সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জয়পুরহাটের গর্ব জীবন্ত শহিদ বুদ্ধিজীবী মজিবর রহমান দেবদাস


মো আবু রায়হানঃ একুশে পদক বিজয়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণিত বিভাগের সাবেক শিক্ষক জীবন্ত শহিদ বুদ্ধিজীবী নামে খ্যাত ড. মজিবর রহমান দেবদাস গতকাল মারা গেছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে সোমবার (১৮ মে) জয়পুরহাটের মহুরুল গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর।গতকাল দুপুরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পুলিশের একটি দল তার মরদেহে রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদান করে। পরে তাকে জয়পুরহাট জেলার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের গণহত্যা, তাণ্ডবলীলা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা দেখে নিজের নাম পরিত্যাগ করে নতুন নাম দেবদাস ধারণ করেন।এছাড়া লোকমুখে আরেকটি কথা প্রচলন রয়েছে- ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের নিপীড়নের মুখে যখন বাংলাদেশের অনেক হিন্দু যখন জীবন বাঁচাতে হিন্দু নাম বাদ দিচ্ছিল, তখন নিজের নাম পরিবর্তন করে দেবদাস রাখেন মজিবর রহমান।

ড. মজিবর রহমান দেবদাস ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত জয়পুরহাট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে খঞ্জনপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর করাচির সেন্ট্রাল সরকারি কলেজে যোগদানের মাধ্যমে তার অধ্যাপনা জীবনের শুরু। ১৯৬৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ফলিত গণিতে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করে করাচির নাজিমাবাদ কলেজে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।কিন্তু পাকিস্তানীদের পাশবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে মুক্তিযুদ্ধের পর আর ফেরা হয়নি অধ্যাপনায়।

মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের গণহত্যা, তাণ্ডবলীলা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা দেখে নীরব থাকতে পারেননি অধ্যাপক মজিবর রহমান। এতে অতিষ্ট হয়ে ওঠেন তিনি। তাই ১৯৭১ সালের ১০ মে মজিবর রহমান তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা নষ্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্মিদের ক্যাম্পে পরিণত করবার জন্য একটি ইংরেজিতে প্রতিবাদ লিপি দেন। মুসলমান হয়ে আর এক মুসলমানের উপর পাকবাহিনীর নির্মমতা দেখে নিজের নাম পরিত্যাগ করে নতুন নাম ‘দেবদাস’ ধারণ করেন। প্রতিবাদ লিপিতে পূর্বের নাম উল্লেখসহ পরিবর্তিত নাম ‘দেবদাস’ উল্লেখ করেছিলেন। দেবদাসের চিঠি পৌঁছে যায় পাকিস্তানি সামরিক দপ্তরে। ১৯৭১ সালের ১২ মে এ প্রতিবাদী অধ্যাপককে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্পাস থেকে ধরে নিয়ে যায়। রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রায় চারমাস ধরে তার ওপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনে অধ্যাপক রহমান যখন বদ্ধ উন্মাদপ্রায় তখন ৫ সেপ্টেম্বর ’৭১ তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় নাটোর ক্যাম্প থেকে।

পাকিস্তানীদের পাশবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। বেঁচে থাকলেও তিনি ছিলেন অনেকটা স্মৃতি বিভ্রম, যেন জীবন্ত শহীদ অর্থাৎ জীবিত থেকেও মৃত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অকৃতদার এই বুদ্ধিজীবী এভাবেই বেঁচে ছিলেন। এছাড়া তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য তাকে পাবনা হেমায়েতপুর মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে। তিনি কোনো পাগল নন এ কথা বলে হেমায়েতপুরে চিকিৎসা নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। হেমায়েতপুর থেকে এসে তিনি চলে যান একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ তার খোঁজখবর জানতেন না। দৈনিক আজকের কাগজের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রতিনিধি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান তার খোঁজ পেয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন, যা ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরে এলে ১৯৯৮ সালের ১২ আগস্ট রাবি প্রশাসন মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ ও অবদানের জন্য তাকে সংবর্ধনা দেয় । মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্ট সদস্য মফিদুল হক তাকে নিয়ে কান পেতে রই নামক একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন।ড. মজিবর রহমান দেবদাস একুশে পদকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী ।স্বাধীনতা লাভের ৪৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর হাতে উঠে সম্মাননা পদক।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাবির শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে অবস্থানসহ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। জাতীয় অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দিন আহমেদের (তৎকালীন রাবি শিক্ষক) একান্ত প্রচেষ্টায় শহীদ পরিবারকে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে, এ মর্মে সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে থেকেই তাকে আখ্যায়িত করা হয় “জীবন্ত শহীদ” হিসেবে।৭১-এর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। বেঁচে থাকলেও তিনি ভুগছিলেন স্মৃতি বিভ্রাটে। ছিলেন জীবন্মৃত অবস্থায়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অকৃতদার এই বুদ্ধিজীবী এভাবেই বেঁচে ছিলেন।জীবন সায়াহ্নে তিনি জয়পুরহাটের সদর উপজেলার মহুরুল গ্রামে নিজ বাড়ির চার দেয়ালে আবদ্ধ ছিলেন। তার দেখভাল করতেন ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া বেগম ও নাতি-নাতনীরা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...