ইয়াজুজ- মাজুজ এদের পরিণতি
ছবিঃ প্রতীকী |
ইয়াজুজ-মাজুজ দুটি জাতি ।ইয়াজুজ মাজুজ জাতি কে বাইবেলে গগ ম্যাগগ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।এদের প্রাচীন পৃথিবীর উত্তর পূর্বাঞ্চলের অধিবাসী বলা হয়েছে। ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে এতটুকু নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজুজ মাজুজ মানব সম্প্রদায়ভুক্ত। অন্যান্য মানবের মত তারাও নূহ ‘(আ)-এর সন্তান-সন্ততি। কুরআনুল করীম স্পষ্টতই বলেছে , (وَجَعَلْنَا ذُرِّيَّتَهُ هُمُ الْبَاقِينَ) (আস-সাফফাত- ৭৭) অর্থাৎ নুহের মহাপ্লাবনের পর দুনিয়াতে যত মানুষ আছে এবং থাকবে, তারা সবাই নূহ ‘(আ) এর সন্তান-সন্ততি হবে। ঐতিহাসিক বর্ণনা এব্যাপারে একমত যে, তারা ইয়াফেসের বংশধর। (মুসনাদে আহমাদঃ ৫/১১)। ইয়াজুজ মাজুজ দুটি জাতি সহীহ হাদীস মোতাবেক এরা মনুষ্য জাতি।এদের সংখ্যা অন্যান্য জাতির তুলনায় অনেক বেশী হবে এবং তাদেরকে দিয়েই জাহান্নামের বেশী অংশ পূর্ণ করা হবে। (বুখারী, সূরা হাজ্জের তফসীর, মুসলিম ঈমান অধ্যায়) ।বুখারি ও মুসলিম শরিফে আবু সাইদ খুদরি (রা.)-এর বাচনিক বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা আদম (আ.)-কে বলবেন, আপনি আপনার সন্তানদের মধ্য থেকে জাহান্নামিদের তুলে আনুন। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, হে আল্লাহ, তারা কারা? আল্লাহ তাআলা বলবেন, এরা প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামি এবং মাত্র একজন জান্নাতি। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম শিউরে ওঠেন। তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের মধ্যে সে কে, যে ব্যক্তি জান্নাতের অধিবাসী হবে? তিনি জবাবে বলেন, চিন্তা কোরো না। এই ৯৯৯ জন জাহান্নামি ইয়াজুজ-মাজুজের মধ্য থেকে হবে। আর হাজারে তোমাদের মধ্য থেকে একজন হবে।তাফসিরবিদ ইবনে কাসির (রহ.) ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে সব বর্ণনা একত্র করে লিখেছেন, ‘এতে বোঝা যায় যে ইয়াজুজ-মাজুজের সংখ্যা সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি হবে।’হযরত হুজায়ফা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন। জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইয়াজুজ একটি জাতি। মাজুজ একটি জাতি। প্রত্যেক জাতির অধীনে রয়েছে চার হাজার জাতি। তাদের কোনো ব্যক্তি তত দিন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে না, যত দিন তারা চোখের সামনে নিজের ঔরসজাত হাজার সন্তান দেখতে না পায়, যাদের প্রত্যেকে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম। হুজায়ফা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আবেদন জানিয়েছি যেন তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়। তিনি বলেন, তারা তিন ধরনের। তাদের এক দল হবে আরুজের মতো। আরুজ হলো সিরিয়ার একটি বৃক্ষ। এর দৈর্ঘ্য আকাশপানে ১২০ হাত। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, এরা এমন জাতি, কোনো ঘোড়া ও লোহা তাদের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারবে না। আর তাদের অন্য আরেকটি দল এক কানের ওপর ঘুমায় এবং অন্য কান মুড়ি দিয়ে থাকে। তাদের পাশ দিয়ে যত হাতি, বন্য প্রাণী, উট ও শূকর অতিক্রম করে, তারা সেগুলো খেয়ে ফেলে; এমনকি তাদের মধ্য থেকে কেউ মরে গেলেও তারা খেয়ে ফেলে...।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, হাদিস - ১২৫৭২)।
ছবি-কাল্পনিক ইয়াজুজ মাজুজের দল |
জুলকারনাইন নির্মিত প্রাচীরটির সঠিক অবস্থান জানা যায়নি। এ সম্পর্কে নানা মতবাদ প্রচলিত। একটি মতবাদ অনুসারে, কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী অরুণাচলে, যেখান থেকে সূর্য উদিত হয় সেখানে ইয়াজুজ, মাজুজের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন জুলকারনাইন। আর সে স্থানটি পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ইয়াজুজ-মাজুজ প্রত্যেহ জুলকারনাইনের দেয়ালটি খুঁড়তে থাকে। খুঁড়তে খুঁড়তে তারা এ লৌহ-প্রাচীরের প্রান্ত সীমার এত কাছাকাছি পৌছে যায় যে, অপরপাশ্বের আলো দেখা যেতে থাকে। কিন্তু তারা একথা বলে ফিরে যায় যে, বাকী অংশটুকু আগামী কাল খুঁড়ব। কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা প্রাচীরটিকে পূর্ববৎ মজবুত অবস্থায় ফিরিয়ে নেন। পরের দিন ইয়াজুজ-মাজুজ প্রাচীর খননে নতুনভাবে আত্মনিয়োগ করে। খননকার্যে আত্মনিয়োগ ও আল্লাহ্ তায়ালা থেকে মেরামতের এ ধারা ততদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যতদিন ইয়াজুজ-মাজুজকে বন্ধ রাখা আল্লাহর ইচ্ছা রয়েছে। যেদিন আল্লাহ্ তায়ালা তাদেরকে মুক্ত করার ইচ্ছা করবেন, সেদিন ওরা মেহনত শেষে বলবে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা আগামী কাল অবশিষ্ট অংশটুকু খুঁড়ে ওপারে চলে যাব। (আল্লাহর নাম ও তাঁর ইচ্ছার উপর নির্ভর করার কারণে সেদিন ওদের তাওফীক হয়ে যাবে।) পরের দিন তারা প্রাচীরের অবশিষ্ট অংশকে তেমনি অবস্থায় পাবে এবং তারা সেটুকু খুঁড়েই প্রাচীর ভেদ করে ফেলবে। (তিরমিযি- ৩১৫৩, ইবনে মাজাহ- ৪১৯৯, হাকিম মুস্তাদরাক- ৪/৪৮৮, মুসনাদে আহমাদ- ২/৫১০, ৫১১০)।
আল্লাহ বলেন,অবশেষে যখন ইয়া’জুজ ও মা’জুজকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তারা প্রতিটি উচ্চভূমি হতে দ্রুত ছুটে আসবে।(সুরা আম্বিয়া আয়াত-৯৬)।তাদের অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক বিস্তারিত ও সহীহ হাদীস হচ্ছে নাওয়াস ইবনে সামআন রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসটি। সেখানে দাজ্জালের ঘটনা ও তার ধ্বংসের কথা বিস্তারিত বর্ণনার পর বলা হয়েছে, “এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করবেন, আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে এমন লোক বের করব, যাদের মোকাবেলা করার শক্তি কারো নেই। কাজেই (হে ঈসা!) আপনি মুসলিমদেরকে সমবেত করে তুর পর্বতে চলে যান। (সে মতে তিনি তাই করবেন।) অতঃপর আল্লাহ তা'আলা ইয়াজুজ-মাজুজের রাস্তা খুলে দেবেন। তাদের দ্রুত চলার কারণে মনে হবে যেন উপর থেকে পিছলে নীচে এসে পড়ছে। তাদের প্রথম দলটি তবরিয়া উপসাগরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তার পানি পান করে এমন অবস্থা করে দেবে যে, দ্বিতীয় দলটি এসে সেখানে কোনদিন পানি ছিল, একথা বিশ্বাস করতে পারবে না। আব্দুর রহমান ইবনে ইয়ায়ীদের বর্ণনায় ইয়াজুজ-মাজুজের কাহিনীর আরো অধিক বিবরণ পাওয়া যায়। তাতে রয়েছেঃ তবরিয়া উপসাগর অতিক্রম করার পর ইয়াজুজ-মাজুজ বায়তুল মোকাদ্দাস সংলগ্ন পাহাড় জাবালুল-খমরে আরোহণ করে ঘোষণা করবেঃ আমরা পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীকে হত্যা করেছি। এখন আকাশের অধিবাসীদেরকে খতম করার পালা। সেমতে তারা আকাশের দিকে তীর নিক্ষেপ করবে। আল্লাহর আদেশে সে তীর রক্তরঞ্জিত হয়ে তাদের কাছে ফিরে আসবে। (যাতে বোকারা এই ভেবে আনন্দিত হবে যে, আকাশের অধিবাসীরাও শেষ হয়ে গেছে।(মুসলিম- ২৯৩৭)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন যে, ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাবের পরও বায়তুল্লাহর হজ্ব ও উমরাহ অব্যাহত থাকবে। (বুখারীঃ ১৪৯০)। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন ঘুম থেকে এমন অবস্থায় জেগে উঠলেন যে, তার মুখমণ্ডল ছিল রক্তিমাভ এবং মুখে এই বাক্য উচ্চারিত হচ্ছিলঃ “আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আরবদের ধ্বংস নিকটবর্তী! আজি ইয়াজুজ-মাজুজের প্রাচীরে এতটুকু ছিদ্র হয়ে গেছে। অতঃপর তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী মিলিয়ে বৃত্ত তৈরী করে দেখান। যয়নব রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ আমি এ কথা শুনে বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে সৎকর্মপরায়ণ লোক জীবিত থাকতেও কি ধ্বংস হয়ে যাবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, ধ্বংস হতে পারে; যদি অনাচারের আধিক্য হয় ৷ (বুখারী-৩৩৪৬, মুসলিম-২৮৮০)।
ছবি-কাল্পনিক ইয়াজুজ মাজুজের দল |
ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গীরা তুর পর্বতে আশ্রয় নেবেন। অন্যান্য মুসলিমরা নিজ নিজ দূর্গে ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবে। পানাহারের বস্তুসামগ্ৰী সাথে থাকবে, কিন্তু তাতে ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে একটি গরুর মস্তককে একশ’ দীনারের চাইতে উত্তম মনে করা হবে। ঈসা 'আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য মুসলিমরা কষ্ট লাঘবের জন্য আল্লাহর কাছে দো'আ করবেন। (আল্লাহ দোআ কবুল করবেন) তিনি মহামারী আকারে রোগব্যাধি পাঠাবেন। ফলে, অল্প সময়ের মধ্যেই ইয়াজুজ-মাজুজের গোষ্ঠী সবাই মরে যাবে।অতঃপর হযরত ঈসা 'আলাইহিস সালাম সঙ্গীদেরকে নিয়ে তুর পর্বত থেকে নীচে নেমে এসে দেখবেন পৃথিবীতে তাদের মৃতদেহ থেকে অর্ধহাত পরিমিত স্থানও খালি নেই এবং (মৃতদেহ পচে) অসহ্য দুৰ্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। (এ অবস্থা দেখে পুনরায়) ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গীরা আল্লাহর দরবারে দো'আ করবেন। (যেন এই বিপদও দূর করে দেয়া হয়)। আল্লাহ তা'আলা এ দো’আও কবুল করবেন এবং বিরাটাকার পাখি প্রেরণ করবেন, যাদের ঘাড় হবে উটের ঘাড়ের মত। (তারা মৃতদেহগুলো উঠিয়ে যেখানে আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, সেখানে ফেলে দেবে) কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, মৃতদেহগুলো সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে। এরপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে। কোন নগর ও বন্দর এ বৃষ্টি থেকে বাদ থাকবে না। ফলে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ ধৌত হয়ে কাঁচের মত পরিস্কার হয়ে যাবে।অতঃপর আল্লাহ্ তায়ালা ভূপৃষ্ঠকে আদেশ করবেন, তোমার পেটের সমুদয় ফল-ফুল উদগীরণ করে দাও এবং নতুনভাবে তোমার বরকতসমূহ প্ৰকাশ কর। (ফলে তাই হবে এবং এমন বরকত প্রকাশিত হবে যে) একটি ডালিম একদল লোকের আহারের জন্য যথেষ্ট হবে এবং মানুষ তার ছাল দ্বারা ছাতা তৈরী করে ছায়া লাভ করবে দুধে এত বরকত হবে যে, একটি উষ্ট্রীর দুধ একদল লোকের জন্য, একটি গাভীর দুধ এক গোত্রের জন্য এবং একটি ছাগলের দুধ একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট হবে। (চল্লিশ বছর যাবত এই অসাধারণ বরকত ও শান্তি-শৃংখলা অব্যাহত থাকার পর যখন কেয়ামতের সময় সমাগত হবে; তখন) আল্লাহ্ তায়ালা একটি মনোরম বায়ু প্রবাহিত করবেন। এর পরশে সব মুসলিমের বগলের নীচে বিশেষ এক প্রকার রোগ দেখা দেবে এবং সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হবে; শুধু কাফের ও দুষ্ট লোকেরাই অবশিষ্ট থেকে যাবে। তারা ভূ-পৃষ্ঠে জন্তু-জানোয়ারের মত খোলাখুলিই অপকর্ম করবে। তাদের উপরই কেয়ামত আসবে।’ (মুসলিম-২৯৩৭)।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন