হযরত ওমর এর আমলে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি


হযরত ওমর (রা.) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। দীর্ঘ দশ বছর (৬৩৪-৬৪৪ পর্যন্ত) তিনি খিলাফাতে অধিষ্ঠিত ছিলেন।অর্ধেক পৃথিবীর শাসক হযরত ওমর (রা) দক্ষ প্রশাসক ও সমরবিদ ছিলেন। ঐতিহাসিক ইমামুদ্দিন বলেন, ‘তাঁর শাসনকাল ইসলামের কৃতিত্বপূর্ণ সামরিক ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজন করেছে। শুধু মহান বিজেতাই নন, তিনি ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক এবং নিরঙ্কুশ সফলকামী জাতীয় নেতাদের অন্যতম।’ওমরের শাসনামলে খিলাফতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। তার সময়ে ইসলামি রাষ্ট্রের সীমানা সবচেয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এসময় সাসানীয় সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তার শাসনামলে জেরুজালেম মুসলিমদের হস্তগত হয়।দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ মহামারীর জন্য (৬৩৮-৬৩৯) সময়ে সামরিক অভিযান স্থগিত করা হয়েছিল।
৬৩৮ সালে আরবে খরার ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ক্ষুধা ও মহামারীর কারণে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।মদিনায় সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর ওমর (রা.) সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইরাকের প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে সাহায্যের জন্য চিঠি লেখেন। গভর্নরদের সময়মত পাঠানো সাহায্য হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সিরিয়ার গভর্নর আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) সর্বপ্রথম আবেদনে সাড়া দেন।পরে আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) ব্যক্তিগতভাবে মদিনা সফর করেন এবং সেখানে দুর্যোগ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠার জন্য ওমর (রা.) কে সহায়তা করেন।মদিনায় সাহায্য পৌঁছানোর পর ওমর (রা.) ইরাক, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার পথে মরুভূমির বসতির দিকে তার লোকদের পাঠান যাতে সেখানে অবস্থানরতদের সাহায্য পৌঁছানো যায়। ফলে লক্ষাধিক লোক প্রাণে বেঁচে যায়। ৬৩৯ সাল নাগাদ অবস্থার উন্নতি হয়। আরবে বৃষ্টিপাত হওয়ায় দুর্ভিক্ষ শেষ হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ ওমর (রা.) ব্যক্তিগতভাবে তদারক করেছিলেন।
আরবে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার পর সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের অনেক এলাকায় প্লেগ দেখা দেয়। শামে মুসলিম ও রোমান বাহিনীর মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধে অসংখ্য রোমান সেনা নিহত হয়। মুসলিম সেনাদের লাশ দাফন করার ব্যবস্থা হলেও রোমানদের লাশ দাফন করা হয়নি। জনমানবহীন বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে অসংখ্য লাশ। একটু একটু করে লাশ পচে-গলে দূষিত হতে থাকে আবহাওয়া আর জলাধার। এতে করেই সেখান থেকে সৃষ্ট নানা জীবাণু বিস্তার লাভ করে এবং মহামারির রূপ ধারণ করে। ইবন হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, ‘এটা ছিল শরীরে এক ধরনের ফোসকা ও একটু বড় টিউমারের মতো।’ এই রোগে কেউ আক্রান্ত হলে পাঁচ দিনের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে তখন সেখানে প্রায় ৩৫ হাজার মুসলিম সেনা যুদ্ধ করছিলেন। আবদুল্লাাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে ওমর (রা.) শামের দিকে রওনা হলেন। ‘সারগ’ পর্যন্ত পৌঁছলে ‘আজনাদ’ অধিবাসীদের (প্রতিনিধি ও অধিনায়ক) আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) ও তাঁর সহকর্মীরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তখন তাঁরা খবর দিলেন যে শামে মহামারি শুরু হয়ে গেছে। ওমর (রা.) লোকদের মাঝে ঘোষণা দিলেন, ‘আমি ফজর পর্যন্ত সওয়ারির ওপর থাকব, তোমরাও (ফজর পর্যন্ত সওয়ারির ওপর) অবস্থান করো।’ তখন আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) বললেন, আল্লাহর তাকদির থেকে পলায়ন করে? তখন ওমর (রা.) বললেন, ‘হে আবু উবায়দা! হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর তাকদির থেকে আল্লাহরই তাকদিরের দিকে পলায়ন করছি। তোমার যদি একপাল উট থাকে আর তুমি একটি উপত্যকায় অবতীর্ণ হওয়ার পর দেখো যে দুটি প্রান্তর রয়েছে, যার একটি সবুজ শ্যামল, অপরটি শূন্য। সে ক্ষেত্রে তুমি যদি সবুজ শ্যামল প্রান্তরে (উট) চরাও, তাহলে আল্লাহর তাকদিরেই সেখানে চরাবে, আর যদি তৃৃণশূন্য প্রান্তরে চরাও, তাহলেও আল্লাহর তাকদিরেই সেখানে চরাবে।’ বর্ণনাকারী বলেন, এ সময় আবদুর রাহমান ইবন আউফ (রা.) এলেন, তিনি (এতক্ষণ) তাঁর কোনো প্রয়োজনে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কাছে (হাদিসের) ইলম রয়েছে। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যখন তোমরা কোনো এলাকায় এর সংবাদ শুনতে পাও তখন তার ওপরে (দুঃসাহস দেখিয়ে) এগিয়ে যেয়ো না। আর যখন কোনো দেশে তোমাদের সেখানে থাকা অবস্থায় দেখা দেয় তখন তা থেকে পলায়ন করে বেরিয়ে পোড়ো না।’ বর্ণনাকারী বলেন, তখন ওমর (রা.) আল্লাহর হামদ করলেন। তারপর চলে গেলেন। (মুসলিম, হাদিস- ৫৫৯১)।
ওমর (রা.) মদিনায় ফেরার পর মহামারি চরম আকার ধারণের খবর অবগত হন। ওমর (রা.) চাইলেন সেনাপতি আবু ওবায়দা (রা.)-কে ফিরিয়ে আনতে। তাই ওমর (রা.) আবু ওবায়দাকে একটি চিঠি লিখলেন, ‘তোমার ওপর শান্তি বর্ষণ হোক। তোমার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ সম্পর্কে সরাসরি তোমাকে বলতে চাই। তাই তোমাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলছি, আমার পত্র পড়ে আমার উদ্দেশে বের হওয়ার আগে পত্রটি তোমার হাতছাড়া করবে না। রাতে পত্র পৌঁছলে সকাল হওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করবে। আর দিনের বেলায় পৌঁছলে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করবে।’ আবু ওবায়দা (রা.) পত্র পড়ে উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমিরুল মুমিনিনকে ক্ষমা করুন।’ অতঃপর ওমর (রা.)-এর উদ্দেশে একটি পত্র লিখলেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আমি আপনার প্রয়োজনের বিষয় বুঝেছি। আমি এখন মুসলিম সেনাবাহিনীতে অবস্থান করছি। তাদের ছেড়ে যেতে চাই না। আল্লাহ তাআলা আমিসহ সবার ব্যাপারে ফায়সালা করবেন। অতএব হে আমিরুল মুমিনিন, আপনার সিদ্ধান্ত থেকে আমাকে মুক্ত করুন। আমার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আমাকে ছেড়ে দিন।’আবু ওবায়দা (রা.)-এর পত্র পড়ে ওমর (রা.) কাঁদতে থাকেন। আশপাশের মুসলিমরা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আবু উবায়দা কি শহীদ হয়েছেন? ওমর (রা.) বলেন, ‘না, তিনি এখনো শহীদ হননি। কিন্তু ...।’ অর্থাৎ শিগগির তিনি শহীদ হবেন।’ এর পরই আবু ওবায়দা (রা.) প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৭/৪৪)।আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) ও ওমর (রা.)-এর মধ্যে মর্মস্পর্শী পত্র বিনিময়ের কথা আমরা সবাই জানি। অবশেষে মুয়াজ ইবন জাবাল (রা.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) নিজেও এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে সহচরদের এই বলে উপদেশ দিতে দিতে ইন্তেকাল করেন যে ‘হে লোকসকল! এটা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে রহমত। তোমাদের নবীর দোয়ার প্রতিফল।’
আবু ওবায়দা (রা.)-কে দাফন শেষে মুয়াজ (রা.) ভাষণ দিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার! তোমরা সকলেই কায়মনোবাক্যে তওবা করো। কারণ যে বান্দা প্রকৃত তওবা করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এই অবস্থায় সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। ভাইসব! তোমাদের কারো ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করে...’কিন্তু মহান রবের ফায়সালায় সামান্য সময়ের ব্যবধানে মুয়াজ ইবন জাবাল (রা.) মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। ওমর (রা.) যখন এই সংবাদ শুনলেন তখন কান্নায় তাঁর দাড়ি ভিজে গিয়েছিল। তারপর তিনি ইয়াজিদ ইবন আবু সুফিয়ানকে পরবর্তী দায়িত্বশীল নির্ধারণ করে সেখানে প্রেরণ করলেন।ইতিওহাসে এটি আমওয়াস মহামারি নামে পরিচিত।অনেক বড় বড় সাহাবি আমওয়াস মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। আবু উবায়দা বিন জাররাহ (রা.), মুয়াজ বিন জাবাল (রা.), ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান (রা.), হারিস বিন হিশাম (রা.) সুহাইল বিন আমর (রা.), উতবাহ বিন সুহাইল (রা.)-সহ আরো অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। এই মহামারি দীর্ঘদিন পর্যন্ত শামে বিরাজ করে। শামের অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণের পর মুসলিমদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ থেকে ৩৬ হাজারের মতো।আর মহামারিতে এ সময় মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজারের মতো সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন। ফলে সেনাবাহিনীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বহাল থাকে। তাঁদের ৮০ শতাংশ সেই মহামারিতে ইন্তেকাল করে শহীদের মর্যাদা লাভ করে ।আবু ওবায়দা (রা.) পরবর্তী সেনাপতি হিসেবে মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)-কে নির্ধারণ করেন।মুয়াজ (রা.)-এর মৃত্যুর পর আমর ইবনুল আস (রা.)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। আমর ইবনুল আস (রা.) অনুগতদের উদ্যেশে ভাষণে বলেন, ‘হে লোক সকল, যখন এ ধরনের মহামারী দেখা দেয়, তখন তা আগুনের মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।’ এরপর তিনি সবাইকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ করে নির্দেশ করেন, ‘পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড়ে চলে যাও। আরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন যে, কেউ কারো সঙ্গে মিলিত হতে পারবে না।’আলাদা আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে তারা দীর্ঘদিন পাহাড়ে অবস্থান করে। তখন যারা আক্রান্ত ছিলেন, তারা মৃত্যুবরণ করে শাহাদত লাভ করেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা মহামারী তুলে নেন।হযরত আমর ইবনুল আস (রা.) সুস্থদের নিয়ে নগরীতে প্রত্যাবর্তন করেন। (ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত তারিখ, মুখতাসারু তারিখি দিমাশক)।সে বছরে পরবর্তীতে প্লেগের প্রাদুর্ভাব কমে এলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য ওমর (রা.) সিরিয়া সফর করেন।

গ্রন্থণায়-মো.আবু রায়হান


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল