ডাক্তারেরা কী ভুলতে বসেছেন হিপোক্রিটাস শপথ?
মো.আবু রায়হান:করোনা আতঙ্কে সারা পৃথিবীর মানুষের হতবিহবল অবস্থা। উন্নত, অনুন্নত সব দেশই করোনার ভয়াল থাবার শিকার। গত তিনমাসে অদৃশ্য এই করোনা লন্ডভন্ড করে দিয়েছে সাজানো পৃথিবীর অনেক কিছু। করোনা তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মানুষকে করেছে সবচেয়ে অসহায়। বৈশ্বিক এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে সবাই হিমশিম খাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক মহামারির বলয়ের বাইরে নয়। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসার সামর্থ্য ও ডাক্তারদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, দেশের বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা করোনাভাইরাসের কারণে নিজেরাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ঠাণ্ডা-সর্দি, জ্বর-কাশির কোনো রোগীকে তারা স্পর্শ করছেন না। সংক্রমিত নয়, কিন্তু জ্বর, সর্দি বা কাশির সমস্যায় ভুগছেন- এমন রোগীকেও চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন তারা।শুরুতে পিপিই সংকটকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল চিকিৎসকরা। বর্তমানে পর্যাপ্ত পিপিই পৌঁছালেও পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি। অন্যান্য রোগীদের সঙ্গে করোনা রোগীও আসতে পারে, এই ভয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা রোগী দেখাই বন্ধ করে দিয়েছেন। কয়েক দিনে এমনই ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়।তাদের অবস্থা হয়েছে এমন যেন চুন খেয়ে মুখ পোড়ে, দই দেখলে ভয় পায়। রোগীদের দুর্ভোগ পোহানোর কয়েকটি ঘটনা উপস্থাপন করছি।
এক
করোনা ভাইরাস আতঙ্কে রাজশাহীতে চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই রাজশাহী মহানগরীর ১১৮টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রায় চিকিৎসক শূন্য। শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ওয়ার্ডে রাউন্ডেও যাচ্ছেন না। ফলে রাজশাহী মহানগরী জুড়ে চিকিৎসাহীনতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বর, পেটব্যথা, হৃদরোগ ও দাঁতের সমস্যাসহ বিভিন্ন সাধারণ রোগে আক্রান্তরা ন্যূনতম চিকিৎসাসেবাও পাচ্ছেন না।
দুই
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় স্কুলছাত্রী সানজিদা ইসলাম সুমাইয়া (১৬) সপ্তাহখানেক আগে সর্দি, কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়। ২৬ মার্চ শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় তার পরিবার। সেখানকার এক চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ওই দিন সন্ধ্যায় সানজিদার অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়।সেখানকার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাৎক্ষণিক এক্স-রে করিয়ে প্রতিবেদন দেখার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। পরে রাত ১টার দিকে ওই স্কুলছাত্রীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে মেয়েটিকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।সেখান থেকে চট্টগ্রাম সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে যেতে বলা হয়। রাতে ওই হাসপাতালের সেবা বন্ধ থাকে। পরে মেয়েটিকে চট্টগ্রাম সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেফারেন্স ছাড়া করোনাভাইরাসের টেস্ট করাতে অস্বীকৃতি জানান।
তিন
স্কুলছাত্র রিফাত খালিশপুর হাউজিং বিহারি ক্যাম্প নং-১-এর বাসিন্দা জুট মিল শ্রমিক মো. কাশেমের ছেলে। সে ওব্যাট প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ।এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ছুটে গিয়েও ছোট্ট শিশু রিফাতকে ভর্তি করাতে পারেনি। যেখানেই যায় শুধু অন্যত্র পাঠানোর পরামর্শ দেয়া হয়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এক প্রকার বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট রিফাত।লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে খুলনা নগরীর চারটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ধরনা দেন স্কুলছাত্র রিফাতের পরিবার।
চার
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে আল আমিন নামের এক যুবক (২২) মারা গেছেন। জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়। আল আমিনের বাড়ি নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলার অলঙ্কারদিঘি গ্রামে। অসুস্থ হয়ে সে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামে ফেরে। কিন্তু সেখানকার লোকেরা তাকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি।এ কারণে সে নওগাঁ জেলা সদর হাসপাতাল, আদমদিঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, রানীনগর উপজেলা হাসপাতালসহ পাঁচটা হাসপাতাল ঘুরে কোনো চিকিৎসা না পেয়ে বিকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়।
পাঁচ
চাটখিল কলেজের সাবেক জিএস জাহাঙ্গীর আলমের শ্বাসকষ্টে মৃত্যুর করুণ কাহিনী বর্ণনা করেছেন তারই এক আত্মীয়। চাটখিলে তিনি অসুস্থ হলে তাকে ঢাকায় আনা হয়। প্রথমেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তাকে রাখা হয়নি। সেখান থেকে কিছু বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হলেও ভর্তি করেনি। পরে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে ভর্তি করা হয়, কিন্তু দু’দিনের মাথায় তাকে টেস্ট করে জানানো হয় যে, তিনি করোনায় আক্রান্ত হননি। অন্য কোথায় নিয়ে যেতে বলা হয়। পরে মিরপুরের হার্ট ফাউন্ডেশনে করোনা নেই সার্টিফিকেট দেখিয়ে ভর্তি হলেও সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দিয়েই ছেড়ে দেয়া হয়। তাকে বাসায় নিয়ে আসা হলে আবার শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তখন আবারো হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এভাবেই জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যু হয় বিনা চিকিৎসায়।
ছয়
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক রোগী মারা গেছেন। হাসপাতালের পরিচালক উত্তম বড়ুয়া সাংবাদিকদের এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। মৃত ব্যক্তিটি পুরুষ। বয়স পঞ্চাশের মতো। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হলে রাতের দিকে তিনি মারা যান। উত্তম বড়ুয়া বলেন, ওই রোগী প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখান থেকে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। কুর্মিটোলা ওই রোগীকে সোহরাওয়ার্দীতে পাঠিয়ে দেয়। ওই রোগীর শরীর থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বর্তমানে কোনো কোনো ডাক্তার হিপোক্রিটাস শপথ ভুলে যেতে বসেছেন। হিপোক্রিটাসকে বলা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি গুরু।আজ থেকে প্রায় পৌনে তিন হাজার বছর আগে গ্রিসে তাঁর জন্ম। একবার শিষ্যদের গাছতলায় জড়ো করে তিনি একটি শপথবাক্য পাঠ করান। শপথবাক্যটি ছিল, ‘অতঃপর আমি শপথ গ্রহণ করছি যে জেনেশুনে এবং ধর্মত রোগীর ক্ষতি হয় এমন কোনো ওষুধ দেব না। শত্রু-মিত্রভেদে সব রোগীকে সমান মনপ্রাণ দিয়ে চিকিৎসা করব এবং তার মানসিক দুশ্চিন্তা লঘু করার জন্য সব সময় ভরসা দেব।'যে শপথ এখনো ডাক্তারদের নতুন সংস্করণে পড়ানো হয়।বর্তমানে কতজন চিকিৎসক এই শপথে অবিচল ও বিশ্বস্ত?মোট কথা চিকিৎসকদের হতে হবে অতিমানব। সেই সুযোগ করে দিতে হবে সরকারকে যাতে তারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে জনসেবায় ব্রত হতে পারেন। শেষে বলতে হয়, ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, ....এই দুর্দিনে কে দেবে আশা, কে দেবে ভরসা,’ ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন, উপায় নেই।' সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দেব কোথায়?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন