রাসুলুল্লাহ'র হিজরতে নিরাপদ আশ্রয় ঐতিহাসিক সাওর গুহা
মো.আবু রায়হানঃ মক্কার কাফের কুরাইশ, মুশরিকদের অত্যাচার নির্যাতন বেড়ে গেলে রাসল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মক্কা ত্যাগ করে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে মদিনার উদ্দেশে রওনা করেন।ইসলামের ইতিহাসে এটি হিজরত হিসাবে পরিচিত।এদিকে মক্কার কাফের মুশরিকরা তাঁদের পেছনে ধাওয়া করলে মক্কা থেকে তিন মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত সাওর পাহাড়ের একটি গুহায় রাসুল (সা.) ও আবু বকর (রা.) তিন দিন আত্মগোপন করে ছিলেন।হযরত আসমার ভাই আবদুল্লাহ তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি সারাদিন কাফেরদের ইচ্ছা আর পরামর্শ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন এবং রাত্রে নবীজীকে সব জানাতেন। হযরত আবু বকর (রা.) এর মেষ পালক আগের রাতের বেলা মেষ নিয়ে গুহায় মুখে হাযির হতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দুধ দিয়ে ফিরে আসতেন।হযরত আসমাও দু’তিন দিনের খাবার নিয়ে হাযির হন। নাস্তা এবং পানির মশক বাঁধার জন্য রশি দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে হাতের কাছে কোন রশি নেই। হযরত আসমা নেতাক বা উড়না খুলে দু’টুকরো করে রশির কাজ সারেন। এক টুকরা দিয়ে নাস্তা আর অপর টুকরা দিয়ে মশকের মুখ বন্ধ করা হয় তখন রাসল (সা.) হযরত আসমাকে যাতুননেতাকাইন উপাধি দেন।এসময়ে পদব্রজী ও অশ্বারোহী শক্ররা সর্বত্র রাসুল (সা.) এর খোঁজ করে ফিরছে। অথচ আশ্রয়স্থল কোন মজবুত দুর্গ ছিল না। বরং তা এক গিরি গুহা, যার দ্বারপ্রান্তে পর্যন্ত পৌছেছিল তার শক্ররা। মক্কার প্রসিদ্ধ পদচিহ্ন ও চেহারা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আবু কারাস রাসুল (সা.) এর পায়ের চিহ্নের সঙ্গে পরিচিত ছিল। সে ওই পদচিহ্ন লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে যেতে সওর পর্বত পর্যন্ত পৌঁছল এবং কুরাইশদের উদ্দেশ্যে বলল, মুহাম্মদ সম্ভবত এ পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করেছে।এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দেয়া হলো গুহার ভেতরে লক্ষ্য করার। সে গুহার মুখে এসে দেখতে পেল গুহার মুখ মাকড়সার ঘন জালে আবৃত এবং এক বুনো কবুতর সেখানে বসে ডিমে তা দিচ্ছে।সে গুহায় প্রবেশ না করেই ফিরে এসে বলল, গুহার মুখে মাকড়সার ঘন জাল রয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে সেখানে কেউ নেই।
তখন গুহা সঙ্গী আবু বকর (রা) ভীষণ চিন্তিত ছিলেন।এই চিন্তা নিজের জন্য ছিল না, বরং তিনি এই ভেবে চিন্তিত হয়েছিলেন যে, হয়তো শক্ররা তার বন্ধু রাসুল (সা.) এর জীবন নাশ করে দেবে, কিন্তু সে সময়ে রাসুল (সা.) ছিলেন পাহাড়ের মত অনড়, অটল ও অবিচল। রাসুল (সা.) শুধু যে নিজের জন্য তা নয়, বরং সফর সঙ্গী আবু বকর (রা.) কেও অভয় দিয়ে বলছিলেন, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (অর্থাৎ তাঁর সাহায্য আমাদের সাথে রয়েছে।) আবু বকর (রা.) বলেন, আমি গিরি গুহায় রাসুল (সা.)এর সাথে ছিলাম। তখন আমি কাফেরদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কেউ যদি পা উচিয়ে দেখে তবে আমাদের দেখতে পাবে। তখন রাসুল (সা.)বললেন, যে দুজনের সাথে আল্লাহ তৃতীয়জন তাদের ব্যাপারে তোমার কি ধারণা? সাওর পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন প্রসঙ্গে হাদিসে এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আমার কাছে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে গুহায় ছিলাম, আমি মুশরিকদের পদচারণা প্রত্যক্ষ করছিলাম, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের কেউ যদি পা উঠায় তাহলেই আমাদের দেখে ফেলবে, তিনি বললেন, আমাদের দু’জন সম্পকে তোমার কী ধারণা? আমাদের তৃতীয় জন হলেন- আল্লাহ। অর্থাৎ তিনি আমাদের সাহায্যকারী।’(সহিহ বোখারি ও মুসলিম)।
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- যখন অবিশ্বাসীরা তাকে (মক্কা হতে) বহিষ্কার করে দিয়েছিল, যখন সে ছিল দুজনের মধ্যে একজন; যখন উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল। সে তখন স্বীয় সঙ্গী (আবু বাকর)কে বলেছিল, ‘তুমি বিষণ্ণ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।’ অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় সান্ত্বনা অবতীর্ণ করলেন এবং এমন সেনাদল দ্বারা তাকে শক্তিশালী করলেন, যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি অবিশ্বাসীদের বাক্য নীচু করে দিলেন, আর আল্লাহর বাণীই সমুচ্চ রইল। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সুরা তওবা আয়াত ৪০)।এখানে সেই দুই প্রকার সাহায্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যার দ্বারা আল্লাহ তাঁর রসূল (সাঃ)-কে সাহায্য করেছিলেন। প্রথমতঃ হল প্রশান্তি বা সান্ত্বনা এবং দ্বিতীয়তঃ হল ফিরিশতাদের সহযোগিতা।
তিনি মক্কা থেকে যে পথে মদিনার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিলেন সে পথের বর্তমান নাম- হিজরা রোড। সাওর গুহার প্রশস্ততা ২ বর্গ মিটার।এ গুহার সামনে এবং পেছনে একটি করে প্রবেশ দ্বার রয়েছে। সাওর পর্বতের গুহায় অবস্থানের কারণে আবু বকর (রা.)-এর মর্যাদায় কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। মক্কায় আগমনকারী মুসলিমদের কাছে এই পাহাড়ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। জাবালে সাওরের পাদদেশ বা চূড়ায় দোয়া কবুল করা হয়।সাওর পাহাড়টি মক্কার দক্ষিণে কুদাই মহল্লার অন্তগত বর্তমানে পরিকল্পিত আল হিজরা এলাকায় অবস্থিত। এই পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্র দেখা যায়। এ পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭৪৮ মিটার।পর্বতটির মোট আয়তন ১০ বর্গমিটার। সাওর পাহাড়ে ওঠা খুব কষ্টসাধ্য। সওয়াবের নিয়তে ওঠাকে আলেমরা নিরুৎসাহিত করেন। অনেকে এখানে উঠাকে বেদআতও বলেছেন। তবে নবী করিম (সা.) দ্বীনের জন্য কত কষ্ট করেছিলেন তা উপলব্ধির জন্য উঠতে পারেন। হজ্জের সময় এখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন