রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কুরআন তেলাওয়াত শুনে জিনদের ইসলাম গ্রহণ


মো. আবু রায়হানঃ জিন হচ্ছে একটি জীব বা মাখলুক।আরবি জিন শব্দটির অর্থ এমন কোন কিছু যা গুপ্ত, অদৃশ্য, লুক্কায়িত অন্তরালে বসবাসকারী বা অনেক দূরবর্তী। সাধারণত মানুষের চোখে তারা দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। কিন্তু, জিনরা মানুষদেরকে দেখতে পায়। এ কারণেই তাদেরকে জিন বলা হয়।অনেকে বলার চেষ্টা করেন আসলে জিন বলে কিছু নেই ,তা ডাহা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আসমানি কিতাবে যারা বিশ্বাস করে, যেমন—ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান, তারা সবাই জিনের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। পৌত্তলিক, কিছু দার্শনিক ও বস্তুবাদী গবেষক জিনের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। দার্শনিকদের একটি দল বলে থাকে, ফেরেশতা ও জিন রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়।জিনের অস্তিত্ব স্বীকার করা ঈমান বিল গায়েব অদেখার প্রতি ঈমান আনার অন্তর্ভুক্ত। সুরা আর-রাহমানে জিন ও মানুষকে একসঙ্গে সম্বোধন করা হয়েছে।সুলায়মান (আ.)-এর আমলে জিনদের কাজকর্ম করার তথ্য কুরআনে উল্লেখ আছে।সুরা জিন নামের কুরআনে একটি স্বতন্ত্র সুরার নামকরণ হয়েছে। ছোট-বড় প্রায় ৫৭ টি আয়াতে এ সম্পর্কিত বহু বিস্ময়কর তথ্য রয়েছে, যা নিশ্চিতরূপে জিনের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। জিন ও ফেরেশতাদের অস্তিত্ব কুরআন ও হাদিসের অকাট্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। এটা অস্বীকার করা কুফর। মানব সৃষ্টির প্রধান উপকরণ যেমন মৃত্তিকা তেমনি জিন সৃষ্টির প্রধান উপকরণ অগ্নি। জিন পৃথিবীতে মানব আগমনের পূর্ব থেকেই ছিল এবং এখনো তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান।কুরআন এবং হাদীস অনুসারে জিনদের তৈরি করা হয়েছে ধোঁয়াবিহীন আগুন (আরবি শব্দ-নার) হতে। কুরআনে বলা হয়েছে, “আর তিনি জিনকে সৃষ্টি করেছেন আগুনের শিখা দিয়ে।”(সুরা আর রহমান আয়াত- ১৫)। আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে, “আর আমি এর আগে জিন সৃষ্টি করেছি প্রখর আগুন দিয়ে।” (সুরা আল-হিজর আয়াত-২৭)। তাদের মধ্যেও মুসলিম এবং কাফির ভেদ রয়েছে।আল্লাহ বলেন, “আমি জিন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি”(সূরা আয্-যারিয়াত আয়াত- ৫৬)। মানুষ কর্তৃক জিন বশীভূত করা বা জিনের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি প্রচলিত ।বিজ্ঞান এখনও জ্বীনের অস্তিত্বের প্রমাণ আবিষ্কারে সক্ষম হয়নি। প্রাক ইসলামী যুগেও জিন জাতি সংক্রান্ত বিশ্বাস অন্যান্য আরব এবং এর কাছাকাছি এলাকায় বিদ্যমান ছিল। জাহেলি যুগে আরবরা যখন কোন জন মানবহীন প্ৰান্তরে রাত্রি যাপন করতো তখন উচ্চস্বরে বলতো, আমরা এ প্রান্তরের অধিপতি জিনের আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এভাবে ভয় পেলে মানুষরা জিনের আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করত। ফলে জিনের আত্মম্ভরিতা বেড়ে যেত। এভাবে আশ্রয়-গ্রহণের চেষ্টা করার পরও জিনরা মানুষদের উল্টো ভয় দেখাত। এই জাতির মধ্যেও মানুষের ন্যায় নর ও নারী আছে এবং সন্তান প্রজননের ধারা বিদ্যমান আছে। পবিত্র কুরআনে যাদেরকে শয়তান বলা হয়েছে, তারা জিনদের দুষ্ট শ্রেনীর নাম। অধিকাংশ আলেমের মতে, সমস্ত জিনই শয়তানের বংশধর। তাদের মধ্যে কাফের ও মুমিন দুই শ্রেণী বিদ্যমান। যারা ঈমানদার তাদেরকে জিন বলা হলেও তাদের মধ্যে যারা কাফির তাদেরকে শয়তান বলা হয়। তবে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, জিনরা ভিন্ন প্ৰজাতি, তারা শয়তানের বংশধর নয়। তারা মারা যায়। তাদের মধ্যে ঈমানদার ও কাফির দু শ্রেণী রয়েছে। পক্ষান্তরে ইবলিসের সন্তানদেরকে শয়তান বলা হয়, তারা ইবলীসের সাথেই মারা যাবে, তার আগে নয়। ( কুরতুবী, ড. উমর সুলাইমান আল-আশকার- আলামুল জিন্ন ওয়াশ শায়াতীন)।

প্রতিদান ও শাস্তি এবং আদেশ ও নিষেধাবলীর ব্যাপারে জিনদের বিধানও মানুষদের মতনই। নবি রাসুল মানুষ এবং জিনদের হেদায়েতের বার্তাবাহক হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘ওহে মানুষ ও জিন, আমি কি যুগে যুগে তোমাদের কাছে নবী প্রেরণ করিনি...?’ (সুরা আনআম, আয়াত-৩০)। যেহেতু মহানবী (সা.) কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বজগতের জন্য নবি হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন, তাই বর্তমান জিনদের জন্য শরিয়তে মোহাম্মদী তাদের ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে। উলামাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে যে, মহান আল্লাহ জিনদের মধ্য হতে তাদের জন্য কোন নবি প্রেরণ করেছিলেন, না করেননি? কুরআনের কিছু আয়াতের বাহ্যিক অর্থ থেকে প্রমাণিত হয় যে, জিনদের মধ্যে কেউ নবি হয়নি। সমস্ত নবি ও রাসুল মানুষদের মধ্য হতেই মনোনীত হয়েছেন। যত জনই রাসুল হয়েছেন, সকলেই মানুষ ছিলেন। এই জন্য রাসুল (সা) যেমন মানুষদের জন্য রাসুল ছিলেন এবং আছেন, অনুরূপ জিনদের রাসুল ও তিনিই। আর তাঁর পয়গামকে জিনদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। নবি রাসুল জিন ও মানব উভয়জাতির হিসেবে প্রেরিত হন। সুলায়মান (আঃ) এর সেনাদলে জিনদের অংশগ্রহণ ছিল যা কুরআনে উল্লেখ আছে।
জিনরা এক সময় আকাশ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করত । তারা আসমানের সংবাদ শোনার জন্যে উপরের দিকে যেত। হাদিসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ্ তায়ালা যখন আকাশে কোন হুকুম জারি করেন তখন সব ফেরেশতা আনুগত্যসূচক পাখা নাড়া দেয়। এরপর তারা পরস্পর সে বিষয়ে আলোচনা করে। শয়তানরা এখান থেকে এগুলো চুরি করে অতীন্দ্ৰিয়বাদীদের কাছে পৌছিয়ে দেয় এবং তাতে নিজেদের পক্ষ থেকে শত শত মিথ্যা বিষয় সংযোজন করে দেয়।” (বুখারী-৪৭০১, ৪৮০০)। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নবুয়াত লাভের পূর্বে আকাশের সংবাদ চুরির ধারা বিনা বাধায় অব্যাহত ছিল। শয়তানরা নির্বিঘ্নে উপরে আরোহণ করে ফেরেশতাগণের কাছে শুনে নিত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) এর নবুওয়াত লাভের সময় তার ওহীর হেফাযতের উদ্দেশ্যে চুরির সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং কোন শয়তান সংবাদ চুরির জন্য আকাশে গেলে তাকে লক্ষ্য করে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত করা হতো। “এবং আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা তা পরিপূর্ণ।“( সুরা জিন আয়াত- ৮)। আসমানের উপর ফেরেশতারা পাহারা দিতে থাকেন। যাতে আসমানের কোন কথা অন্য কেউ শুনতে না পায়। আর এই তারাগুলো শয়তানের উপর উল্কাপিন্ড হয়ে উৎক্ষিপ্ত হয়। চোর বিতাড়নের এই নতুন উদ্যোগ দেখেই শয়তান ও জিনরা চিন্তিত হয়ে পড়ে। এ সময়ে জিনরা পরস্পরে পরামর্শ করল যে আকাশের খবরাদি শোনার ব্যাপারে বাধাদানের এই ব্যাপারটি কোন আকস্মিক ঘটনা মনে হয় না। পৃথিবীতে অবশ্যই নতুন কোন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তারা ঠিক করল যে, পৃথিবীর পূর্ব পশ্চিম ও আনাচে-কানাচে জিনদের প্রতিনিধিদল প্রেরণ করতে হবে। যথাযথ খোঁজাখুঁজি করে এই নতুন ব্যাপারটি কি তা জেনে আসবে।
সে সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) কয়েকজন সাহাবিসহ বাতনে নাখলা নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। তাঁর ওকা্জ বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। আরবরা আমাদের যুগের প্রদর্শনীর মত বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ বিশেষ দিনে মেলার আয়োজন করত। এসব মেলায় বহুলোক উপস্থিত থাকত, দোকান খোলা হত এবং সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হত। ওকাজ নামক স্থানে প্রতি বছর এমনি ধরনের এক মেলা বসত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্ভবতঃ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সেখানে গমন করছিলেন। নাখলা নামক স্থানে তিনি যখন ফজরের নামাজে কুরআন পাঠ করছিলেন, তখন জিনদের হেজাজের অনুসন্ধানী দলটি সেখানে গিয়ে পৌঁছল। তারা কুরআন পাঠ শুনে বলতে লাগল, এই কালামই আমাদের ও আকাশের খবরাদির মধ্যে অন্তরায় হয়েছে। তারা সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে স্বজাতির কাছে ঘটনা বিবৃত করল।আর স্মরণ করুন, যখন আমরা আপনার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম জিনদের একটি দলকে, যারা মনোযোগসহকারে কুরআন পাঠ শুনছিল। অতঃপর যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হল, তারা বলল, চুপ করে শুন। অতঃপর যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হল তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে। তারা বলেছিল, “হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শ্রবণ করেছি, যা অবতীর্ণ করা হয়েছে মূসার পরে, তা ওর পূর্ববতী কিতাবের সত্যায়নকারীরূপে সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহর দিকে আহবানকারীর আহবানে সাড়া দাও এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর,আল্লাহ তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে তোমাদেরকে রক্ষা করবেন।“ (সুরা আহকাফ আয়াত ২৯-৩১)।

আল্লাহ্ তায়ালা এসব আয়াতে সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে তাঁর রাসূলকে অবহিত করেছেন। আল্লাহ বলেন, “বলুন ‘আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগের সাথে শুনেছে অতঃপর বলেছে, আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি।“(সুরা জিন আয়াত-১)।ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন এই ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) জিনদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআন শোনাননি এবং তিনি তাদেরকে দর্শনও করেন নি বরং তার কাছে জিনদের কথা ওহি করে শোনানো হয়েছিল মাত্ৰ।” (বুখারী-৪৯২১, মুসলিম-৪৪৯)।কারণ অনুসন্ধানের জন্যে পৃথিবীর কোণে কোণে সন্ধানকারী দল প্রেরণ করেছিল, অতঃপর ‘নাখলাহ’ নামক স্থানে একদল জিন রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে কুরআন শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছিল (ফাতহুল কাদীর)। রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজ শেষ করলে জিনরা ইসলামের সত্যতায় বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল এবং তদন্তকার্যের রিপোর্ট পেশ করে একথাও বলল, আমরা মুসলিম হয়ে গেছি। তোমাদেরও ইসলাম গ্ৰহণ করা উচিত। জিনরা বলল, আমরা এমন একটি বাণী শুনে এসেছি যা ভাষাগত উৎকর্ষতা, বিষয়বস্তু, প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বিধান ইত্যাদিতে বিস্ময়কর ও অতুলনীয়। “যা সত্যের দিকে হেদায়াত করে; ফলে আমরা এতে ঈমান এনেছি। আর আমরা কখনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরিক করব না।“(সুরা জিন আয়াত- ২)। জিনরাও একাধিকবার নবী করীম (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়েছিল। জিনরা তো একবার শুনেই এই কুরআনের প্রতি ঈমান আনল।
স্বল্প কিছু সংখ্যক আয়াত শুনেই তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটল এবং তারা বুঝে নিল যে, এটা কোন মানুষের রচিত কোনো কথা নয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে বিশেষ করে তাদের সর্দার আবু লাহাব ,জেহেল উদবা ,শাইবাদের এই কুরআন দ্বারা কোন লাভ হয়নি। অথচ তারা নবী (সা.)-এর মুখে একাধিকবার তারা কুরআন শুনেছে। এ ছাড়া তিনি নিজেও তাদেরই একজন ছিলেন এবং তাদেরই ভাষাতে রাসুল (সা) তাদেরকে কুরআন পাঠ করে শুনাতেন।মক্কার কাফেরদেরকে শোনানোর জন্যে কুফর ও অহংকারের নিন্দা ও ধ্বংসকারিতা বর্ণিত হয়েছে। মক্কার কাফের মুশরেকদের লজ্জা দেয়ার উদ্দেশ্যে জিনদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, জিনরা অহংকার ও গর্বে তোমাদের চেয়েও বেশি, কিন্তু কুরআন শুনে তাদের অন্তরও বিগলিত হয়ে গেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করেছে। তোমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা জিনদের চেয়ে বেশি জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনা দান করেছেন; কিন্তু তোমরা ইসলাম গ্ৰহণ করছ না। আল্লাহ বলেন, “অপরপক্ষে সীমালংঘনকারীরা তো জাহান্নামেরই ইন্ধন।“ (সুরা জিন আয়াত-১৫)।মানুষের মত জিনরাও জাহান্নাম এবং জান্নাত দুটিতেই প্রবেশ করবে। এদের মধ্যে যে কাফের সে জাহান্নামে যাবে এবং মুসলিম জান্নাতে যাবে। মাটির সৃষ্টি মানুষ যেমন মাটির আঘাতে কষ্ট পায়, তেমনি আগুনের সৃষ্টি জিন জাহান্নামের আগুনে কষ্ট পাবে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল