ইসলামের ঘোর বিরোধী আবু লাহাবের পরিণতি


আবু লাহাব ছিল কুরায়েশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের দশজন পুত্রের অন্যতম। আবু লাহাব মক্কায় ৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে  লুবনা বিনতে হাজর এর ঘরে জন্মগ্রহণ করে।আসল নাম ছিল আব্দুল  ওযযাই ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম। ওযযা অর্থ দেবীর গোলাম। গৌরবর্ণের কারণে তার ডাক নাম হয়ে যায় আবু লাহাব। কারণ, লাহাব বলা হয় আগুণের লেলিহান শিখাকে।তার আসল নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। কেননা তা ছিল তাওহীদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আল্লাহ তার আবু লাহাব উপনামটি কুরআনে উল্লেখ করেছেন। কেননা এর মধ্যে তার চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবার দুঃসংবাদটাও লুকিয়ে রয়েছে। কারণ, জাহান্নামের অগ্নির লেলিহান শিখা তাকে পাকড়াও করবে। সে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কট্টর শত্রু ও ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল।সে আপন ভাতিজা মুহাম্মাদ (সা.)কে সরাসরি অত্যাচার করতে থাকে। দিনের পর দিন নানাভাবে মহানবী (সা.)কে আবু লাহাব ও তার স্ত্রী জ্বালা-যন্ত্রণা দিয়ে অতিষ্ঠ করে যাচ্ছিল। তাদের ঐ জুলুম সীমাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পরিশেষে সূরা লাহাব নাযিল করে আল্লাহ তায়ালা তাদের পুরস্কার ঘোষণা করেন।মুহাম্মদ(সা) জন্মের পর থেকেই চাচা আবু লাহাবের প্রিয়পাত্র ছিলেন।কিন্তু নবুয়াত প্রকাশ করার পর থেকেই সে নবীজীর বিরূদ্ধে চলে যা্য। আবু লাহাব ছিল রাসূল (সা)-এর সেই প্রিয় চাচা যিনি তাঁর জন্মের খবর শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সর্বত্র দৌড়ে গিয়ে লোকদের নিকট খবরটি পৌঁছে দেন যে, তার মৃত ছোট ভাই আব্দুল্লাহর বংশ রক্ষা হয়েছে। আর এই সুখবরটি প্রথম তাকে শুনানোর জন্য (১) সে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দাসী ছুওয়াইবাকে মুক্ত করে দেন।(২) সে ছিল মক্কায় রাসূল (সা)-এর নিকটতম প্রতিবেশী। (৩) তার দুই ছেলে উৎবা ও উতাইবার সাথে নবুঅত পূর্বকালে রাসূল (সা)-এর দুই মেয়ে রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়।এত আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সবকিছু তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্কে পরিবর্তিত হয়ে যায় রাসূল (সা)-এর নবুয়ত লাভের পর। আবু লাহাব কখনোই তার ভাতিজার সুনাম-সুখ্যাতি ও নবুঅত লাভের মত উচ্চ মর্যাদা অর্জনের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। যেমন মেনে নিতে পারেনি অন্যতম বংশীয় চাচা আবু জাহল ও তার সাথীরা। ফলে শুরু হয় শত্রুতা। তার পক্ষে সম্ভব কোনরূপ শত্রুতাই সে বাকী রাখেনি।
তোমার নিকটতম স্বজনবর্গকে তুমি সতর্ক করে দাও। (সুরা আশ শুআরা আয়াত-২১৪)  এ আয়াত নাযিলের পর নবী মুহাম্মদ(সাঃ) সাফা পাহাড়ের উপর থেকে যখন সমবেত লোকজনকে এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছিলেন তখন সেখানে আবু লাহাব তাকে সবার আগে তিরস্কার ও ভৎসনা করেছিলেন|।মহানবী (সা) সাফা নামক পাহাড়ের ওপর উঠে উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে বলেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। মহানবীর ডাক শুনে মক্কার জনগণ তার কাছে আসে। তাদের উদ্দেশে মহানবী বললেন,আমি যদি এ খবর দেই যে আজ বিকালে অথবা কাল ভোরে অশ্বারোহী সেনারা এই পাহাড়ের পাশ দিয়ে এসে তোমাদের ওপর হামলার উদ্যোগ নিচ্ছে,-তোমরা কি আমার এ কথা বিশ্বাস করবে? মক্কার জনগণ বলল: আমরা তোমাকে কখনও মিথ্যা কথা বলতে শুনিনি। তখন মহানবী (সা) বললেন: আমি তোমাদের কঠোর খোদায়ি শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করছি। তখন আবু লাহব বলল: আমি যদি তোমার ধর্ম মেনে নেই তাহলে অন্য মুসলমানদের তুলনায় আমাকে বিশেষ কি কি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে? রাসুলে খোদা (সা) বললেন: আমাদের ধর্ম তথা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে অন্য সব মুসলমানের মতই একজন মুসলমান হবেন আপনি, কোনো বিশেষ সুবিধা পাবেন না, কারণ এ ধর্ম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। এ ধর্মে সবাই ওজনের পাল্লার মাপের মতই সমান।
এ কথা শুনে আবু লাহাব ক্রুদ্ধ হয়ে অনেক অশোভনীয় কথা বলে। আবু লাহাব বলেছিল, تبًا لَكَ أَمَا دَعَوْتَنَا إِلاَّ لِهَذَا! ‘তুমি ধ্বংস হও, তুমি কি আমাদেরকে এ জন্যই ডেকেছিলে?’ এর উত্তরে সূরা লাহাব’ অবতীর্ণ  হয়েছিল। এ সুরায় বলা হল, বরং আবু লাহাবের দুটি হাত ও সে নিজে ধ্বংস হোক্।আবু লাহাব তার দু’ছেলেকে তাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে বাধ্য করেন। এই দু’মেয়েই পরবর্তীতে একের পর এক হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। রাসূল (সা)-এর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহ, যার লকব ছিল ত্বাইয়েব ও ত্বাহের, মারা গেলে আবু লাহাব খুশীতে বাগবাগ হয়ে সবার কাছে গিয়ে বলেন মুহাম্মাদ এখন ‘আবতার’ অর্থাৎ লেজকাটা ও নির্বংশ হয়ে গেল। সেযুগে কারু পুত্রসন্তান না থাকলে এরূপই বলা হ’ত। একথারই প্রতিবাদে সূরা কাওছার নাযিল হয় এবং আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ ‘নিশ্চয়ই তোমার শত্রুই নির্বংশ’। হজ্জের নিরাপদ মওসুমে রাসূল (সা) বহিরাগত হাজীদের তাঁবুতে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত দিতেন। তখন আবু লাহাব তাঁর পিছু নিতেন এবং লোকদের ভাগিয়ে দিতেন এই বলে যে,يَا أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تُطِيْعُوْهُ فَإِنَّهُ صَابِئٌ كَذَّابٌ ‘হে লোকসকল! তোমরা এর আনুগত্য করো না। কেননা সে ধর্মত্যাগী, মহা মিথ্যুক’। সে নানাভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কষ্ট দেয়ার প্রয়াস পেত। তিনি যখন মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দিতেন, তখন সে সাথে সাথে গিয়ে তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করত। রবী’আ ইবনে আব্বাদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জাহিলিয়াতের (অন্ধকার) যুগে যুল-মাজায বাজারে দেখলাম, তিনি বলছিলেন, “হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল, সফলকাম হবে”। আর মানুষ তার চতুষ্পার্শে ভীড় জমাচ্ছিল। তার পিছনে এক গৌরবর্ণ টেরা চোখবিশিষ্ট সুন্দর চেহারার লোক বলছিল, এ লোকটি ধর্মত্যাগী, মিথ্যাবাদী। এ লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিছনে পিছনে যেখানে তিনি যেতেন সেখানেই যেত। তারপর আমি লোকদেরকে এ লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। লোকেরা বলল, এটি তারই চাচা আবু লাহাব।” (মুসনাদে আহমাদ: ৪/৩৪১)। আবু লাহাব পিছন থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারছিল। যাতে রাসূল (সা)-এর পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যায়।নবী করিম (সা.) সালাত আদায়কালে সে উপর থেকে ছাগলের নাড়িভুঁড়ি তার উপর ফেলে দিত।আবু লাহাব একবার নবী করিম (সা.)কে প্রশ্ন করল, ‘ইসলাম গ্রহণ করলে আমি কি পাব?’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘অন্যসব লোকেরা যা পাইবে, আপনি তাই পাবেন।’ সে বলল, ‘আমার জন্য বাড়তি মর্যাদা কিছুই হবে না?’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘আপনি আর কি চান?’ তখন সে বলল, ‘এই দ্বীনের সর্বনাশ হউক, যাতে আমি অন্যসব লোকের সমান হয়ে যাবো। (ইবনে জরীর)
আবু লাহাবের পরিণতি -
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ছিল বদরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কুরাইশ কাফির বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়। অথচ চালাকি করে আবু লাহাব বদরের যুদ্ধে যোগদান করেনি। আবু লাহাব যুদ্ধে তার গোলাম আসী ইবনে হিশামকে প্রেরণ করেন। ওই ব্যক্তিকে আবু লাহাব ঋণের দায়ে দাসে পরিণতি করে।যুদ্ধে তার সেই গোলামসহ কুরাইশের বড় বড় নেতা সবাই নিহত হয়। ফলে আবু লাহাব তখন সাংঘাতিকভাবে আঘাত পায়।বদর যুদ্ধে পরাজয়ের দুঃসংবাদ মক্কায় পৌঁছবার সপ্তাহকাল পরে আবু লাহাবের গলায় গুটিবসন্ত দেখা দেয়। এর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য পরিবারের লোকেরা সবাই তাকে ত্যাগ করে। তার শরীরে পচন ধরে। দেহ হয়ে যায় দুর্গন্ধময় এবং এতে সে মারা পড়ে ।কুরায়েশরা এই ব্যাধিকে মহামারী হিসাবে দারুণ ভয় পেত।একজন হাবশী মজদুরকে ডেকে মক্কা নগরীর বাইরে একটি গর্ত খনন করে লাঠি দিয়ে ঠেলে লাশটিকে উক্ত গর্তে ফেলে দেয়া হয় এবং উপরে পাথর চাপা দেয়।অহংকারী যালেমের পতন এভাবেই হয়। কুরআনের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়। তার মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তার কোন কাজে আসেনি। এভাবে হলো আবু লাহাবের পতন ও পরাজয়। দ্বীনের বিরোধিতা করতে গিয়ে সে এভাবে আল্লাহর অভিশপ্ত হয়। চরম লাঞ্ছনা নিয়ে সে মরলো। তার ছেলেমেয়েরা অবশ্য পরবর্তীতে ইসলামের সুশীশতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা করে।সর্বপ্রথম তার মেয়ে দাররা হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনায় চলে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। আর মক্কা বিজয়ের পর তার দুই ছেলে উতবা ও মু'আত্তাব রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনে হাযির হয়ে ইসলাম গ্ৰহণ করেন এবং তার হাতে বাই’আত করেন। (রুহুল মা'আনী)।

গ্রন্থনায়- মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল