আসহাবে হিজর বা সামুদ জাতির ওপর আল্লাহর গজব
হিজর সালেহ (আ.)-এর জাতি সামূদের জনবসতির নাম। এদেরকে আসহাবে হিজর বলা হয়েছে। কুরআনে এদেরকে আসহাবে হিজর বা হিজরবাসী নামেও অভিহিত করা হয়েছে।ইতিহাসে এই জাতি সামুদ জাতি নামেও সমধিক পরিচিত।তাঁদের সেই ঐতিহাসিক এলাকার বর্তমান নাম হলো ফাজ্জুন্নাকাহ’ এবং ‘মাদায়েনে সালেহ’। এ স্থানটির অবস্থান হিজাজ ও সিরিয়ার গোটা মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে। সামুদ জাতির বাসস্থান ছিল হেজাজ ভূমি তথা বর্তমান সৌদির সিরিয়া সীমান্ত বরাবর অংশ এবং সিরিয়ার মধ্যস্থল হিজর ও ওয়াদিল কুরা নামক স্থানে।মূলত হিজর ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় আবাসস্থল।সামুদ জাতির ধ্বংসাবশেষ মদিনার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। বর্তমান শহর আল উলা থেকে কয়েক মাইল ব্যবধানে তা দেখা যায়। বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত আছে, তাবুক যুদ্ধের সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজর নামক সে স্থানটি অতিক্রম করেন, যেখানে সামূদ জাতির উপর আযাব এসেছিল। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দেন, কেউ যেন এ আযাববিধ্বস্ত এলাকার ভেতরে প্রবেশ কিংবা এর কূপের পানি ব্যবহার না করে। আর যদি ঢুকতেই হয় তবে যেন ক্ৰন্দনরত অবস্থায় ঢুকে। (বুখারী- ৪৩৩, ৩৩৭৮, ৩৩৭৯, ৩৩৮১, ৪৭০২, ৪৪২০, মুসলিম-২৯৮০, ২৯৮১, মুসনাদে আহমাদ- ২/৬৬, ১১৭, ৭২, ৯১)। নবম হিজরীতে তাবুক যাওয়ার পথে যখন নবী (সাঃ) তাদের সেই জনপদের উপর দিয়ে পার হলেন, তখন তিনি মাথায় কাপড় জড়িয়ে নিলেন, নিজের সওয়ারীর গতি বাড়িয়ে দিলেন এবং সাহাবাগণকে বললেন, তোমরা কান্নারত অবস্থায় ও আল্লাহর আযাবকে স্মরণ করে এই এলাকা অতিক্রম কর।(ইবনে কাসীর, বুখারী ৪৩৩, মুসলিম- ২২৮৫নং)।
আল্লাহ বলেন ,হিজরবাসিগণও রসূলদেরকে মিথ্যা মনে করেছিল।(সুরা হিজর আয়াত-৮০)। সেখানকার অধিবাসীরা তাদের নবী সালেহ (আ.)-কে মিথ্যা মনে করেছিল। কিন্তু এখানে মহান আল্লাহ (বহুবচন শব্দ ব্যবহার করে) বলেছেন, তারা রসূলদেরকে মিথ্যা মনে করেছিল। কারণ একজন নবীকে মিথ্যা মনে করার অর্থ হল, সকল নবীদেরকে মিথ্যা মনে করা। আর সালেহ (আ.)-এর সম্প্রদায় সামূদ জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে কুরআনের নয়টি সূরার মাঝে। আল আরাফ, হুদ, আল হিজর, আন নম্ল, আল মুরসালাত, আন-নাজম, আল কামার, আল হাক্কাহ, আশ-শাম্স। কুরআনে মোট আট জায়গায় সালেহ (আ.) এর আলোচনা করা হয়েছে।সামুদ জাতি শিল্প ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ছিল।বলা হয়ে থাকে আদ জাতির পর আল্লাহ তায়ালা তাদের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি দান করেছেন। তাদের জীবনযাপনের মান যতটা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল সেই তুলনায় মানবতা ও নৈতিকতার মান ছিল ততই নিম্নগামী ও অবক্ষয়ে ভরা।তারা যেমন খোলা মাঠে প্রান্তরে পাথর খোদিত প্রাসাদ তৈরি করেছিল।আল্লাহ বলেন, তারা নিশ্চিন্তে পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করত। (সুরা হিজর আয়াত-৮২)।অর্থাৎ, বিনা প্রয়োজনে ও নির্ভয়ে তারা পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করত। অপরদিকে সমাজে কুফর, শিরক ও পৌত্তলিকতার প্রসার ঘটিয়েছিল। ন্যায়-ইনসাফ বলে সে সমাজে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অন্যায় ও অবিচারে সমাজ ধবংসের পথে।সেই জাতির সমাজে চরিত্রহীন লোকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। হযরত সালেহ (আ.)সামুদ জাতিকে যে সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন, তাতে নিম্ন শ্রেণির লোকেরাই সাড়া দিয়েছিল।হযরত সালেহ (আ.) সারা জীবন তাদের হেদায়েতের পথে আনার চেষ্টা করেছেন। এতে অল্প কিছু সঙ্গী ছাড়া গোটা জাতি তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে। একপর্যায়ে সামুদ জাতি দাবি করে, আপনি যদি সত্যি নবী হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের কাতেবা নামের পাহাড় থেকে ১০ মাসের গর্ভবতী, সবল ও স্বাস্থ্যবতী একটি উট বের করে দেখান। এটি দেখাতে পারলে আমরা আপনার ওপর ঈমান আনব। সালেহ (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। সালেহ (আ.) তাদের এ দাবির ওপর কঠিন শপথ ও প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন যে আল্লাহ তাআলা তাদের এ দাবি পূরণ করলে তারা ইমান আনবে এবং তাঁকে মান্য করবে। অতঃপর তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই নিশ্ছিদ্র প্রস্তরটি নড়ে উঠল এবং তা ফেটে একটি গর্ভবতী ও দুগ্ধবতী উটনী বের হয়ে এলো। এ বিস্ময়কর মোজেজা দেখে কিছু লোক তৎক্ষণাৎ ইমান আনলেও অবশিষ্টরা যখন ইমান আনার ইচ্ছা প্রকাশ করল, তখন তাদের পুরোহিতরা তাদের বিরত রাখল। সালেহ (আ.) নিজ সম্প্রদায়ের অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি আল্লাহর আজাব এসে যাওয়ার আশঙ্কা করলেন। তাই নবীসুলভ দয়া প্রকাশ করে বললেন, 'এ উটনীর দেখাশোনা করো, একে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে দাও। একে কষ্ট দিয়ো না, তাহলেই তোমরা আল্লাহ আজাব থেকে বেঁচে যেতে পারবে।' সামুদ জাতি এই উটনীর পরিচর্যা কিছুকাল চালিয়েছিল। তারা একই কূপ থেকে এ উটনী ও অন্য জন্তুদের পানি পান করাত। কিন্তু এ উটনী যখন পানি পান করত, তখন পানি নিঃশেষে পান করে ফেলত। সালেহ (আ.) এ ফয়সালা দিলেন যে একদিন এ উটনী পানি পান করবে, অন্যদিন সম্প্রদায়ের সবাই পানি নেবে। তবে যেদিন উটনী পানি পান করবে, সেদিন সবাই এই উটনীর দুধ দিয়ে সব পাত্র ভর্তি করে নিত। সার্বিকভাবে পানি উত্তোলন নিয়ে এ উটনীর কারণে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। অন্যদিকে এভাবে পানি খেয়ে, বিভিন্ন প্রান্তরে বিচরণ করে খেয়েদেয়ে উটনীটি অত্যন্ত মোটাতাজা ও ভয়ংকর হয়ে উঠল। ফলে লোকজন উটনীর ওপর ক্ষুব্ধ হতে চলল। একপর্যায়ে সামুদ জাতির 'মিসদা' ও 'কাসার' নামের দুই যুবক বিভিন্ন প্রলোভনের নেশায় মত্ত হয়ে এই উটনীকে হত্যা করে।অন্য বর্ণনায় আছে তাদের সম্প্রদায়ের এক যুবক উষ্ট্রীকে হত্যা করার জন্য বেরিয়ে পড়ল। সে তার প্রতি তীর নিক্ষেপ করল এবং তরবারীর আঘাতে তার পা কেটে হত্যা করল।কুরআনুল কারীম তাকেই সামূদ জাতির সর্ববৃহৎ হতভাগ্য লোক বলে আখ্যা দিয়ে বলেছেঃ (إِذِ انْبَعَثَ أَشْقَاهَا) (সূরা আস-শামস- ১২)
কেননা, তার কারণেই গোটা সম্প্রদায় আযাবে পতিত হয়। উষ্ট্রী হত্যার ঘটনা জানার পর সালেহ আলাইহিস সালাম স্বীয় সম্প্রদায়কে আল্লাহর নির্দেশ জানিয়ে দিলেন যে, এখন থেকে তোমাদের জীবন কাল মাত্র তিন দিন অবশিষ্ট রয়েছে। এরপরই আযাব নেবে আসবে। এ ওয়াদা সত্য, এর ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভবপর নয়। কিন্তু যে জাতির দুঃসময় ঘনিয়ে আসে, তার জন্য কোন উপদেশ ও হুশিয়ারী কার্যকর হয় না। হতভাগ্য জাতি একথা শুনেও ক্ষমা ও প্রার্থনা করার পরিবর্তে স্বয়ং সালেহ আলাইহিস সালামকেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। তারা ভাবল, যদি সে সত্যবাদী হয় এবং আমাদের উপর আযাব আসেই, তবে আমরা নিজেদের পূর্বে তার ভবলীলাই সাঙ্গ করে দেই না কেন? পক্ষান্তরে যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তবে মিথ্যার সাজা ভোগ করুক। সামূদ জাতির এ সংকল্পের বিষয় কুরআনুল কারীমের অন্যত্র বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিছু লোক রাতের বেলা সালেহ আলাইহিস সালামকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার গৃহপানে রওয়ানা হল। কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা পথিমধ্যেই প্রস্তর বর্ষণে তাদেরকে ধ্বংস করে দিলেন। আল্লাহ বলেন, “তারাও গোপন ষড়যন্ত্র করল এবং আমিও প্রত্যুত্তরে এমন কৌশল অবলম্বন করলাম যে, তারা তা জানতেই পারল না।(সূরা আন-নমল আয়াত- ৫০)।নিদর্শন মতে প্রথম দিন তাদের সবার মুখমণ্ডল হলদে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন লাল এবং তৃতীয় দিন ঘোর কালো হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, অতঃপর প্রভাতকালে বিকট আওয়াজ তাদেরকে পাকড়াও করল।( সুরা হিজর আয়াত-৮৩)।সালেহ (আ.) বললেন যে, তোমাদের উপর তিনদিন পর আল্লাহর আযাব আসবে। সুতরাং চতুর্থ দিনে তাদের উপর এই আযাব এসে পড়ল। অতঃপর তারা ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হল,ফলে তারা নিজ গৃহে নতজানু অবস্থায় ধ্বংস হয়ে গেল। (সুরা আরাফ আয়াত- ৭৮)। বজ্রপাতের ভয়ংকর শব্দে মানুষ ভীত বিহ্বল ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অবশেষে গগন বিদারী আওয়াজে তাদের অপমৃত্যু ঘটে। আসমানি গজব অবিশ্বাসীদের চিরতরে ধবংস করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারপর সীমা লঙ্ঘনকারীদের মহানাদ আঘাত করে। ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে (ধ্বংস হয়ে যায়)। যেন তারা কখনোই সেখানে বসবাস করেনি। জেনে রেখ, সামুদ জাতি তাদের প্রভুকে অস্বীকার করেছিল। আরও জেনে রেখো, ধ্বংসই হলো সামুদ জাতির পরিণাম।’ (সুরা হুদ আয়াত - ৬৭-৬৮)। একসময় যে জাতি পাহাড়ে ঘর নির্মাণ করত, পৃথিবীতে যাদের চেয়ে শক্তিশালী কোনো জাতি ছিল না, আসমানি আযাবে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। ।এসব আযাব-বিধ্বস্ত সম্প্রদায়ের বস্তিগুলোকে আল্লাহ্ তা'আলা ভবিষ্যৎ লোকদের জন্য শিক্ষাস্থল হিসেবে সংরক্ষিত রেখেছেন। কুরআনুল কারীম আরবদেরকে বার বার হুশিয়ার করেছে যে, তোমাদের সিরিয়া গমনের পথে এসব স্থান আজো শিক্ষার কাহিনী হয়ে বিদ্যমান রয়েছে।
গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন