হারুত মারুত ও জোহরা নামক নারীকে নিয়ে যে মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে



বর্তমানে ইরাকের ফোরাত নদীর তীরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া তৎকালীন সময়ের উন্নত এক শহরের নাম বাবেল। যার অবস্থান প্রাচীন মেসোপটেমিয়া বর্তমানের মধ্য ইরাক।সারা দুনিয়া যেটিকে ব্যাবিলন নামে চেনে।বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুটি নাম জড়িয়ে আছে। যাঁদের নিয়ে রচিত হয়েছে নানা কল্পকাহিনি। গদ্য-পদ্য আর সাহিত্যরসে ভরপুর সেসব ঘটনাবলি কমবেশি সবাই জানেন।ঘটনাটি এমন-
হারুত এবং মারুত দুজন ফেরেশতার নাম। যাদেরকে বিশেষ কারণে পৃথিবীর কিছু বিষয় নিরীক্ষণের জন্য আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাদের নিরীক্ষায় অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দেয় এবং শাস্তির মুখোমুখি হয়। ঘটনাটি এরকম- হজরত আদম (আ.) এবং বেশ কিছু নবি-রাসুলের পরলোক গমনের পর ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে যখন পাপাচার এবং অবাধ্যতা ছড়িয়ে পড়ে তখন ফেরেশতারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো, দেখো, মানুষগুলো কেমন অবাধ্য। তারা আল্লাহর আনুগত্য ছেড়ে পাপাচার এবং বিশৃংখলায় লিপ্ত হয়ে গেছে। আমরা যদি হতাম তবে কখনোই এমনটি করতাম না। আল্লাহ তাআলা তাদের কথা শুনে বললেন, ঠিক আছে, তবে তোমাদের মধ্য থেকে দুজনকে পৃথিবীতে পাঠাও পরীক্ষার জন্য। দেখা যাক তারা পৃথিবীতে কীভাবে নিজেদের পরিচালনা করে। এরপর আল্লাহ তাআলা হারুত-মারুত নামের দুজন ফেরেশতাকে মানুষের আকৃতি ও মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। পাঠানোর আগে আল্লাহ তাদের বলে দেন, আমি মানুষকে বিভিন্ন নবি-রাসুল বা কিতাবের মাধ্যমে পাপকাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছি, কিন্তু তোমাদেরকে সরাসরি উপদেশ দিচ্ছি- কখনো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, কখনো কোনো নারীর সঙ্গে অসৎসঙ্গমে লিপ্ত হবে না, কখনো মদ্যপান করবে না। তাদেরকে তৎকালীন বাবেল (ইরাক) শহরে পাঠানো হয় এবং এই ঘটনা হজরত সোলায়মান (আ.)-এর সময়কার। পৃথিবীতে আসার কয়েকদিন পরই এ ফেরেশতাদ্বয় জোহরা নামের এক অতুল্য রূপসী নারীর রূপ দেখে পাগল হয়ে যায় এবং তাকে একান্তে কামনা করে। ওই নারী শর্ত দেয়, তোমরা যদি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো তবে আমি তোমাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করবো। তারা বলে, এ কাজ আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। ওই নারী একজন লোককে দেখিয়ে আবার বলে, তাহলে ওই লোকটাকে হত্যা করো। তারা বললো, এ কাজও আমরা করতে পারবো না। অতঃপর জোহরা বললো, তাহলে একটু মদ্যপান করো তাহলে আমি তোমাদের সঙ্গে একান্তে মিলিত হবো। তারা মদ্যপানকে ছোট পাপ ভেবে জোহরার সঙ্গলাভের কামনায় বেশ কিছুটা মদ পান করে। মদপানের পর মাতাল অবস্থায় তারা ওই নারীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং অচৈতন্য অবস্থায় ওই লোককেও হত্যা করে ফেলে। হুঁশ ফেরার পর তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে থাকে। তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ বলেন, তোমরা শাস্তির উপযুক্ত হয়েছো। এখন সেই শাস্তি তোমরা পৃথিবীতেও ভোগ করতে পারো আবার আখেরাতেও ভোগ করতে পারো। তারা বললো, আমরা দুনিয়াতেই শাস্তি ভোগ করতে চাই। তাদের সেই সুযোগই দেয়া হয়।উপরিউক্ত কাহিনি ভিত্তিহীন,মনগড়া।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
"ইহুদীরা (তওরাত অনুসরণের পরিবর্তে) সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তান যা আবৃত্তি করতো তার অনুসরণ করতো। অথচ সুলায়মান কখনো যাদু করেনি এবং সত্য প্রত্যাখ্যান করেনি। কিন্তু শয়তান মানুষকে যাদু শিক্ষা দিতো এবং কাফের হয়ে গিয়েছিল। ইহুদীরা বাবেল শহরের দুই ফেরেশতা হারুত ও মারুতের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছিল তা অনুসরণ করত। 'আমরা তোমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ-সুতরাং যাদুকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে কাফের হইও না'-এ কথা না বলে ওই দুই ফেরেশতা কাউকে কিছু শিক্ষা দিত না। কিন্তু তারা ওই দুই ফেরেশতা থেকে শুধু এমন কিছু শিখত যা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যায়। অথচ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কারো ক্ষতি করতে পারে না। তারা শুধু ওই সব অংশই শিখত যা ছিল তাদের জন্য ক্ষতিকর এবং তাদের জন্য কোন ধরনের উপকারী ছিল না। আর তারা নিশ্চয়ই জানত, যে এ পণ্য ক্রয় করবে পরকালে তার কোন মুনাফা পাবে না। যে জিনিসের বদলে তারা নিজেদের বিক্রি করল তা বড়ই নিকৃষ্ট, যদি তারা জানত ৷" (সুরা বাকারা আয়াত-১০২)
কথিত আছে যে, সুলাইমান (আঃ)-এর যামানায় যাদুর কার্যকলাপ ব্যাপক হয়ে গিয়েছিল। সুলাইমান (আঃ) এ পথ বন্ধ করার জন্য যাদুর কিতাবগুলো সংগ্রহ করে তাঁর আসন অথবা সিংহাসনের নীচে দাফন করে দেন। সুলাইমান (আঃ)-এর মৃত্যুর পর শয়তান ও যাদুকররা ঐ কিতাবগুলো বের করে কেবল যে মানুষদেরকে দেখালো তা নয়, বরং তাদেরকে বুঝালো যে, সুলাইমান (আঃ)-এর রাজশক্তি ও শৌর্যের উৎস ছিল এই যাদুরই কার্যকলাপ। আর এরই ভিত্তিতে ঐ যালেমরা সুলাইমান (আঃ)-কে কাফের সাব্যস্ত করল। মহান আল্লাহ তারই খন্ডন করেছেন। (ইবনে কাসীর ইত্যাদি) আর আল্লাহই ভালো জানেন।
তাফসিরে ইবনে কাসিরে হজরত আলি (রা.), হজরত ইবনে আব্বাস (রা.), হজরত ইবনে মাসউদ (রা.), হজরত ইবনে উমর (রা.), হজরত কাব আহবার (রা.), হজরত সুদ্দি (রা.), এবং হজরত কালবি (রহ.)-এর বরাতে এ ঘটনা বর্ণনা করেন। বাবেল শহরে তখন জাদুবিদ্যার খুব প্রচলন ছিলো। দুষ্টু জাদুকররা নানাভাবে জাদুর মাধ্যমে মানুষকে হয়রানি করতো। ওই ফেরেশতাদ্বয় পৃথিবীতে কিছুদিন থাকার পর তারাও মানুষের মাঝে জাদুবিদ্যা শেখানো শুরু করে এবং দুষ্টু জাদুর প্রচলন ঘটায়। যে জাদুর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাদ লাগতো এবং তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যেতো। হজরত সোলায়মান [আ.] নিজস্ব জ্বিনদের মাধ্যমে এই দুই ফেরেশতার সংবাদ অবগত হয়ে তাদেরকে একটি অন্ধকার কূপে বন্দি করেন। যদিও কোনো কোনো দুর্বল রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, কেয়ামত পর্যন্ত তাদের বন্দি করে রাখা হবে।
এক
ফিরে আসছি মূল আলোচনায়। হারুত ও মারুত আসলে কে? এ নিয়ে রয়েছে নানা গল্প। ইমাম তাবারি (রহ.) ও ইবন জারির (রহ.)-এর মতে, কোরআনের আয়াতে উল্লিখিত শব্দ মালাকাইনে বা মালিকাইনে এখানে দুটি পঠন রীতিই চালু আছে। যদি বলা হয় ‘মালিকাইনে (দুজন শাসক), তাহলে এর ব্যাখ্যা হলো হারুত মারুত কোনো ফেরেশতা নন বরং তৎকালীন সময়ের দুজন বাদশা, যাঁরা কোনো অপরাধ করেছিলেন আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন যে আমাদের দুনিয়াতেই শাস্তি দিন। আল্লাহ সেটি কবুল করেছেন ও দুনিয়াবাসীর শিক্ষার জন্য নিদর্শন হিসেবে সেভাবে রেখেছেন। যেন মানুষ জাদু নামক কুফরি থেকে বিরত থাকে। আর যদি মালাকাইনে দুজন ফেরেশতা বলা হয়, তাহলে এর ব্যাখ্যা হলো মহান আল্লাহ তাআলা নিজ সৃষ্টি ফেরেশতাদ্বয়কে ইচ্ছা করেই এভাবে রেখেছেন যেন তাঁরা মানুষকে জাদুর বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেন। এটি তাঁদের কোনো শাস্তির কারণে নয়। কারণ ফেরেশতারা কোনো অপরাধ করতে পারেন না। তাঁদের সে যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টিই করা হয়নি। যেমন কোরআনের বলা হয়েছে, ফেরেশতা অমান্য করে না তা, যা আল্লাহ তাঁদের আদেশ করেন। আর তাঁরা যা করতে আদেশপ্রাপ্ত হন তা-ই করেন। (সুরা তাহরিম আয়াত -৬)
দুই
কিছু মুফাসসিরগণ {وَمَا أُنْزِلَ} এর ما কে নেতিবাচক বলেছেন। অর্থাৎ, হারূত-মারূতের উপর কোন কিছু অবতীর্ণ হওয়ার কথা খন্ডন করেছেন। কিন্তু কুরআনের বাগধারা এর সমর্থন করে না। এই জন্যই ইবনে জারীর প্রভৃতি মুফাসসিরগণ এই মতের খন্ডন করেছেন। (ইবনে কাসীর) অনুরূপ হারূত-মারূতের ব্যাপারে তফসীরের কিতাবগুলো ইস্রাঈলী বর্ণনায় ভর্তি। কিন্তু কোন সহীহ মারফূ’ (মহানবী (সাঃ)-এর জবানী) বর্ণনা এ ব্যাপারে প্রমাণিত নেই। মহান আল্লাহ কোন বিশদ বিবরণ ছাড়াই সংক্ষিপ্তাকারে এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আমাদের এরই উপরে এবং এই পর্যন্তই বিশ্বাস রাখা উচিত। (তাফসীর ইবনে কাসীর) কুরআনের শব্দাবলী থেকে এটা অবশ্যই জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা বাবেল শহরে হারূত ও মারূত ফিরিশতাদ্বয়ের উপর যাদুবিদ্যা অবতীর্ণ করেছিলেন। আর এর উদ্দেশ্য (আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত) মনে হয় এই ছিল যে, যাতে তাঁরা মানুষদেরকে অবহিত করেন যে, নবীদের হাতে প্রকাশিত মু’জিযা যাদু নয়, বরং তা ভিন্ন জিনিস এবং যাদু হল এই যার জ্ঞান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদেরকে দান করা হয়েছে। (সেই যুগে যাদুর ব্যাপক প্রচলন ছিল, যার কারণে লোকেরা নবীদেরকে -- নাউযু বিল্লাহ -- যাদুকর ও ভেলকিবাজ মনে করত) এই বিভ্রান্তি থেকে মানুষদেরকে রক্ষা করার জন্য এবং পরীক্ষাস্বরূপ মহান আল্লাহ ফিরিশতাদ্বয়কে নাযিল করেন।
তিন
বানী-ইস্রাঈলদের চারিত্রিক অধঃপতনের প্রতি ইঙ্গিত করা যে, তারা কিভাবে যাদু শেখার জন্য ঐ ফিরিশতাদ্বয়ের পিছনে পড়েছিল এবং এ কথা পরিষ্কার করে বলে দেওয়া সত্ত্বেও যে, যাদু কুফরী, আমরা পরীক্ষার জন্য এসেছি - তারা যাদুবিদ্যা অর্জনের জন্য একেবারে ঝাপিয়ে পড়েছিল। আর এতে তাদের লক্ষ্য ছিল, পরের সুখী সংসার ধ্বংস করা এবং স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঘৃণার প্রাচীর খাড়া করা। অর্থাৎ, এই ছিল তাদের অধঃপতন, বিশৃঙ্খলা এবং ফাসাদমূলক কর্মকান্ডের শিকলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কড়া। আর এই ধরনের কাল্পনিক জিনিস এবং চারিত্রিক অধঃপতন যে কোনও জাতির ধ্বংসের নিদর্শন। আল্লাহ আমাদেরকে পানাহ দিন। আমীন।
চার
অর্থাৎ, আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য কেবল পরীক্ষাস্বরূপ। (ফাতহুল ক্বাদীর)
পাঁচ
এটা ঠিক এই ধরনের যে, কোন বাতিলকে খন্ডন করার জন্য সেই বাতিল মতবাদের জ্ঞান কোন শিক্ষকের কাছ থেকে অর্জন করা। শিক্ষক ছাত্রকে এই প্রত্যয়ের ভিত্তিতে বাতিল মতবাদের জ্ঞান শিক্ষা দেন যে, সে তার খন্ডন করবে। কিন্তু জ্ঞানার্জনের পর সে নিজেই যদি সেই বাতিল মতবাদের বিশ্বাসী হয়ে যায় অথবা তার (জ্ঞানের) যদি অপপ্রয়োগ করে, তাহলে এতে শিক্ষকের কোন দোষ থাকে না।
ছয়
এই যাদুও সেই অবধি কারো ক্ষতি করতে পারে না, যতক্ষণ না তাতে আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি থাকে। এই জন্যই যাদু শিক্ষার লাভই বা কি? আর এই কারণেই ইসলাম যাদুবিদ্যা শিক্ষা করাকে কুফরী গণ্য করেছে। সর্বপ্রকার কল্যাণ লাভ এবং অকল্যাণ থেকে মুক্তির জন্য কেবল আল্লাহর দিকেই রুজু করতে হয়। কেননা, তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা এবং সারা জাহানের প্রতিটি কাজ তাঁরই ইচ্ছায় সম্পাদিত হয়।
কাজেই হারুত মারুতকে নিয়ে বহুল প্রচারিত জোহরা নামক নারীকে নিয়ে যে মুখরোচক ঘটনা তা বিশ্বাস না করে আল্লাহর ফেরেশতাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ না রটিয়ে; সত্য ও সঠিক তথ্য জেনে আল্লাহর সৃষ্টির ব্যাপারে সঠিক ধারণা পোষণ করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য বোঝার তাওফিক দান করুন।
গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল