দাজ্জালের ফেতনা এবং তা থেকে বেঁচে থাকার দোয়া
দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের সময় ঘনিয়ে আসার একটি আলামত হলো, দাজ্জালের ফিতনা এতো ভয়ানক এবং গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মানুষেরা তার আলোচনা পরিহার করবে এবং এই ফিতনার ব্যাপারে বেখবর হয়ে যাবে। বর্ণিত হয়েছে,“দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে না, যতক্ষণ না মানুষ তার আলোচনা বিস্মৃত হয়ে যাবে এবং ইমামগণ মিম্বারে তার আলোচনা পরিহার করবে।মহানবী (সা.) বলেন, ১০টি নিদর্শন যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা দেখতে পাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত হবে না। তা হলো—১. ধোঁয়া, ২. দাজ্জাল, ২. দাব্বাহ (জমিন থেকে একটি জন্তুর বের হওয়া), ৪. পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, (কিয়ামতের ১০০ বছর আগে মাত্র এক দিনের জন্য পশ্চিম দিক দিয়ে সূর্য উদিত হবে), ৫. হজরত ঈসা (আ.)-এর আগমন, ৬. ইয়াজুজ-মাজুজের আগমন, ৭. পূর্ব দিকের তিনটি ভূমিকম্প, ৮. পশ্চিম দিকে ভূমিকম্প, ৯. আরব উপদ্বীপের ভূমিকম্প, ১০. ইয়েমেন থেকে উত্থিত আগুন, যা মানুষকে তাড়িয়ে সমাবেশের স্থানে নিয়ে যাবে। (সহিহ বুখারি)।কেয়ামতের বড় আলামতসমূহের মধ্যে দাজ্জালের আবির্ভাব । কেয়ামতের আগে মানুষকে গোমরাহ করার জন্য পূর্ব দিক থেকে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। মক্কা-মদিনা ছাড়া সে সর্বত্র বিচরণ করবে। দাজ্জালের মাধ্যমে মানুষ দলে দলে গোমরা হয়ে যাবে। তবে খালেস ইমানদাররা তাকে চিনতে পারবে।
ছবি-প্রতীকী |
দাজ্জালের পরিচয়- দাজ্জাল শব্দটি কুরআনে ব্যবহ্রত হয়নি তবে হাদিসে উল্লেখ আছে।দাজাল ক্রিয়া পদের অর্থ প্রতারণা করা।দাজ্জাল অর্থ মহা প্রতারক। দাজ্জাল শব্দটি এসেছে ‘আদ্দাজলু’ ক্রিয়ামূল থেকে। এর শাব্দিক অর্থ হলো—ক.ঢেকে দেয়া, যেহেতু সে মিথ্যার দ্বারা সত্যকে ঢেকে দেবে।খ. ধোঁকা দেয়া ও বিভ্রান্ত করা, যেহেতু সে মানবজাতিকে ধোঁকা দেবে এবং বিভ্রান্ত করবে।গ. ফন্দি করা, যেহেতু সে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ্র বিরুদ্ধে রকমারি ফন্দি করে। দাজ্জাল শব্দটির বহুবচন হলো ‘দাজ্জালুনা’ এবং ‘দাজাজিলা’। এর বহুবচনের প্রয়োজন এজন্য যে, দাজ্জাল সে একাই নয়; বরং দাজ্জাল রয়েছে আরো অনেক। তবে সে হলো, সবচে বড় এবং সর্বশেষ দাজ্জাল। রাসুলুল্লাহ (সা). বলেন-“কেয়ামতে সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না ত্রিশজন চরম মিথ্যুক দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে, যাদের প্রত্যেকেই আল্লাহ এবং তার রাসুলের ওপর মিথ্যাচার করবে।(সুনানে আবি দাউদ- ৪৩৩৪; আল মুসনাদ, ইমাম আহমাদ-৯৮১৮)।নবী (সা.) দাজ্জালকে স্বপ্নে দেখে তার শারীরিক গঠনের বর্ণনা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, দাজ্জাল হবে স্থুলকায় লাল বর্ণের, কোঁকড়ানো চুল, ডান চোখ কানা, চোখটি যেন ফোলা আঙ্গুরের মত।(সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা - ৭১২৮)। আবু বাকর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন—“দাজ্জালের বাবা-মা’র ত্রিশ বছর পর্যন্ত কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে না। এরপর একটি কানা ছেলে জন্মগ্রহণ করবে। সে হবে খুবই ক্ষতিকর এবং অত্যন্ত অনুপকারী। তার দু’চোখ ঘুমাবে; কিন্তু অন্তর ঘুমাবে না।”এরপর রাসুলুল্লাহ সা. আমাদের সামনে তার বাবা-মা’র বিবরণ উল্লেখ করলেন।তিনি বলেন, “দাজ্জালের বাবা দৈহিক আকৃতির দিক থেকে হবে লম্বাটে, হালকা-পাতলা গড়নের এবং তার নাক হবে পাখির ঠোঁটের মতো লম্বা। আর তা মা হবে স্থূলকায়, সুউচ্চ স্তনবিশিষ্টা।”(জামিউত তিরমিযি- ২২৪৮)।দাজ্জাল নির্বংশ হবে। তার কোন সন্তান থাকবে না। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান) ।দাজ্জালকে চেনার সবচেয়ে বড় আলামত হল তার কপালে কাফির লেখা থাকবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১৩১) অপর এক বর্ণনায় আছে তার কপালে ك ف ر এই তিনটি বর্ণ লেখা থাকবে। প্রতিটি মুমিন ব্যক্তিরা তা পড়তে পারবে। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)। আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, “নবী (সা.) লোক সমাবেশে দাঁড়ালেন এবং মহান আল্লাহ্র প্রশংসা করলেন। এরপর তিনি দাজ্জাল প্রসঙ্গে বললেন, “তার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি। এমন কোন নবী নেই যিনি তাঁর কওমকে এ বিষয়ে সতর্ক করেননি। তবে তার সম্পর্কে আমি তোমাদের এমন একটি কথা বলব যা কোন নবীই তাঁরা জাতিকে বলেননি। তা হল যে, সে কানা হবে আর আল্লাহ্ অবশ্যই কানা নন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস - ৭১২৭) ।''সাহাবী উবাদা বিন সামেত (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,দাজ্জাল হচ্ছে খাটোকায়-বেটে, দু'পায়ের নলা ঈষৎ ফাঁকা, কোঁকড়া চুল বিশিষ্ট, এক চক্ষুহীন-কানা, চক্ষু লেপ্টানো, একেবারে উপরে উঠানো-ভাসা ভাসাও নয় আবার একেবারে গর্তের ভিতর ঢুকানোও নয়। তার বিষয়টি যদি তোমাদের নিকট অস্পষ্ট মনে হয় এবং তোমরা ধাঁধাঁয় পড়ে যাও তাহলে জেনে নাও তোমাদের পালনকর্তা কানা নন।( আবু দাউদ-৪৩২০)। রাসুল (সা) বলেন, “দাজ্জালের সাথে যা থাকবে তা আমি অবগত আছি। তার সাথে দু’টি নদী প্রবাহিত থাকবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটিতে সুন্দর পরিষ্কার পানি দেখা যাবে। অন্যটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যাবে। যার সাথে দাজ্জালের সাক্ষাৎ হবে সে যেন দাজ্জালের আগুনে ঝাপ দিয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে পান করে। কারণ উহা সুমিষ্ট পানি। তার চোখের উপরে মোটা আবরণ থাকবে। কপালে কাফের লেখা থাকবে। মূর্খ ও শিক্ষিত সকল ঈমানদার লোকই তা পড়তে সক্ষম হবে”। (সহীহ মুসলিম ,কিতাবুল ফিতান)।
দাজ্জালের আবির্ভাবের স্থান- দাজ্জালের প্রাথমিক প্রকাশ ও প্রসিদ্ধি (আল্লাহই ভাল জানেন) শাম ও ইরাকের মধ্যবর্তী কোন স্থান থেকে হবে। নাওয়াছ বিন ছামআন (রা) বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন- “সে (দাজ্জাল) শাম এবং ইরাকের মধ্যবর্তী একটি সড়ক থেকে আত্মপ্রকাশ করবে।-”(মুসলিম)।অপর বর্ণনায় আছে দাজ্জাল খোরাসান হতে বাহির হবে।(ইবনে মাজাহ)।দাজ্জাল সমন্ধে একটি বড় হাদিস বর্ণিত আছে-হযরত ফাতেমা বিনতে কায়েস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মসজিদে গমন করে নবী (সা.) এর সাথে নামায আদায় করলাম। আমি মহিলাদের কাতারে ছিলাম। তিনি নামায শেষে হাসতে হাসতে মিম্বারে উঠে বসলেন। প্রথমেই তিনি বললেন, ‘প্রত্যেকেই যেন আপন আপন জায়গায় বসে থাকে’। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তোমরা কি জান আমি কেন তোমাদেরকে একত্রিত করেছি?’ তাঁরা বললেন, ‘আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন’। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে এ সংবাদ দেয়ার জন্য একত্রিত করেছি যে তামীমদারী ছিল একজন খ্রীস্টান লোক। সে আমার কাছে আগমন করে ইসলাম গ্রহণ করেছে। অতঃপর সে মিথ্যুক দাজ্জাল সম্পর্কে এমন ঘটনা বলেছে যা আমি তোমাদের কাছে বর্ণনা করতাম। লাখ্ম ও জুযাম গোত্রের ত্রিশ জন লোকের সাথে সে সাগর পথে ভ্রমণে গিয়েছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার শিকার হয়ে এক মাস পর্যন্ত তারা সাগরেই ছিল। অবশেষে তারা সাগরের মাঝখানে একটি দ্বীপে অবতরণ করলো। দ্বীপের ভিতরে প্রবেশ করে তারা মোটা মোটা এবং প্রচুর চুল বিশিষ্ট একটি অদ্ভুত প্রাণীর সন্ধান পেল। চুল দ্বারা সমস্ত শরীর আবৃত থাকার কারণে প্রাণীটির অগ্রপশ্চাৎ নির্ধারণ করতে সক্ষম হল না। তারা বলল, ‘অকল্যাণ হোক তোমার! কে তুমি?’ সে বলল, ‘আমি সংবাদ সংগ্রহকারী গোয়েন্দা’। তারা বলল, ‘কিসের সংবাদ সংগ্রহকারী?’ অতঃপর প্রাণীটি দ্বীপের মধ্যে একটি ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘হে লোক সকল! তোমরা এই ঘরের ভিতরে অবস্থানরত লোকটির কাছে যাও। সে তোমাদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে’। তামিমদারী বলেন, ‘প্রাণীটি যখন একজন লোকের কথা বলল, তখন আমাদের ভয় হল যে হতে পারে সে একটি শয়তান। তথাপিও আমরা ভীত হয়ে দ্রুত অগ্রসর হয়ে ঘরটির ভিতরে প্রবেশ করলাম। সেখানে প্রবেশ করে আমরা বৃহদাকার একটি মানুষ দেখতে পেলাম। এত বড় আকৃতির মানুষ আমরা ইতিপূর্বে আর কখনও দেখিনি। তার হাত দু’টিকে ঘাড়ের সাথে একত্রিত করে হাঁটু এবং গোড়ালীর মধ্যবর্তী স্থানে লোহার শিকল দ্বারা বেঁধে রাখা হয়েছে’। আমরা বললাম, ‘মরণ হোক তোমার! কে তুমি?’ সে বলল, ‘তোমরা আমার কাছে আসতে সক্ষম হয়েছ। তাই আগে তোমাদের পরিচয় দাও’। আমরা বললাম, ‘আমরা একদল আরব মানুষ নৌকায় আরোহণ করলাম। সাগরের প্রচণ্ড ঢেউ আমাদেরকে নিয়ে একমাস পর্যন্ত খেলা করল। অবশেষে তোমার দ্বীপে উঠতে বাধ্য হলাম। দ্বীপে প্রবেশ করেই প্রচুর পশম বিশিষ্ট এমন একটি জন্তুর সাক্ষাৎ পেলাম, প্রচুর পশমের কারণে যার অগ্রপশ্চাৎ চেনা যাচ্ছিলনা’। আমরা বললাম, ‘অকল্যাণ হোক তোমার! কে তুমি?’ সে বলল, ‘আমি সংবাদ সংগ্রহকারী গোয়েন্দা’। আমরা বললাম, ‘কিসের সংবাদ সংগ্রহকারী?’ অতঃপর প্রাণীটি দ্বীপের মধ্যে এই ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘হে লোক সকল! তোমরা এই ঘরের ভিতরে অবস্থানরত লোকটির কাছে যাও। সে তোমাদের নিকট থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে’। তাই আমরা তার ভয়ে তোমার কাছে দ্রুত আগমন করলাম। হতে পার তুমি একজন শয়তান – এ ভয় থেকেও আমরা নিরাপদ নই’। সে বলল, ‘আমাকে তোমরা ‘বাইসান’ সম্পর্কে সংবাদ দাও’। আমরা তাকে বললাম, ‘বাইসানের কী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ?’ সে বলল, ‘আমি তথাকার খেজুরের বাগান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি। সেখানের গাছগুলো এখনও ফল দেয়?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ’। সে বলল, ‘সে দিন বেশি দূরে নয় যে দিন গাছগুলোতে কোন ফল ধরবেনা’। অতঃপর সে বলল, ‘আমাকে বুহাইরাতুত্ তাবারীয়া সম্পর্কে সংবাদ দাও’। আমরা বললাম, ‘বুহাইরাতুত্ তাবারীয়ার কী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ?’ সে বলল, ‘আমি জানতে চাই, সেখানে কি এখনও পানি আছে?’ আমরা বললাম, ‘তথায় প্রচুর পানি আছে’। সে বলল, ‘অচিরেই তথাকার পানি শেষ হয়ে যাবে’। সে পুনরায় বলল, ‘আমাকে যুগার নামক ঝর্ণা সম্পর্কে সংবাদ দাও’। আমরা তাকে বললাম, ‘সেখানকার কী সম্পর্কে তুমি জানতে চাও?’ সে বলল, ‘আমি জানতে চাই, সেখানে কি এখনও পানি আছে? লোকেরা কি এখনও সে পানি দিয়ে চাষাবাদ করছে?’ আমরা বললাম, ‘তথায় প্রচুর পানি রয়েছে। লোকেরা সে পানি দিয়ে চাষাবাদ করছে’। সে আবার বলল, ‘আমাকে উম্মীদের নবী সম্পর্কে জানাও’। আমরা বললাম, ‘সে মক্কায় আগমন করে বর্তমানে মদীনায় হিজরত করেছে’। সে বলল, ‘আরবরা কি তার সাথে যুদ্ধ করেছে?’ বললাম, ‘হ্যাঁ’। সে বলল, ‘ফলাফল কি হয়েছে?’ আমরা তাকে সংবাদ দিলাম যে, পার্শ্ববর্তী আরবদের উপর তিনি জয়লাভ করেছেন। ফলে তারা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে’। সে বলল, ‘তাই নাকি?’ আমরা বললাম, ‘তাই’। সে বলল, ‘তার আনুগত্য করাই তাদের জন্য ভাল। এখন আমার কথা শুন। আমি হলাম দাজ্জাল। অচিরেই আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। আমি বের হয়ে চল্লিশ দিনের ভিতরে পৃথিবীর সমস্ত দেশ ভ্রমণ করব। তবে মক্কা-মদীনায় প্রবেশ করা আমার জন্য নিষিদ্ধ থাকবে। যখনই আমি মক্কা বা মদীনায় প্রবেশ করতে চাইব, তখনই ফেরেশতাগণ কোষমুক্ত তলোয়ার হাতে নিয়ে আমাকে তাড়া করবে। মক্কা-মদীনার প্রতিটি প্রবেশ পথে ফেরেশতাগণ পাহাড়া দিবে’। হাদীসের বর্ণনাকারী ফাতেমা বিনতে কায়েস বলেন, ‘নবী (সা.) হাতের লাঠি দিয়ে মিম্বারে আঘাত করতে করতে বললেন, ‘এটাই মদীনা, এটাই মদীনা, এটাই মদীনা’। অর্থাৎ এখানে দাজ্জাল আসতে পারবে না। অতঃপর নবী (সা.) মানুষকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তামীমদারীর হাদীসটি আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছে। তার বর্ণনা আমার বর্ণনার অনুরূপ হয়েছে। বিশেষ করে মক্কা ও মদীনা সম্পর্কে। শুনে রাখ! সে আছে সাম দেশের সাগরে (ভূমধ্য সাগরে) অথবা আরব সাগরে। তা নয় সে আছে পূর্ব দিকে। সে আছে পূর্ব দিকে। সে আছে পূর্ব দিকে’। এই বলে তিনি পূর্ব দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন’। ফাতেমা বিনতে কায়েস বলেন, ‘আমি এই হাদীসটি নবী (সা.) এর নিকট থেকে মুখস্থ করে রেখেছি’। (সহীহ মুসলিম ,কিতাবুল ফিতান)।
ছবি-প্রতীকী |
দাজ্জালের অনুসারী- দাজ্জালের অধিকাংশ অনুসারীদের মধ্যে থাকবে ইহুদী, ইস্পাহানের অনেক লোক। হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করছেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দাজ্জালেন অনুসরণ করবে ইস্পাহানের কতিপয় ইহুদী, এদের সত্তর হাজার হবে এমন, যাদের গায়ে এক রকমের বিশেষ চাদর থাকবে।( মুসলিম হাদীস- ২৯৪৪)। আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন- নিশ্চয় দাজ্জাল প্রাচ্যের খোরসান এলাকা থেকে আত্মপ্রকাশ করবে।স্থূল বর্ম সদৃশ চেহারা-ধারী কিছু প্রজাতি তার অনুসারী হবে।-(তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)।জড় পদার্থ দাজ্জালের ডাকে সাড়া দেবে।নবী (স) বলেন “দাজ্জাল এক জনসমাজে গিয়ে মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনয়নের আহবান জানাবে। এতে তারা ঈমান আনবে। দাজ্জাল তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করার জন্য আকাশকে আদেশ দিবে। আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে, যমিন ফসল উৎপন্ন করবে এবং তাদের পশুপাল ও চতুষ্পদ জন্তুগুলো অধিক মোটা-তাজা হবে এবং পূর্বের তুলনায় বেশি দুধ প্রদান করবে। অতঃপর অন্য একটি জনসমাজে গিয়ে মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনয়নের আহবান জানাবে। লোকেরা তার কথা প্রত্যাখান করবে। দাজ্জাল তাদের নিকট থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসবে। এতে তারা চরম অভাবে পড়বে। তাদের ক্ষেত-খামারে চরম ফসলহানি দেখা দিবে। দাজ্জাল পরিত্যক্ত ভূমিকে তার নিচে লুকায়িত গুপ্তধন বের করতে বলবে। গুপ্তধনগুলো বের হয়ে মৌমাছির দলের ন্যায় তার পিছে পিছে চলতে থাকবে”। (সহীহ মুসলিম,কিতাবুল ফিতান)।
দাজ্জালের ক্ষমতা- এক স্থান হতে অন্য স্থানে দ্রুত পরিভ্রমণ করতে পারবে।হযরত নাওয়াস বিন সামআন থেকে বর্ণিত। নবী (স) কে দাজ্জালের চলার গতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “মেঘের গতি যাকে প্রবল বাতাস পেছন থেকে হাঁকিয়ে নিয়ে যায়, দাজ্জালের চলার গতিও সে রকম হবে”। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ফিতান)।
যে সব স্থানে দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না-হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, মক্কা ও মদিনা ব্যতীত পৃথিবীর সকল শহরেই দাজ্জাল প্রবেশ করবে। বুখারী (১৮৮১ ও মুসলিম ২৯৪৩)। হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এমন কোনো শহর নেই, যেখানে দাজ্জাল প্রবেশ করবে না, তবে মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারা ছাড়া। কেননা মক্কা ও মদিনার প্রতিটি প্রবেশপথে ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে পাহারারত থাকবেন। তারপর মদিনা শরিফ তিনবার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে। এতে সেখান থেকে সব কাফের ও মুনাফিক বের হয়ে যাবে।’ (বুখারি, হাদিস-১৮৮১)। হযরত আবু বাকর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মদিনা মুনাওয়ারায় মাসিহ দাজ্জালের প্রভাব পড়বে না, তখন তার সাতটি প্রবেশপথ থাকবে, প্রত্যেক প্রবেশপথে দুজন করে ফেরেশতা পাহারারত থাকবেন।’(বুখারি, হাদিস -১৮৭৯)।হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের দাজ্জাল সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা দেন। তাতে এ কথাও বলেন যে মদিনার প্রবেশপথে দাজ্জালের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। সেদিন একজন মানুষ যে শ্রেষ্ঠ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হবে, সে দাজ্জালের কাছে গিয়ে বলবে যে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি ওই দাজ্জাল, যার ব্যাপারে আমাদের রাসুলুল্লাহ (সা.) সাবধান করেছেন। দাজ্জাল তার সঙ্গীদের বলবে, আমি যদি তাকে হত্যা করে আবার জীবিত করতে পারি, তবে কি তোমরা আমার প্রভুত্বে সন্দেহ করবে? তারা বলবে, না। তখন সে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করে আবার জীবিত করবে। ওই ব্যক্তি বলবে, আল্লাহর কসম! আমি এখন আরো নিশ্চিত হলাম যে তুমি দাজ্জাল। তখন দাজ্জাল বলবে, তাকে আমি হত্যা করব। কিন্তু সে আর তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে না।’ (বুখারি, হাদিস-১৮৮২)।নবীজীর একজন সাহাবী থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন -তাতে আছে- নবীজী বলেন:সে চারটি মসজিদের কাছে যেতে পারবেনা, মসজিদুল হারাম, মসজিদুন নববী, মসজিদুত তূর এবং মসজিদুল আকসা।(হাদীসটি সহীহ সনদে ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন হাদীস নং২৪০৮৫, দেখুন: আসসিলসিলাতুস সহীহ ক্রমিক-২৯৩৪)।মু’মিন যুবককে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করা-নবী (সা) বলেন, “দাজ্জাল বের হলে একজন (বিশিষ্ট) ঈমানদার ব্যক্তি তার দিকে রওয়ানা হয়ে যাবে। খবর পেয়ে দাজ্জালের পক্ষ থেকে তার অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা গিয়ে তাঁর সাথে মিলিত হবে। তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি কোথায় যাওয়ার সংকল্প করেছে?’ তিনি বলবেন, ‘ঐ ব্যক্তির কাছে যে আবির্ভূত হয়েছে’। তখন তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি কি আমাদের প্রভুর প্রতি ঈমান আনবে না?’ তিনি বলবেন, ‘আমাদের প্রভু সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই’। এরপর তারা পরস্পর বলবে, ‘একে হত্যা কর’। তারপর একে অপরকে বলবে, ‘তোমাদের প্রভু যে নিষেধ করেছেন যে, তোমরা তাকে না দেখিয়ে কাউকে হত্যা করবে না?’ রাবী বলেন, ‘অতঃপর তারা তাঁকে দাজ্জালের নিকট নিয়ে যাবে। যখন মুমিন ব্যক্তি দাজ্জালকে দেখতে পাবেন, বলবেন, ‘হে জনগণ! এ তো সেই দাজ্জাল যার কথা রাসূলুল্লাহ (স) আলোচনা করেছেন’। এরপর দাজ্জালের আদেশে তাঁর চেহারাকে ক্ষত-বিক্ষত করা হবে। বলা হবে, একে ধরে চেহারা ক্ষত-বিক্ষত করে দাও। এরপর তাঁর পেট ও পিঠকে পিটিয়ে বিছিয়ে ফেলা হবে। তারপর দাজ্জাল জিজ্ঞেস করবে, ‘আমার প্রতি ঈমান আনবে না?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি তো মিথ্যাবাদী মসীহ দাজ্জাল’। এ কথা শুনে তাঁকে কুড়াল দিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলার জন্য আদেশে করা হবে। তার আদেশে তাঁকে প্রথমে দু’পা আলগা করে খণ্ড করা হবে। অতঃপর দাজ্জাল খণ্ডিত টুকরাদ্বয়ের মাঝখানে এসে তাঁকে লক্ষ্য করে বলবে, ‘উঠ!’ তৎক্ষণাৎ তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াবেন। তারপর আবার দাজ্জাল তাঁকে জিজ্ঞেস করবে, ‘এবার আমার প্রতি ঈমান আনবে কি?’ তখন তিনি বলবেন, ‘আমি তো তোমার সম্পর্কে আরও অধিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছি’। অতঃপর তিনি উপস্থিত জনতাকে লক্ষ্য করে বলবেন, ‘হে লোক সকল! মনে রেখ, দাজ্জাল আমার পরে আর কোন মানুষের উপর কর্তৃত্ব চালাতে পারবে না’। রাবী বলেন, ‘এরপর দাজ্জাল তাঁকে জবাই করার জন্য ধরবে এবং তাঁর গলা ও ঘাড়ে তামা জড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু এ পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হবে না। অতঃপর তাঁর হাত পা ধরে তাকে নিক্ষেপ করবে। মানুষ ধারণা করবে বুঝি আগুনে ফেলে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তাঁকে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে’। রাসূল (সা) বলেন, “রাব্বুল আলামীনের নিকট এ ব্যক্তি সবচেয়ে বড় শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবেন”। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ফিতান)।
দাজ্জালের সময়কাল- রাসুল (সা.) বলেন, দাজ্জালের সময়কাল হবে ৪০। হাদিস বর্ণনাকারী ইবনে আমর (রা.) বলেন, আমরা জানি না, ৪০ দ্বারা কী ৪০ মাস, নাকি ৪০ বছর বোঝানো হয়েছে। হজরত নাওয়াস ইবন সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে চল্লিশের প্রথম দিন হবে এক বছর, দ্বিতীয় দিন হবে এক মাস, তৃতীয় দিন হবে এক সপ্তাহ, অবশিষ্ট ৩৭ দিন হবে আমাদের দিনের মতো (মোট ৩৬৫+৩০+০৭+৩৭=৪৩৯ দিন)। পৃথিবীর ধনসম্পদ দাজ্জালের কুক্ষিগত থাকবে। তার আদেশে বৃষ্টি হবে এবং জমিন থেকে ফসল উৎপন্ন হবে। সাহাবীগণ রাসূল (স) কে জিজ্ঞেস করেছেন দাজ্জাল পৃথিবীতে কত দিন অবস্থান করবে। উত্তরে তিনি বলেছেন, “সে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। প্রথম দিনটি হবে এক বছরের মত লম্বা। দ্বিতীয় দিনটি হবে এক মাসের মত। তৃতীয় দিনটি হবে এক সপ্তাহের মত। আর বাকী দিনগুলো দুনিয়ার স্বাভাবিক দিনের মতই হবে”। আমরা বললাম, “যে দিনটি এক বছরের মত দীর্ঘ হবে সে দিন কি এক দিনের নামাযই যথেষ্ট হবে?” উত্তরে তিনি বললেন, “না, বরং তোমরা অনুমান করে সময় নির্ধারণ করে নামায পড়বে”। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ফিতান)।
দাজ্জালের শেষ পরিণতি- সহীহ হাদীসের বিবরণ অনুযায়ী, ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ.) এর হাতে দাজ্জাল নিহত হবে। বিস্তারিত বিবরণ এই যে, মক্কা-মদীনা ব্যতীত পৃথিবীর সকল দেশেই সে প্রবেশ করে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। সামান্য সংখ্যক মুমিনই তার এই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ঠিক সে সময় দামেস্ক শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এক মসজিদের সাদা মিনারের উপর ঈসা (আ.) আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। মুসলমানগণ তার পার্শ্বে একত্রিত হবে। তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি দাজ্জালের দিকে রওনা দিবেন। দাজ্জাল সে সময় বায়তুল মাকদিসের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। অতঃপর ঈসা (আ.) ফিলিস্তিনের লুদ্দ শহরের দ্বারপ্রান্তে দাজ্জালকে পাকড়াও করবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। (সহীহ মুসলিম,কিতাবুল ফিতা।
দাজ্জালের ফেতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়- রাসুল (সা) দাজ্জালের ফেৎনা থেকে বাঁচার অনেকগুলো উপায় বাতলেছেন যেগুলো হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে পাওয়া যায়। আমরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তুলে ধরছি। আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, “আমি রসূলুল্লাহ (স) কে নামাযের ভিতরে দাজ্জালের ফিত্না থেকে আশ্রয় চাইতে শুনেছি”। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১২৯)।তিনি নামাযের শেষ তাশাহুদে বলতেন, “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব, জাহান্নামের আযাব, জীবন-মরণের ফিতনা এবং মিথ্যুক দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই”। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ১৩৭৭)।আল্লাহ তায়ালা উপর পরিপূর্ণ ঈমান, সর্বদা বিশেষ করে সালাতে আল্লাহ তায়ালার নিকট দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং তার থেকে ভেগে থাকা। হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সুরা কাহাফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিস্কৃতি পাবে।’ (মুসলিম) অন্য রেওয়াতে এসেছে, ‘তোমাদের কাউকে যদি সে পেয়ে বসে, তাহলে তার ওপর সুরা কাহাফের প্রথম থেকে পড়বে।’ (বর্ণনায় মুসলিম হাদীস- ৮০৯ ও ২৯৩৭)।তাশাহহুদে পঠিত দোয়া-
اَللَّهُمَّ اِنِّي اَعُوْذُبِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيْح الدَّجَّال
উচ্চারণ - ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আ’উজুবিকা মিন ফিতনাতি মাসিহুদ দাজ্জাল।’ (বুখারি)।অর্থ - ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট অভিশপ্ত দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই।’
গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন