সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও পন্ডিতের মহানবি (সা.)'র নবুয়তের ভবিষ্যত বাণী


মো.আবু রায়হান :মহানবি (সা.) নবুয়ত লাভ করার আগে দুজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক মহানবি সা.)কে ভবিষ্যতে রাসুল বলে স্বীকৃতি দেন। চল্লিশ বছর বয়সে হেরা গুহায় ওহী লাভের পরও একজন খ্রিস্টান পন্ডিত মহানবি (সা.) কে রাসুল হিসেবে ভবিষ্যত বাণী করেন। 

এক
হযরত মুহাম্মদ (সা.)'র বয়স তখন ১২ বছর। তাঁর চাচা আবু তালিব বাণিজ্যে যাবেন।হযরত  মুহাম্মদ (সা.)ও সঙ্গে যাবার বায়না ধরলেন। না-না করেও কিশোর হযরত মুহাম্মদ (সা.)'র আবদার না রেখে পারলেন না আবু তালিব।হযরত হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আবদার নিছক শখ ছিল না। তিনি সবসময় চাইতেন কোনো-না-কোনোভাবে চাচার কষ্ট লাঘব করতে।

ব্যবসা-উপলক্ষে আবু তালিব গমন করেন শাম দেশে যেটি বর্তমানের সিরিয়া। সফরের এক পর্যায়ে তিনি বসরায় গিয়ে উপস্থিত হন। এ শহরে জারজিস নামক একজন খৃস্টান ধর্মযাজক বসবাস করতেন, তার উপাধি ছিল বুহায়রা বা বাহিরা, এবং এ উপাধিতেই তিনি সকলের নিকট পরিচিত ও মশহুর ছিলেন। মক্কার ব্যবসায়ী-দল যখন বসরায় শিবির স্থাপন করেন, তখন ধর্মযাজক গির্জা থেকে বেরিয়ে তাদের নিকট আগমন করেন এবং আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন; অথচ এর আগে কখনো তিনি এভাবে গির্জা থেকে বেরিয়ে কোনো বাণিজ্য-কাফেলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি।তিনি কিশোর হযরত  মুহাম্মদ (সা.)'র অবয়ব, আচরণ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝতে পারেন যে, ইনিই হচ্ছেন বিশ্বমানবের মুক্তির দিশারি আখেরি নবি (সা.)। তারপর হযরত মুহাম্মদ (সা.)'র হাত ধরে তিনি বলে, ‘ইনি হচ্ছেন বিশ্ব জাহানের সরদার। আল্লাহ তাঁকে বিশ্ব-জাহানের রহমতরূপী রাসুল মনোনীত করবেন।’আবু তালিব এবং কুরাইশ বংশের লোকজন বললেন, ‘আপনি কিভাবে অবগত হলেন যে, তিনিই হবেন আখেরি নবি?’ বুহায়রা বললেন, ‘গিরিপথের ওই প্রান্ত থেকে তোমাদের আগমন যখন ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হয়ে আসছিল, আমি প্রত্যক্ষ করলাম যে, সেখানে এমন কোনো বৃক্ষ কিংবা প্রস্তরখণ্ড ছিলো না, যা তাঁকে সেজদা করেনি। এ সকল জিনিস নবি-রাসুল ছাড়া সৃষ্টিরাজির অন্য কাউকে কখনো সেজদা করে না। অধিকন্তু ‘মোহরে নবুওত’ দেখেও আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। পিঠে দুই কাঁধের মাঝখানে নবুয়তের মোহর অঙ্কিত দেখে আর সেটাই হচ্ছে ‘মোহরে নবুয়ত’। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলসূত্রে আমরা এ সব কিছু অবগত হতে পেরেছি।’এরপর বুহায়রা আবু তালিবকে বললেন, ‘তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আর বিদেশ-ভ্রমণ করবেন না। শীঘ্রই তাঁকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কারণ, তাঁর পরিচয় অবগত হলে ইহুদিরা তাঁকে হত্যা করে ফেলতে পারে।কেননা ভবিষ্যতে আপনার ভাতিজা একজন মহামানব হিসেবে আবির্ভূত হবেন। এ কথা শোনার পর আবু তালিব কিশোর হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে দেশে ফিরে গেলেন। 

দুই

বাণিজ্য উপলক্ষে হযরত মুহাম্মদ (সা.)হযরত খাদিজার গোলাম মাইসারাকে সাথে নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা হন।সিরিয়া গিয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার আর নৈপুণ্যগুণে অধিক লাভে ব্যবসার পণ্য বিক্রি করেন।সিরিয়ার পথে যখন হযরত মুহাম্মদ (সা.)কোনো এক স্থানে অবস্থান করছিলেন, তখন একটি ঘটনা ঘটল। নাসতুর নামক এক ধর্মযাজক হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে দেখতে পেলেন। সর্বশেষ নবির যেসব লক্ষণ পূর্ববর্তী আসমানি গ্রন্থসমূহে বর্ণিত ছিল, হুবহু তা হযরত মুহাম্মদ (সা.)'র মধ্যে দেখতে পেয়ে নাসতুর তাকে চিনে ফেললেন ওই ধর্মযাজক মাইসারাকে আগ থেকেই চিনতেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঐ গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকটি কে?’ সে বলল, ‘পবিত্র মক্কার অধিবাসী কুরাইশ বংশীয় এক সম্ভ্রান্ত যুবক।’ নাসতুর বললেন, "এই গাছের নিচে নবি ছাড়া আর কেউ কখনো বিশ্রাম নেয়নি।"এই যুবক ভবিষ্যতে নবি হবেন।

তিন
চল্লিশ দিন হেরা গুহায় অবস্থান করে রাসুল (সা.) ফিরে এলেন।তাঁর উপর প্রথম ওহী অবতীর্ণ হলে অন্তর কাঁপছিল। তিনি খাদিজা বিন্‌ত খুওয়ালিদের কাছে এসে বললেন, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। খাদিজা তাঁকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাঁর ভয় দূর হল। তখন তিনি খাদিজা(রা.) এর কাছে সকল ঘটনা জানিয়ে তাঁকে বললেন, আমি নিজের উপর আশংকা বোধ করছি। খাদিজা (রা.) বললেন, আল্লাহ্‌র কসম, কখনো না। আল্লাহ্ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনিতো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। এরপর তাঁকে নিয়ে খাদিজা (রা.) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনু নাওফিল(অথবা নাওফাল) ইবনু আবদুল আসা’দ ইবনু আবদুল উযযার কাছে গেলেন, যিনি জাহিলী যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হিব্রু ভাষা লিখতে জানতেন, তাওরাতের পন্ডিত ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদিজা (রা.) তাঁকে বললেন, হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। ’ ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাতিজা! তুমি কী দেখ?’ রাসুল (সা.) যা দেখেছিলেন, সবই খুলে বললেন।তখন ওয়ারাকা তাঁকে বললেন, ইনি সে দূত যাঁকে আল্লাহ্ মুসা(আ.) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কাওম তোমাকে বের করে দেবে। ’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তাঁরা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব। ’ এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা ইন্তেকাল করেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...