হযরত ওমর (রা.) কে চারটি প্রশ্ন ও ঐতিহাসিক উত্তর
ইসলামি খেলাফতের তখন স্বর্ণযুগ চলছে। ফারুকে আজম, আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর (রা.) ছিলেন খলিফা। তৎকালীন বিশ্বের সুপার পাওয়ার পারস্য ও রোমসহ প্রায় অর্ধেক পৃথিবী মুসলমানদের পদানত। ইসলামের এই বিজয় অভিযান থামাতে একের পর এক কূটকৌশল সাজাতে ব্যস্ত ইহুদীরা। তেমনই এক অপকৌশলের অংশ হিসেবে কয়েকজন ইহুদী ধর্মযাজক হযরত ওমর (রা.) এর দরবারে এলেন। তারা খলীফাকে প্রস্তাব দিল যে, তারা চারটি প্রশ্ন করবে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আসমানি কিতাব থেকে দিতে হবে। সেটা হোক তাওরাত যাবুর বা ইনজিল অথবা কুরআন থেকেই হোক, উত্তর আসমানি কিতাব থেকেই হতে হবে। বলা বাহুল্য, প্রশ্নগুলোর উত্তর আসমানি কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে। মুসলমানদের কেউ এর উত্তর দিতে পারলে যাজকরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করবে। কিন্তু যদি কেউই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে না পারেন তবে যাজকরা ইসলামি খেলাফতের সর্বত্র এই পরাজয়ের কথা ছড়িয়ে দিবে। যার পরিণতিতে ইসলামি খেলাফতের ভাবমর্যাদা চরম সংকটের সম্মুখীন হবে।
আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর (রা.) তাদের শর্তে রাজি হলেন। তাদের চারটি প্রশ্ন ছিল-
এক একই মায়ের পেট হতে দু’টি বাচ্চা একই দিনে একই সময় জন্ম গ্রহন করেছে এবং একই দিনে ইন্তেকাল করেছে তবে, তাদের একজন অপরজন থেকে ১০০ বছরের বড় ছিল। তারা দুইজন কে? কিভাবে তা হয়েছে?
দুই পৃথিবীর কোন্ স্থানে সূর্যের আলো শুধু একবার পড়েছে। কেয়ামত পর্যন্ত আর কখনো সূর্যের আলো সেখানে পড়বে না?
তিন সে কয়েদী কে, যার কয়েদ খানায় শ্বাস নেওয়ার অনুমতি নেই আর সে শ্বাস নেওয়া ছাড়াই জীবিত থাকে?
চার সেটি কোন কবর, যার বাসিন্দা জীবিত ছিল এবং কবরও জীবিত ছিল, আর সে কবর তার বাসিন্দাকে নিয়ে ঘোরাফেরা করেছে এবং কবর থেকে তার বাসিন্দাজীবিত বের হয়ে দীর্ঘকাল পৃথিবীতে জীবিত ছিল?
আমীরুল মুমিনিন ওমর ফারূক (রা.) এই বিচিত্র প্রশ্ন গুলো শুনে প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে ডেকে পাঠালেন। একজন বিশিষ্ট সুবিজ্ঞ ফকিহ ও পবিত্র আল-কুরআনের তাফসীরের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় মুফাস্সির।মুসলিম বিশ্বে তাকে রইসুল মুফাস্সিরিন বা সাইয়্যিদুল মুফাস্সিরিন (তাফসিরকারকদের প্রধান) বলা হয় । ওমর (রা.) তার সম্পর্কে আরও বলতেন যে, "সে বয়সে তরুণ, জ্ঞানে প্রবীণ ।হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে খলীফার কাছ থেকে প্রশ্নগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। শুনে বললেন, আমীরুল মুমিনিন!আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। তারা এখনই তাদের উত্তর পেয়ে যাবে। অতঃপর তিনি উত্তর দিতে শুরু করলেন-
১ নং উত্তর: এই দু ভাই হলেন ইহুদিদেরই নবি হযরত উযাইর (আ.) ও উনার ভাই। তারা দুজন একই সঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন উযাইর (আ.) এক জনমানবহীন প্রান্তর অতিক্রম করছিলেন। প্রাণশুন্য খাঁ খাঁ ময়দান দেখে তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এরকম স্থানও কী কখনো আবাদ হতে পারে? একথা বলার কিছুক্ষণ পর তিনি এক গাছের তলায় ঘুমিয়ে গেলেন। আল্লাহ পাক স্বীয় কুদরত দেখানোর জন্য নবিকেই বেছে নিলেন, তিনি নবি উযাইরের প্রাণ নিয়ে নিলেন। ১০০ বছর নবি উযাইর (আ.) প্রাণহীনভাবেই ঘুমিয়ে রইলেন। তাই উনার বয়স আর বাড়ল না। তারপর ঘুম থেকে উঠে নবী দেখলেন সেই প্রান্তর জনমানুষের কোলাহলে ভরপুর। সেখানে আবাদ হয়ে গেছে, পরবর্তীতে নবি উযাইর ও উনার ভাই একই দিনে মারা যান। উল্লেখ্য, সেই জায়গাটি ছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের এলাকা তথা জেরুজালেম।
২ নং উত্তর: সেই স্থানটি হলো লোহিত সাগরের ওপর ভেসে ওঠা রাস্তা। বনি ইসরাঈলদের নিয়ে লোহিত সাগর পার হবার সময় যখন হযরত মূসা (আ.) পানিতে তাঁর লাঠি দ্বারা আঘাত করেছিলেন তখন আল্লাহ পাকের কুদরতে পানির ওপর ১২টি রাস্তা ভেসে উঠেছিল। পরবর্তীতে ফেরাউন ও তার দলবল লোহিত সাগর পার হতে গেলে রাস্তাটি ডুবে যায়। এই রাস্তাটিতেই মাত্র একবার সূর্যের কিরণ পতিত হয়েছিল। ওই রাস্তাটি আর কখনো ভাসবেও না, আলোও কখনো পড়বে না।
৩ নং উত্তর: সেই কবর হলো হযরত ইউনুস (আ.) কে গিলে ফেলা মাছটি। আর লাশ হলেন হযরত ইউনুস (আ.)। মাছটিও জীবিত ছিল, নবিও জীবিত ছিলেন। পরে হযরত ইউনুস (আ.) সেখান থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন।
৪ নং উত্তর: সেই বন্দীটি হচ্ছে মায়ের গর্ভে থাকা বাচ্চা। মায়ের গর্ভে থাকা শিশুটি কোনো প্রকার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারলেও আল্লাহ তায়ালার অসীম দয়ায় সুস্থভাবে বেঁচে থাকে।
আমীরুল মুমিনিন হযরত ওমর (রা.) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের উত্তর শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তার জ্ঞানের গভীরতার প্রশংসা করলেন। আর ইসলা্মি খেলাফতের মানমর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দেবার আকাংখায় আসা পাদ্রীরা এই উত্তর শুনে চমকে গেল। লজ্জায় তাদের মাথা নত হয়ে এলো।কুরআনের জ্ঞানের অসীমতায় অভিভূত হয়ে তারা সবাই হযরত ওমর (রা.) এর হাতে ইসলাম কবুল করলেন।কেউ বলেন হযরত ওমর (রা.) কে এক খৃষ্টান বাদশাহ চারটি প্রশ্ন লিখে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আসমানী কিতাবের আলোকে প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন