আবু লাহাবের স্ত্রীর গীবত, তোহমত,চোগলখুরী ও পরিণতি


আবু লাহাবের স্ত্রীর নাম ছিল আরওয়া বিনতে হারব ইবনে উমাইয়া। ট্যারাচক্ষু হওয়ার কারণে তাকে আরওয়া বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইবনুল ‘আরাবী তাকে ট্যারাচক্ষু সকল নষ্টের মূল বলেন (কুরতুবী)।সে ছিল আবু সুফিয়ানের বোন ও হরব ইবনে উমাইয়্যার কন্যা। তাকে উম্মে জামীল বলা হত। আবু লাহাবের ন্যায় তার স্ত্রীও রাসূলুল্লাহ(সা.) এর প্রতি বিদ্বেষী ছিল।কুরায়েশদের নেতৃস্থানীয় মহিলাদের অন্যতম এই মহিলা রাসূলুল্লাহ(সা.)-এর বিরুদ্ধে সকল প্রকার চক্রান্তে ও দুষ্কর্মে তার স্বামীর পূর্ণ সহযোগী ছিল (ইবনু কাছীর)। সর্বদা রাসূলুল্লাহ(সা.)-এর বিরুদ্ধে গীবত, তোহমত ও চোগলখুরীতে লিপ্ত থাকতো। কবি হওয়ার সুবাদে ব্যঙ্গ কবিতার মাধ্যমে তার নোংরা প্রচারণা অন্যদের চাইতে বেশী ছিল। চোগলখুরীর মাধ্যমে সংসারে ভাঙ্গন ধরানো ও সমাজে অশান্তির আগুন জ্বালানো দু’মুখো ব্যক্তিকে আরবরা‘ হাম্মালাতাল হাতাব বা ইন্ধন বহনকারী বা খড়িবাহক বলত। সে হিসাবে এই মহিলাকে কুরআনে উক্ত নামেই আখ্যায়িত করা হয়েছে।
নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ার সুযোগে উক্ত মহিলা রাসূল (সা.)-এর যাতায়াতের পথে এবং ঘরের দরজার সামনে কাঁটাগাছের ডাল পালা ছড়িয়ে রেখে দিতো। এটা ছিল তার প্রতিদিনের স্থায়ী আচরণ। যাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বা তাঁর শিশু সন্তানরা বাইরে বের হলে তাদের পায়ে কাঁটা বিঁধে যায়। (বায়হাকী ,. ইবন আবী হাতেম, ইবনে জারীর, ইবনে আসাকির ও ইবনে হিশাম)।আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, এই হতভাগিনীও তার স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এক বর্ণনায় এসেছে, এ মহিলা যখন শুনতে পেল যে, আল্লাহ তায়ালা তার ও তার স্বামীর ব্যাপারে আয়াত নাযিল করে অপমানিত করেছে, সে রাসূলুল্লাহ(সা.) এর কাছে আসল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন বসা ছিলেন।তার সাথে ছিলেন আবু বকর। তখন আবু বকর বললেন, আপনি যদি একটু সরে যেতেন তা হলে ভাল হতো যাতে করে এ মহিলা আপনাকে কোন কষ্ট না দিতে পারে। তখন রাসূলুল্লাহ(সা.) বললেন, আমার ও তার মাঝে বাধার সৃষ্টি করা হবে। ইত্যবসরে মহিলা এসে আবু বকরকে জিজ্ঞেস করল, আবু বকর! তোমার সাথী আমাদের বদনামী করে কবিতা বলেছে? তিনি জবাবে বললেন, এ ঘরের (কাবার) রবের শপথ, তিনি কোন কবিতা বলেননি এবং তার মুখ দিয়ে তা বেরও হয়নি। তখন মহিলা বলল, তুমি সত্য বলেছ। তারপর মহিলা চলে গেলে আবু বকর (রা) বললেন, সে কি আপনাকে দেখেনি? রাসূল (সা) বললেন, মহিলা ফিরে যাওয়া পর্যন্ত একজন ফেরেশতা আমাকে তার থেকে আড়াল করে রাখছিল। (মুসনাদে আবি ইয়া'লা: ২৫, ২৩৫৮, মুসনাদে বাযযার: ২৯৪,ইবন কাসীর)।
অপর এক বর্ণনায় আছে সূরা লাহাব নাযিল হলে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উক্ত মহিলা হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূলুল্লাহ(সা.) কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূলুল্লাহ (সা.) সামনে থাকা সত্ত্বেও সে তাঁকে দেখতে পায়নি। অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে দাঁড়ানো আবু বকরের কাছে তার মনের ঝাল মিটিয়ে বলেন, আবুবকর! তোমার সাথী নাকি আমাকে ব্যঙ্গ করেছে? আল্লাহর কসম, যদি আমি তাকে পেতাম, তাহলে এই পাথর দিয়ে তার মুখে মারতাম। আল্লাহর কসম! আমি একজন কবি। বলেই সে রাগতঃস্বরে কবিতা পাঠ করে-
‘নিন্দিতের আমরা নাফরমানী করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’। উল্লেখ্য যে, কুরায়েশ নেতারা রাসূলুল্লাহ(সা.)-কে ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত)-এর বদলে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) নামে আখ্যায়িত করেছিল এবং ঐ নামে তারা তাঁকে গালি দিত।
আল্লাহ বলেন, তুমি যখন কুরআন পাঠ কর তখন তোমার ও যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন পর্দা রেখে দিই” (সুরা ইসরা আয়াত- ৪৫)৷ আর তার স্ত্রীও, যে ইন্ধন বহন করে।(সুরা লাহাব আয়াত-৪)।এখানে আবু জাহলের স্ত্রী উম্মে জামীলের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে  হাম্মালাতাল হাতাব বলা হয়েছে। এর শাব্দিক অর্থ শুষ্ককাঠ বহনকারিণী। আরবের বাকপদ্ধতিতে পশ্চাতে নিন্দাকারীকে ‘খড়ি-বাহক’ বলা হত। শুষ্ককাঠ একত্রিত করে যেমন কেউ অগ্নি সংযোগের ব্যবস্থা করে, পরোক্ষে নিন্দাকার্যটিও তেমনি। এর মাধ্যমে সে ব্যক্তিবর্গ ও পরিবারের মধ্যে আগুন জ্বলিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)ও সাহাবায়ে কেরামকে কষ্ট দেয়ার জন্যে আবু লাহাব পত্নী পরোক্ষ নিন্দাকার্যের সাথেও জড়িত ছিল। অধিকাংশ তাফসীরবিদ এখানে এ তাফসীরই করেছেন। অপরপক্ষে কোন কোন তাফসীরবিদগণ একে আক্ষরিক অর্থেই রেখেছেন এবং কারণ এই বর্ণনা করেছেন যে, এই নারী বন থেকে কন্টকযুক্ত লাকড়ি চয়ন করে আনত এবং রাসূলুল্লাহ(সা.)কে কষ্ট দেয়ার জন্যে তার পথে বিছিয়ে রাখত।
তার এই নীচ ও হীন কাণ্ডকে কুরআন হাম্মালাতাল হাতাব বলে ব্যক্ত করেছে। ইমাম তাবারী এ উক্তিটি গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ বলেন যে, তার এই অবস্থাটি হবে জাহান্নামে। সে জাহান্নামে লাকড়ি এনে জাহান্নামে তার স্বামীর উপর নিক্ষেপ করবে, যাতে অগ্নি আরও প্ৰজ্বলিত হয়ে উঠে, যেমন দুনিয়াতেও সে স্বামীকে সাহায্য করে তার কুফার ও জুলুম বাড়িয়ে দিত। কোন কোন মুফাসসির বলেন, সে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে দরিদ্র বলে উপহাস করত। পরিণামে আল্লাহ এ মহিলাকে লাকড়ি আহরণকারী বলে অপমানজনক উপাধী দিয়ে উপহাস করেছেন। আবার সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেন, আয়াতের অর্থ “গোনাহের বোঝা বহনকারিনী”। (কুরতুবী, ইবন কাসীর)।জাহান্নামে সে স্বামীর আগুনে কাঠ এনে এনে নিক্ষেপ করতে থাকবে; যাতে আগুন বেশী বৃদ্ধি পাবে। আর তা হবে আল্লাহর তরফ হতে। অর্থাৎ, যেমন সে দুনিয়াতে নিজ স্বামীর কুফর ও ঔদ্ধত্যে মদদ যোগাত, তেমনি আখেরাতেও তার আযাব বৃদ্ধিতে মদদ যোগাতে থাকবে। (ইবনে কাসীর) কিছু সংখ্যক উলামা বলেন, এই মেয়েটি কাঁটার ঝাড় এনে রাসূলুল্লাহ(সা.))-এর চলার পথে রেখে দিত। (যাতে তিনি কাঁটাবিদ্ধ হয়ে কষ্ট পান।) আবার কোন কোন আলেম বলেন, ‘ইন্ধন বহনকারিণী’ বলে তার চুগলী করার অভ্যাসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। চুগলখোরের জন্য ব্যবহূত এটি আরবীর একটি পরিভাষা। এই মেয়েটি কুরাইশদের নিকট গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গীবত করত এবং তাদেরকে তাঁর প্রতি শত্রুতা করায় উসকানি দিত। (ফাতহুল বারী)।
মুররাহ আল-হামদানী বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল প্রতিদিন কাঁটাযুক্ত ঝোপের বোঝা এনে মুসলমানদের চলার পথে ছড়িয়ে দিত। ইবনু যায়েদ ও যাহহাক বলেন, সে রাতের বেলা একাজ করত। একদিন সে বোঝা বহনে অপারগ হয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়ে। তখন ফেরেশতা তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে এবং সেখানেই তাকে শেষ করে দেয়’ (কুরতুবী)।বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ঐ হতভাগা মহিলাটির মৃত্যু হয়েছে এভাবেই। উম্মে জমিল শক্ত রশি দিয়ে তার লাকড়ির আঁটি বাঁধত । একদিন সে বাঁধা একটি লাকড়ির আঁটি মাথায় নিয়ে একটি পাথরের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় একজন ফেরেশতা সেখানে উপস্থিত হয়ে তার লাকড়ির আঁটিটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ফলে তা গলায় ফাঁস লেগে যায় এবং সে অবস্থায়ই সে মারা যায়।
গ্রন্থনায় – মো আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল