ইসলামের প্রথম মসজিদ 'মসজিদে কুবা' নির্মাণের ইতিহাস
মো. আবু রায়হানঃ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নির্মিত মসজিদ মসজিদে কুবা। মসজিদটি মদিনা শরিফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এর দূরত্ব মসজিদে নববী থেকে তিন কিলোমিটারের মতো।The Quba Mosque located in Medina (Madinah), western Saudi Arabia. It is the first mosque in Islamic history, and the oldest mosque in the world, originally completed in 622 CE. It was founded by the Islamic prophet Muhammad (SM), after his migration from Mecca to Medina. মহানবী (সা.) ২০ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনার কুবায় প্রবেশ করেন। কুবায় অবতরণ করে তিনি সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর ঘরে অবস্থান করেন। তখন কুবা মসজিদ নির্মাণ করা হয়। কুবা একটি কূপের নাম। এই কূপকে কেন্দ্র করে যে বসতি গড়ে উঠেছে তাকে কুবা মহল্লা বলা হয়। এই সূত্রে মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে মসজিদে কুবা। এই মসজিদের নির্মাণকাজে স্বয়ং নবী করিম (সা.) অংশগ্রহণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে তিনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করেন এবং কুবাবাসীর প্রশংসা করেন। নবনির্মিত মসজিদে প্রথম নামাজ তিনিই আদায় করেন। During the migration from Mecca to Medina, while the Prophet Muhammad (PBUH) and his companions rested at Quba, the Prophet Muhammad (PBUH) laid the foundation of the mosque, and himself took part in the construction of this mosque with his companions.
ইতিহাসবিদরা বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন এর ভিত্তি স্থাপন করেন, তখন কেবলার দিকের প্রথম পাথরটি নিজ হাতে স্থাপন করেন।The Prophet, peace be upon him, helped building and was the one who positioned the first stones.ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের মতে নবী করিম (সা.) এখানে সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে মসজিদে কুবার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং এতে নামাজ আদায় করেন। নবুওয়ত প্রাপ্তির পর এটাই প্রথম মসজিদ, যার ভিত্তি তাকওয়ার ওপর স্থাপিত।
এমনকি ইসলামের এবং উম্মতে মোহাম্মদির প্রথম মসজিদ। মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী এবং মসজিদে আকসার পরই মসজিদে কুবার সম্মান ও ফজিলত। বর্তমানে মসজিদে কুবা মদিনার দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। পবিত্র কোরআনে এই মসজিদ ও তার মুসল্লিদের প্রশংসা করা হয়েছে। কুরআনে মসজিদে কুবার প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘যে মসজিদ প্রথম দিন থেকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে অবস্থান করা আপনার জন্য অধিক সংগত। সেখানে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা পবিত্রতা পছন্দ করে। আর আল্লাহ পবিত্র ব্যক্তিদের ভালোবাসেন।’ (সুরা তওবা আয়াত -১০৮) ।মসজিদে কুবায় নামাজ আদায়ে অত্যাধিক ফজিলত রয়েছে। যা অসংখ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। পরবর্তীতে মসজিদে নববীর পাশে স্থায়ী আবাস গড়লেও মহানবী (সা.) প্রতি সপ্তাহের শনিবার মসজিদে কুবায় আসতেন। হিজরতের পর বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সা.) মদিনায় ১০ বছর কাটিয়েছেন।
প্রায়ই বিশেষত শনিবারে উটে চড়ে বা হেঁটে এই মসজিদে আসতেন এবং দুই রাকাত নামায আদায় করতেন। হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অশ্বারোহণ করে কিংবা হেঁটে মসজিদে কুবায় আগমন করতেন এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। অন্য এক হাদিসে রয়েছে, প্রতি শনিবারে রাসুল (সা.) কুবায় আগমন করতেন। (বুখারি-মুসলিম)।হযরত উসাইদ ইবনে হুজাইব আল আনসারী (রা) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘মসজিদে কুবায় এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা; সওয়াবের দিক থেকে একটি ওমরা আদায়ের সমতুল্য।’ (তিরমিজি)।মসজিদে কুবার এ অনন্য সম্মান ও মর্যাদার কারণে বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর ইন্তিকালের পরও হযরত আবু বকর, হযরত ওমরসহ বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম বিশ্বনবির অনুকরণে প্রায়ই মদিনা থেকে মসজিদে কুবায় আসতেন ও তাতে নামাজ আদায় করতেন।বর্তমানেও তাদের এই আমল অব্যাহত রয়েছে।বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর পর ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা.) এর খিলাফতকালে সর্বপ্রথম মসজিদে কুবার সংস্কার ও পূণঃনির্মাণ করা হয়।
এরপর বিভিন্ন সময়ে আরো সাত বার এই মসজিদের পূণঃনির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। ওমর বিন আবদুল আজিজ , ওসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ ও তাঁর ছেলে প্রথম আবদুল মাজিদ প্রমুখ শাসকরা মসজিদে কুবার সংস্কার কাজ করেন। ৪৩৫ হিজরীতে আবু ইয়ালি আল-হোসাায়নি কুবা মসজিদ সংস্কার করেন। তিনি মসজিদের মিহরাব তৈরী করেন। ৫৫৫ হিজরীতে কামাল আল-দীন আল ইসফাহানি মসজিদে আরো বেশ কিছু সংযোজন করেন।পরবর্তী সময়ে ৬৭১, ৭৩৩, ৮৪০ ও ৮৮১ হিজরীতে উসমানী সাম্রাজ্যকালে মসজিদটি সংস্কার করা হয়। উসমানী শাসনামলে ১২৪৫ হিজরীতে সর্বশেষ পরিবর্তন সাধন করেন সুলতান আবদুল মজিদ।আধুনিককালে সৌদি শাসনামলে হজ্ব মন্ত্রণালয় মসজিদটির দায়িত্ব গ্রহণ করে-যা মূল ডিজাইনে অধিকতর সংস্কার ও সংযোজন করে। বর্তমান কুবা মসজিদ ইসলামী ঐতিহ্যের পাশাপাশি আধুনিকতম সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি অনন্য স্থাপত্য।বিশ শতকে আবদুল ওয়াহেদ আল ওয়াকিলের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিশন সৌদি আরবের পুরনো সব মসজিদ পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ শুরু করে। এ সময় কুবা মসজিদটিরও পুনর্নির্মাণ করা হয়।বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সময় সর্বশেষ সম্প্রসারণ হয়। ১৯৮৪ সালে শুরু হওয়া সংস্কার কাজ শেষ হয় ১৯৮৬ সালে।যাতে মসজিদের আয়তন দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৫০০ স্কয়ার মিটার।মসজিদটিতে একটি অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গনসহ কয়েকটি প্রবেশ দ্বার রয়েছে। মসজিদের উত্তর দিক মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। বর্তমানে মসজিদে ৪টি মিনার ও ৫৬টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটি সম্প্রসারণ করে ২০ হাজার মুসল্লী ধারণের উপযোগী করা হয়েছে। Quba mosque has 56 domes and 4 minarets at the corners of the prayer hall. The mosque has a capacity for 20,000 worshippers. ১১২ বর্গমিটার এলাকাব্যাপী ইমাম ও মোয়াজ্জিনের থাকার জায়গা, একটি লাইব্রেরী, প্রহরীদের থাকার জায়গা এবং সাড়ে ৪শ’ বর্গমিটার স্থানে ১২ টি দোকানে একটি বাণিজ্যিক এলাকা।মসজিদে ৭টি মূল প্রবেশ দ্বার ও ১২ টি সম্পূরক প্রবেশ পথ রয়েছে।
মসজিদের সঙ্গে পুরুষদের জন্য ৬৪ টি ও নারীদের জন্যে ৩২টি টয়লেট আছে।ওজুর জন্য ৪২ টি ইউনিট আছে।The mosque has 64 toilets for men and 32 toilets for women, and 42 units for ablution.১০ লাখ ৮০ হাজার থার্মাল ইউনিট বিশিষ্ট তিনটি কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র মসজিদকে ঠান্ডা রাখছে। মসজিদ ভবনের মাঝে একটি খালি জায়গা আছে, সেখানেও নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। দামি কারপেট বিছানো মেঝেতে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেন, রয়েছে জমজম পানির ব্যবস্থা। দেখতে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসেন। মসজিদে নারী ও পুরুষদের নামাজের জায়গা ও প্রবেশ পথ আলাদা। অজুর জায়গাও ভিন্ন। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদের ভেতরের কারুকাজও বেশ মনোমুগ্ধকর। মূল বর্তমানে মদিনায় অনেক সুন্দর সুন্দর মসজিদ রয়েছে। মসজিদে নববির পর সৌন্দর্য্য ও নান্দনিকতার তালিকায় মসজিদে কুবা অন্যতম। ওমরা, হজ ও দর্শণার্থীদের জন্য মসজিদে কুবা সাওয়াব ও সৌন্দর্য্যের অনন্য প্রতীক। চারপাশের খেজুরের বাগান ও বনায়ন মসজিদটির সৌন্দর্য কে করে তুলেছে অতুলনীয়।যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সূর্যাস্তের হলদে বিকালে মসজিদটি দেখলে হৃদয় ভরে যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন