ঐ সকল লতা গাছকে বলা হয়, যা নিজ কান্ডের উপর দাঁড়াতে পারে না, যেমন লাউ, কুমড়া ইত্যাদির গাছ। অর্থাৎ, সেই বালুচরে, যেখানে না কোন গাছ-পালা ছিল আর না ছিল কোন ঘর-বাড়ী । সেখানে একটি ছায়াবিশিষ্ট বৃক্ষ উদগত করে তাকে রক্ষা করলাম। মোটকথা সেখানে অলৌকিকভাবে এমন একটি লতাবিশিষ্ট বা লতানো গাছ উৎপন্ন করা হয়েছিল যার পাতাগুলো ইউনুসকে ছায়া দিচ্ছিল এবং ফলগুলো একই সংগে তার জন্য খাদ্য সরবরাহ করছিল এবং পানিরও যোগান দিচ্ছিল।( তাবারী)। সুস্থ হওয়ার পর তাকেঁ আবার আসিরিয়ান সম্প্রদায়ের কাছেই পাঠানো হয় এবং তারা ইমান আনে ।হযরত ইউনুস (আ.) যদি মাছের পেটে তওবা ও ইস্তিগফার এবং আল্লাহর তাসবীহ পাঠ না করতেন, যেমন তিনি لاَ إِلَهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ পাঠ করেছিলেন। তবে কিয়ামত পর্যন্ত হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেটেই থেকে যেতেন।আল্লাহ বলেন, তাহলে সে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত মাছের পেটে থেকে যেত। (সুরা আস সাফফাত-১৪৪)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মাছের পেটে ইউনূস আলাইহিস সালাম-এর পঠিত দোআ যে কোন মুসলিম যে কোন উদ্দেশ্যে পাঠ করবে, তার দো'আ কবুল হবে। (তিরমিযী-৩৫০৫০)। হযরত ইউনুস (আ.) এর আসিরিয়ান সম্প্রদায় একমাত্র জাতি যাদের গজবের প্রাক্কালে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেছিলেন।আল্লাহ পাক তাদের গজবের ভয় দেখিয়ে ঈমান আনার ব্যবস্থা করেছিলেন।অন্যত্র আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,‘তুমি তোমার পালনকর্তার আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ কর এবং মাছওয়ালার (ইউনুসের) মত হয়ো না। যখন সে দুঃখাকুল মনে প্রার্থনা করেছিল’। ‘যদি তার পালনকর্তার অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহ’লে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’। ‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন এবং তাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন’ (ক্বলম ,৪৮-৫০)।মসুলের একটি পাহাড়ের উপর হযরত ইউনুস (আ.)এর কবর অবস্থিত।আইএসের সদস্যর ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই হযরত ইউনুস (আ.)এর পবিত্র মাযার এবং এ মাযারের সাথে থাকা মসজিদ, বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করেছে।

গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল