অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম যুদ্ধ বদর দিবস আজ


মো.আবু রায়হান
আজ ঐতিহাসিক ১৭ রমজান। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ১৭ মার্চ আজকের দিনে দ্বিতীয় হিজরিতে সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ বদরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল সত্য ও মিথ্যার, হক ও বাতিলের, মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যকার চূড়ান্ত মীমাংসাকারী ঐতিহাসিক যুদ্ধ।বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয় মদীনায় হিজরতের মাত্র ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিন পরে।ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের।  বদর যুদ্ধে মুসলিমরা পরাজিত হলে বিশ্ব ইতিহাস হতে মুসলিমদের নাম নিশানা চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত ।কেননা বদর যুদ্ধের দিন রাসুল (সা.) আল্লাহর কাছে কাতর কন্ঠে এই বলে প্রার্থনা করেন যে হে প্রভু! আপনি আমার সঙ্গে বিজয়ের যে অঙ্গীকার করেছেন, তা এখানে পূরণ করুন। আপনি যদি ইসলামের এই ক্ষুদ্র অনুসারী দলটিকে ধ্বংস করে দেন, তবে এই পৃথিবীতে আপনার ইবাদতকারী বলতে কেউ থাকবে না। চিরদিনের জন্য নির্মূল হয়ে যাবেকয়েক দিক দিয়ে বদরে যুদ্ধ ছিল খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ-প্রথমতঃ এটি ছিল প্রথম যুদ্ধ। দ্বিতীয়তঃ পূর্বে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই ছিল এই যুদ্ধ। সিরিয়া থেকে বাণিজ্য-সামগ্রী নিয়ে মক্কাগামী আবূ সুফিয়ানের কাফেলার পথ অবরোধ করার জন্য মুসলিমরা বের হয়েছিলেন। কিন্তু আবু সুফিয়ান টের পেয়ে যায় এবং সে তার কাফেলা নিয়ে অন্য পথ ধরে চলে যায়। এদিকে মক্কার কাফেররা নিজেদের শক্তি ও সংখ্যার আধিক্যের দাম্ভিকতায় মুসলিমদের উপর আক্রমণ করার জন্য বদরের ময়দান পর্যন্ত যাত্রা করে এবং সেখানে সর্বপ্রথম এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তৃতীয়তঃ এই যুদ্ধে মুসলিমরা আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভে ধন্য হন। চতুর্থতঃ এতে কাফেররা এমন শিক্ষামূলক পরাজয় বরণ করে যে, আগামীর জন্য তাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়।বদর যুদ্ধের পূর্বে ৬২৩ থেকে ৬২৪ সালের মধ্যে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে বেশ কিছু খন্ডযুদ্ধ হয়। মদিনার অদূরে অবস্থিত একটি কূপের নাম ছিল বদর। সেই সূত্রে এই কূপের নিকটবর্তী আঙিনাকে বলা হতো বদর প্রান্তর। সেখানেই এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মক্কা থেকে ১২০ মাইল ও মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরে মধ্যবর্তী স্থানে এর অবস্থান।বদর অঞ্চলটি একটি বিস্তৃত ভূমি যার দক্ষিণ প্রান্ত উঁচু ও‘ উদওয়াতুল কাছওয়া’ নামে পরিচিত এবং উত্তর প্রান্তটি নিচু ও ঢালু। এ প্রান্তটি‘ উদওয়াতুদ দুনিয়া’ নামে পরিচিত। এ বিস্তৃত ভূমিতে বিভিন্ন ধরনের কূপ থাকার কারণে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ ছিল এবং সব সময় কাফেলাসমূহ এ স্থানে অবতরণ করে বিশ্রাম নিত।অন্যদিকে মহানবী (সা.) বদরের যে প্রান্তে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন সেখানে বৃষ্টির কোন নেতিবাচক প্রভাব ছিল না। এ প্রান্তটি‘ উদওয়াতুদ দুনিয়া’ নামে প্রসিদ্ধ।
বদর যুদ্ধে কাফের কুরাইশদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিজাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারিস ইবনে আমির, তুয়াইমা ইবনে আদি, নাদার ইবনে হারিস, জামআ ইবনে আসওয়াদ ও উমাইয়া ইবনে খালাফসহ মক্কার অনেক অভিজাত ব্যক্তি কাফের বাহিনীর হয়ে লড়াই করেন।  তাদের কাছে ৭০০ উট ও ১০০ অশ্ব ছিল। অপরপক্ষে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন।হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হাদিসে মহানবী (সা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ক্ষমার সুসংবাদ দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে অবগত আছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের যা ইচ্ছা করো। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।’ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘এমন মহান সুসংবাদ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাড়া আর কেউ পায়নি।’ (ফাতহুল বারি, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা ৩০৫)একইভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদ দিয়েছেন। হজরত জাবের (রা.) বর্ণিত, হজরত হাতেব (রা.)-এর একজন দাস রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে তার বিরুদ্ধে নালিশ করল এবং সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), নিশ্চয় হাতেব জাহান্নামে যাবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি মিথ্যা বলেছ। সে জাহান্নামে যাবে না। কেননা সে বদর ও হুদাইবিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৪৯৫)বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারীদের এই অপরিমেয় সম্মান ও মর্যাদার কারণ ব্যাখ্যা করে আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এটা নিছক কোনো যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এর প্রকৃত রূপ ছিল অকল্পনীয় রকম কঠিন এবং প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।মুসলিম বাহিনীতে ছিলেন আবু বকর, উমর ইবনুল খাত্তাব, আলি ইবনে আবি তালিব, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, মুসআব ইবনে উমাইর, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আবু জার আল-গিফারীসহ প্রমুখ। মুসলিম বাহিনীতে মুহাজির ছিলেন ৮২জন এবং আনসারদের মধ্যে আওস গোত্রের ছিলেন ৬১জন ও খাজরাজ গোত্রের ছিলেন ১৭০জন। মুসলিমদের কাছে সর্বমোট ৭০ উট, দুটি অশ্ব, ছয়টি লৌহবর্ম এবং আটটি তরবারী ছিল। এই অবস্থায় মুসলিমদের একমাত্র ভরসা ও আশ্রয়স্থল ছিলেন মহান আল্লাহ তায়ালা। তারা কাকুতি-মিনতি সহকারে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। রাসুল (সা) নিজে এক তাঁবুতে অত্যন্ত কাকুতি-মিনতি সহকারে আল্লাহর নিকট দোয়া করছিলেন।সুতরাং মহান আল্লাহ দোয়া কবুল করলেন এবং এক হাজার ফেরেশতা একের পর এক মুসলিমদের সাহায্যে পৃথিবীতে নেমে এল।আল্লাহ বলেন,স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সকাতর প্রার্থনা করেছিলে, আর তিনি তা কবুল করে (বলে) ছিলেন, আমি তোমাদেরকে এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করব, যারা একের পর এক আসবে। বদর যুদ্ধে এভাবে রাব্বুল আলামিন আসমানি সাহায্যে অসম প্রতিপক্ষ কাফের কুরাইশ বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় দান করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের বদরে সাহায্য করেছেন। অথচ তোমরা ক্ষীণশক্তি।’ (সুরা আলে ইমরান আয়াত-১২৩)। আল্লাহর ওয়াদা- “যদি তোমাদের মধ্যে একশ ধৈর্যশীল যোদ্ধা থাকে, তবে তারা দুইশ’র বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে।” (সূরা আল আনফাল আয়াত- ৬৬)।আল্লাহ তায়ালা মুসলিম বাহিনিকে অস্তিত্বের সংকট থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দিয়ে অমিত সম্ভাবনার দুয়ারে পৌঁছে দেন।পবিত্র কুরআনের সুরা আলে ইমরান ও সুরা আনফালে বদর যুদ্ধের সবিস্তার বর্ণনা এসেছে। শুধু বদর নয়, বরং ভবিষ্যতেও আল্লাহ আসমানি এই সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বরং তোমরা যদি ধৈর্যধারণ করো, আল্লাহকে ভয় করো এবং তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করে তবে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পাঁচ হাজার ফেরেশতার সুবিন্যস্ত বাহিনী দ্বারা সাহায্য করবেন।’ (সুরা আলে ইমরান আয়াত-১২৫)।এই সাহায্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘আর আল্লাহ এটা করেছেন, তোমাদেরকে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য এবং যাতে এর দ্বারা তোমাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। সাহায্য শুধু মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১২৬)।

মক্কা থেকে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে কুরাইশ বাহিনী প্রধান আবু জাহেলসহ কুরাইশের লোকজন বায়তুল্লাহর পর্দা ধরে প্রার্থনা করেছিল। আর আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এই দোয়া করতে গিয়ে তারা নিজেদের বিজয়ের দোয়ার পরিবর্তে সাধারণ বাক্যে এভাবে দোয়া করেছিল, ইয়া আল্লাহ! উভয় বাহিনীর মধ্যে যেটি উত্তম ও উচ্চতর, উভয় বাহিনীর মধ্যে যেটি হেদায়াতের উপর রয়েছে এবং উভয় দলের যেটি বেশী ভদ্র ও শালীন এবং উভয়ের মধ্যে যে দ্বীন উত্তম তাকেই বিজয় দান কর। (মুসনাদে আহমাদ- ৫/৪৩১)। এই দোয়ার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদের জন্য বদ দোয়া ও মুসলিমদের জন্য নেক দোয়া করে করেছিল।বদর যুদ্ধের ফলাফল সামনে আসার পর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বলে দিলেন (وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ) অর্থাৎ আল্লাহ যখন মুসলিমদের সাথে রয়েছেন, তখন কোন দল তোমাদের কিইবা কাজে লাগতে পারে?বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল তা ছিল নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার, যুদ্ধপ্রস্তু আবদুল্লাহ বিন উবাই ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। সেই সময় মদিনার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে সৈয়দ আমির আলী বলেন - Medina itself was honey combed by sedition and treachery. কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, উত্তেজনা সৃষ্টি ও তাদের বাণিজ্য পথ বন্ধ হবার আশঙ্কা। ঐতিহাসিক এসএম ইমামুদদীন বলেন -The son of Abdullah al Hadrami created sensation in Makkah and this become the battle of Badar.কাফেরদের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংসসাধন এবং রাসুল (সা.)-কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার কাফেরদের অশুভ অভিপ্রায়।পরোক্ষ কারণ হিসেবে দেখা হয়, মদিনা শরিফে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা। মওলানা মুহামমদ আলী বলেন -The long standing anxiety of the Quraish to crush the growing power of Islam was the cause of the battle. বদর যুদ্ধের সবচেয়ে বড় পরোক্ষ কারণ ছিল সিরিয়া ফেরত আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলার উপর মুসলমানদের হামলার সংবাদ ইত্যাদি।
এই যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ও খ্যাতনামা আরব বীর। আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, নদর বিন হারেস ও উমাইয়া বিন খালাফের মতো কুরাইশ নেতাদের করুণ মৃত্যু তাদের হৃদয়াত্মাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং তাদের চোখ থেকে অহমিকার পর্দা সরে যায়।
অন্যদিকে যুদ্ধে আবু জাহলসহ মক্কার ৭০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তির মৃত্যুর ফলে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের নতুন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তিনি কুরাইশদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। যুদ্ধে জয়ের ফলে অন্য আরব গোত্রগুলি মুসলিমদেরকে নতুন শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। The victory especially raised Muhammad’s status among the Medina tribes that supported him and convinced his followers that victory over powerful and wealthy Mecca was truly possible.মদিনার অনেকে এসময় ইসলাম গ্রহণ করে। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদেরকে খুবই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়. Those Muslims who fought at Badr became known as the badrīyūn and make up one group of the Companions of the Prophet.ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পর মদিনায় যে ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা বদর প্রান্তে বিজয়ের মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছিল। যুদ্ধ জয়ের ফলে নেতা হিসেবে মুহাম্মাদ (সা) এর কর্তৃত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।পিকে হিট্টি বলেন -The battle of Badar laid the foundation of Muhammad temporal power, Islam had won its first and decisive military victory.এই বিজয়ের আগে মদিনার মুসলিমরা ছিল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র। কিন্তু কুরাইশদের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় এই ধারণা পাল্টে দেয় এবং আরব উপদ্বীপে মদিনার মুসলিমদের একটি রাজনৈতিক পক্ষের মর্যাদা এনে দেয়।মূলত প্রতিষ্ঠিত শক্তি কুরাইশদের বিরুদ্ধে সদ্যঃপ্রসূত মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য বদর ছিল অস্তিত্বের লড়াই। বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এ যুদ্ধই ইসলামী রাষ্ট্রের পথচলার গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বদর যুদ্ধের পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই যুদ্ধ শুধু মদিনা নয়; বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে মুসলিম উম্মাহর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল। It seriously damaged Meccan prestige while strengthening the political position of Muslims in Medina and establishing Islam as a viable force in the Arabian Peninsula.( Encyclopadia Britannica). ইসলাম আসন্ন পতনের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে সারা বিশ্বে দৃঢ় গতিতে ছড়িয়ে পড়ে।ঐতিহাসিক পিকে হিট্টি বলেন ,-lslam recovered and passed on gradually from the defensive to the offensive. বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয় কুরাইশদের অবাধ বাণিজ্য এবং আরবের অন্যান্য গোত্রের ওপর অন্যায় প্রভাব খাটানোর পথ বন্ধ করে দেয়। মদিনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুণ্ঠনের যে ধারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল—যার পেছনে কুরাইশ নেতাদের সহযোগিতা ও প্রশ্রয় ছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়।
বদরের যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ
১৪ জন মুসলিম যোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। ৭০ জন মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়।যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নেয়া হয়। বন্দীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল উকবা ইবনে আবি মুয়ীত,আবু গাররাহ্,সুহাইল ইবনে আমর,আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং আবুল আস। কয়েকজন বন্দিকে বিশেষ দয়া করায় তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করা হয়নি, এমনিতেই মুক্তি দেওয়া হয়।যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে নেওয়া মুক্তিপণের পরিমাণ ছিল এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। যাদের মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের পেশা দক্ষতার বিনিময়ে মুক্তি লাভের সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন— মক্কাবাসী লেখাপড়া জানত। পক্ষান্তরে মদিনায় লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। ফলে যাদের মুক্তিপণ প্রদানের সামর্থ্য নেই এবং লেখাপড়া জানে, তাদের সুযোগ দেওয়া হলো যে তারা মদিনায় ১০টি করে শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে। শিশুরা ভালোভাবে লেখাপড়া শেখার পর শিক্ষক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।রাসূলের কন্যা যয়নাবের স্বামী আবুল আস একজন ব্যবসায়ী ও মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইসলামপূর্ব যুগে রাসূলের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। মহানবীর নবুওয়াত লাভের পর তাঁর স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি অমুসলিম থেকে যান।বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। সে সময় তাঁর স্ত্রী মক্কায় অবস্থান করছিলেন। স্বামীর বন্দী হওয়ার কথা শুনে তাঁকে মুক্ত করার জন্য স্বীয় গলার হার যা তাঁর মা হযরত খাদীজা তাঁকে তাঁর বিবাহের রাতে উপহার দিয়েছিলেন তা মদীনায় পাঠালেন। মহানবী হযরত খাদীজার হারটির প্রতি লক্ষ্য করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি তাঁর জীবনের সংকটময় মুহূর্তে হযরত খাদীজার ভূমিকার কথা স্মরণ করে কাঁদছিলেন। কারণ সংকটময় সেই মুহূর্তে হযরত খাদীজাহ্ তাঁর পাশে ছিলেন এবং তাঁর সমস্ত সম্পদ ইসলামের সেবায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন।মহানবী (সা.) মুসলমানদের বায়তুল মাল সংরক্ষণে খুব তৎপর ছিলেন। মুসলমানদের অধিকার যেন সংরক্ষিত থাকে এজন্য তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন,“ এই গলার হারটি তোমাদের সকলের সম্পদ,যদি তোমরা অনুমতি দাও তবে আবুল আসকে কোন মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দিয়ে এ গলার হারটি যয়নাবকে ফিরিয়ে দেব।” রাসূলের সঙ্গীরা সর্বসম্মতভাবে তাঁর প্রস্তাব মেনে নিলেন। মহানবী আবুল আসকে মুক্ত করে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন যে,যয়নাবকে তিনি মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দেবেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যয়নাবকে মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন।
বদর যুদ্ধের কয়েকটি বিষয় ছিল অত্যন্ত শিক্ষণীয়-এক. মুসলিম ও কাফেররা যেভাবে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল, তাতে উভয় দলের নৈতিক ও চারিত্রিক পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাদের একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছিল, অপরদল তাগুত, শিরক ও শয়তানের পথে যুদ্ধ করছিল। আল্লাহ তার পথে যুদ্ধকারীদের অন্যদের উপর বিজয় দিয়েছিলেন। দুই. মুসলিমরা সংখ্যায় নগণ্য ও অস্ত্রে অপ্রতুল হওয়া সত্বেও যেভাবে কাফেরদের বিশাল সংখ্যা ও উন্নত অস্ত্র-সস্ত্রের মোকাবেলা করেছে, তাতে এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, তারা আল্লাহর সাহায্যপুষ্ট। তিন. আল্লাহর প্রবল প্রতাপ ও অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে গাফেল হয়ে যারা সংখ্যাধিক্য ও সমরাস্ত্রের শক্তিতে আত্মম্ভ্রিতায় মেতে উঠেছিল, আল্লাহ্‌ তাদেরকে পরাজিত করেছিলেন।ইসলামে জিহাদ যে কেবল জয়ের জন্য যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধ প্রস্তুতিমাত্র নয়, রক্ত ও মৃত্যুর বিভীষিকা যে জিহাদের মূল চিত্র ও চেতনা নয়, বদরের প্রান্তরে প্রার্থনার কান্না, যুদ্ধকালে রোজা রেখে ক্ষুধার্ত থাকা আর শান্তি ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ধরে রাখার মধ্য দিয়ে বদর যুদ্ধ তার এক উজ্জ্বল মানবিক রূপ উপহার দিয়েছে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল