সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

যুগেযুগে বিভিন্ন পাপিষ্ঠ সম্প্রদায়ের উপর আল্লাহর যত গজব



মো.আবু রায়হান : আল্লাহ তায়ালা বড়ই দয়ালু ও মেহেরমান। তিনি তাঁর সৃষ্টি জগতের প্রতি অত্যন্ত সদাশয় ও ন্যায়নিষ্ঠ। আল্লাহ  তাঁর বান্দাদের হাজারো গুনাহ ক্ষমা করে দেন কিন্তু তাঁর সঙ্গে যারা নাফরমানী করে, অবাধ্য হয়ে যায়, পাপাচারে লিপ্ত হয়ে সীমা লংঘন করে তাদের তিনি গজবের  দ্বারা পাকড়াও করে সমূলে ধবংস করে দেন। মানুষের পাপে যখন সর্বত্র ছেয়ে যায় তখন আল্লাহর পক্ষ হতে শাস্তি অনিবার্য হয়ে যায়। কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর তোমাদের কৃতকর্মের কারণই তোমাদের ওপর বিপদ নেমে আসে। অথচ তিনি অনেক কিছুই উপেক্ষা করে থাকেন’ (সুরা আশ শুরা আয়াত- ৩০)। আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেন,‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও জলে বিশৃঙ্খলা ছেয়ে গেছে। এর পরিণামে তিনি তাদের কোন কোন কর্মের শাস্তির স্বাদ তাদের ভোগ করাবেন যাতে তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে’ (সুরা আর রূম আয়াত - ৪১)।আল্লাহর অবাধ্যতা, সীমালঙ্ঘন ও অবাধ পাপাচারের জন্য আল্লাহ অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি,ঝড়, ভূকম্পন, আকাশের গর্জন ও প্লাবন দিয়ে অতীতে অনেক জাতি ও সম্প্রদায়কে ধবংস করেছেন। আল্লাহ বলেন,'......... তাদের প্রত্যেকেই তার অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছিলোম। তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচন্ড ঝটিকা, তাদের কাউকে আঘাত করেছিলো মহানাদ, কাউকে আমি প্রোথিত করেছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের কারো প্রতি জুলুম করেননি। তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল’। (সূরা আনকাবুত, আয়াত ৩৯-৪০)।পৃথিবীর অনেক জাতি সম্প্রদায়ের উপর আল্লাহর গজব নাযিল হয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি জাতির উপর আপতিত গজব নিয়ে আজকের এই লেখা। 
হযরত নুহ (আ.)নবী যাকে আদমে সানি বা দ্বিতীয় আদম বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা হযরত  নুহ (আ.)কে ৯৫০বছর সুদীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্লান্তভাবে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেয়ার পরও তারা ঈমান আনেনি। বরং হযরত নুহ (আ.)'র সম্প্রদায় মূর্তিপূজায় লিপ্ত থাকতো। তিনি তাদের মূর্তিপূজা ছেড়ে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী হতে বলেন।   কিন্তু তারা নুহ (আ.)'র কথা তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করে। তারা তাঁকে বলেছিল, ‘হে নুহ! যদি তুমি বিরত না হও, তবে পাথর মেরে তোমার মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হবে।’ (সুরা শুয়ারা, আয়াত -১১৬)।হযরত নুহ (আ.)'র দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় খুব কম সংখ্যক মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিল।তাঁর সময়ের সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা হযরত নুহ (আ.)'র কথায় কর্ণপাত করেনি। তিনি তাদের আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেন। তবু তাদের চৈতন্যোদয় হলো না।বরং তারা বলতে থাকে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা বলল, হে নূহ! তুমি তো আমাদের সাথে বিতণ্ডা করেছ এবং বিতণ্ডা করেছ অতিমাত্রায়। সুতরাং যদি তুমি সত্যবাদী হও, তাহলে আমাদের যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আসো।’ (সূরা হুদ আয়াত-৩২)।
আল্লাহ তায়ালা হযরত  নূহ (আ.)কে নৌকা তৈরির করার আদেশ দিলেন। তিনি নৌকা তৈরি করলেন। গজবের নিদর্শন প্রকাশিত হওয়ার পর হযরত নুহ (আ.) সব ঈমানদার ও প্রাণিকূল থেকে প্রত্যেক প্রাণীর এক জোড়া করে নৌকায় তুলে নিলেন।হযরত নূহ (আ.)-এর সাড়ে ৯০০ বছরের দাওয়াতে ৮০ জন পুরুষ এবং ৮০ জন নারী মিলে মোট ১৬০ জন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। 
তাদের নিয়ে নৌকায় উঠলেন, অবশেষে আল্লাহর আজাব নেমে আসে। আল্লাহর নির্দেশে ভূগর্ভস্থ পানি বের হতে লাগল আর আকাশ বর্ষণ করতে লাগল মুষলধারে বৃষ্টি। বন্যায় ডুবে সব অবিশ্বাসী কাফেরের সলিল সমাধি ঘটে। নৌকায় ঈমানদারগণ ১২০ দিন অবস্থান করে।প্লাবনের পর নৌকাটি জুদি পাহাড়ে গিয়ে নোঙর করে।এমন প্লাবন সেই জাতিকে গ্রাস করেছিল, যেই প্লাবন হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস হয়ে আছে। তখন হযরত নুহ (আ.)'র নৌকায় যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারা সবাই রক্ষা পেয়েছিল। কুরআনের ২৮টি সূরায় ৮১টি আয়াতে এসব ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার (নুহের) বংশধরদের অবশিষ্ট রেখেছি বংশপরম্পরায়।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত - ৭৭)।

ফেরাউন প্রাচীন মিসরের নৃপতি সে নিজেকে খোদা দাবি করেছিল।হযরত মুসা ও হযরত  হারুন (আ.) তার কাছে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত নিয়ে যান। কিন্তু ফেরাউনের পাগলামি আর অহমিকা আরো বেড়ে গেল। সে হযরত মুসা (আ.) কে হত্যা করতে মনস্থির করে।তাই সে সদলবলে হযরত মুসা (আ.) কে ধাওয়া করে। আল্লাহর আদেশে লোহিত সাগরে রাস্তা তৈরি হয়। হযরত মুসা (আ.) নির্বিঘ্নে পার হয়ে যান। কিন্তু ফেরাউন সাগরে ডুবে মারা যায়। আল্লাহর গজব দেখে ফেরাউন তাওবা করার চেষ্টা করেছিল,  কিন্তু তার তাওবা কবুল হয়নি, বরং আল্লাহ তায়ালা তাকে পৃথিবীবাসীর জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমার (ফেরাউন) দেহ রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো। অবশ্যই মানুষের মধ্যে অনেকে আমার নিদর্শন সম্পর্কে উদাসীন।’ (সুরা ইউনুুস,আয়াত - ৯২)

মাদইয়ান লুত সাগরের সন্নিকটে সিরিয়া ও হিজাজের সীমান্তবর্তী একটি জনপদের নাম।
মার্জিত ভাষা ও সুমধুর কন্ঠের অধিকারী খতিবুল আম্বিয়া হিসেবে খ্যাত হযরত শোয়াইব (আ.) ছিলেন তাদের স্বজাতীয় ভাই ও পয়গম্বর। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি মাদইয়ানে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই শোয়াইবকে’। (সূরা হুদ আয়াত-৮৪)। কুফরি করা ছাড়াও এ জনপদের লোকেরা ওজন ও মাপে কম দিত। অন্যের সম্পদ লুটপাট ও আত্মসাত করত। অন্যায় পথে জনগণের সম্পদ ভক্ষণ করত। কুরআনে এরশাদ করা হয়েছে, ‘মাদইয়ানবাসীদের প্রতি তাদের ভাই শোয়াইবকে আমি পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো উপাস্য নেই। আর ওজন ও পরিমাপে কম দিয়ো না। আমি তো দেখছি তোমরা সমৃদ্ধিশালী (এর পরও তোমরা ওজনে কম দিলে), আমি তোমাদের জন্য এক সর্বগ্রাসী দিনের আজাবের আশঙ্কা করছি।’ (সুরা হুদ, আয়াত - ৮৪)।সডাকাতি, লুণ্ঠন, লুটতরাজ ও ওজনে কম দেয়ার মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত থাকা এই জাতিকে  ভূকম্পন ও অগ্নিবৃষ্টি দিয়ে আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করে দেন। 
ইয়েমেনের সীমান্ত লাগোয়া রিয়াদের দক্ষিণ দিকে হযরত হুদ (আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন আদ জাতির নিকট। আদ জাতির সুউচ্চ প্রাসাদ,  সুরম্য অট্রলিকা ও বাগান ছিল।স্বহস্তে নির্মিত প্রতিমার পূজা, নবীর সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ, শক্তি ও উন্নত প্রকৌশল শিল্পের বড়াই তাদের আল্লাহর গুণকীর্তন থেকে অন্ধ ও গাফেল বানিয়ে দেয়।তারা অঙ্কন শিল্পেও ছিল সমান দক্ষ। তাদের তৈরি ইরাম-এর মতো অনিন্দ্য তিলোত্তমা শহর ভূমণ্ডলের আর কোথাও ছিল না। কিন্তু এসব শিল্প তাদের প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখোনি, তোমার প্রতিপালক আদ জাতির ইরাম গোত্রের প্রতি কী (আচরণ) করেছেন—যারা ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের অধিকারী, যার সমতুল্য (প্রাসাদ) কোনো দেশে নির্মিত হয়নি।’ (সুরা  ফাজর,আয়াত - ৬-৮)।শক্তি ও ক্ষমতার বাহাদুরি তাদের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে ফেলে।আদ জাতির নিকট প্রেরিত নবি হযরত হুদ (আ.) তাদের  আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে জীবন পরিচালনার কথা বললেন। হযরত হুদ (আ.) বললেন, ‘তোমরা মজবুত অট্টালিকা বানিয়েছ এ জন্য যে, তোমরা এখানে চিরকাল থাকবে? কিন্তু সবই নশ্বর। হযরত হুদ (আ.)যখন তাদের আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেন তখন তারা বলে বেড়াত, এ দুনিয়ায় আমাদের চেয়ে শক্তিশালী কে আছে?এদের এই অহঙ্কার ও অমার্জনীয় আস্ফালনের কারণে প্রাথমিক আজাব হিসেবে একনাগাড়ে তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়।ফসলের মাঠ ফলের  বাগবাগিচা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেনি।এমন পরিস্থিতিতে প্রথমে দুর্ভিক্ষ ও পরে উপর্যুপরি আট দিন সাত রাতব্যাপী ঝাঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বায়ু প্রেরণ করে,মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রপাতে বাড়িঘর ধসে যায়।প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে গাছপালা উপড়ে যায়। মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে জমিনে পতিত হয় এভাবে তাদের সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হয়। 

ফিলিস্তিনে অবস্থিত ওর্দুনের পূর্বাঞ্চলে সাদুম ও আমুরিয়া এই দু’টি জনপদে আবাস ছিল হযরত  লুত (আ.)'র কাওমের। অনেকে বলেন জনপদটি  ইরাক ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত । বাইবেলে এ জাতির কেন্দ্রীয় স্থান ‘সাদুম’ বলা হয়েছে।তবে আধুনিক কালের ট্রান্স জর্দান এই জনপদ। বিকৃত যৌনচারে অভ্যস্ত ছিল হযরত  লুত (আ.)-এর জাতি।পৃথিবীতে অসভ্য এই জাতিগোষ্ঠীই সর্বপ্রথম সমকামিতার সূচনা করে। পশুত্ব ও নির্লজ্জতা তাদের মধ্যে এতটাই ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে যে, অপরাধ বোধটুকু পর্যন্ত তারা হারিয়ে ফেলেছিল।হযরত লুত (আ.)'র জাতি যে অঞ্চলে বসবাস করত সেই সাদুম নগরী সবুজ শ্যামল ছিল। এতে পানির সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত। ভূমি ছিল অত্যন্ত উর্বর ও শস্যে পরিপূর্ণ। অঞ্চলটিকে আল্লাহ তায়ালা নানা প্রাচুর্য দিয়ে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। লুত (আ.)-এর জাতি প্রাচুর্যময় জীবনযাত্রার সঙ্গে বেপরোয়া হয়ে উঠে। পৃথিবীতে পরিচিত ও অপরিচিত এমন কোনো ঘৃণিত অপরাধ নেই, যা সে জাতির ভেতরে ছিল না। হযরত লুত (আ.) বহু বছর তাদের দাওয়াত দিয়েও এই অপকর্ম থেকে ফেরাতে পারেননি।ফলে হযরত লুত (আ.)'র জাতির পাপীদের ওপর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাপ্রলয় নেমে আসে। এক শক্তিশালী ভূমিকম্প পুরো নগরটিকে সম্পূর্ণ উল্টে দেয়। ঘুমন্ত মানুষের ওপর তাদের ঘরবাড়ি আছড়ে পড়ে। পাশাপাশি আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো কঙ্কর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। ওই মহাপ্রলয়ের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি। আল কুরআনে তাদের বিবরণ এসেছে সূরা হুদ, শুয়ারা, হিজর ও আনকাবুতসহ অন্যান্য সূরাগুলোতে।অভিশপ্ত জনপদটির ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান।লুত (আ.)-এর জাতির ধ্বংসস্থলটি বর্তমানে ‘বাহরে মাইয়েত’ বা ‘বাহরে লুত’ নামে খ্যাত। এটি এখনো গজবের সাক্ষী হয়ে ডেড সি বা মৃত সাগর নামে বিদ্যমান । এখানে কোনো মাছ, ব্যাঙ, এমনকি কোনো জলজ প্রাণীও বেঁচে থাকতে পারে না। এ কারণেই একে মৃত সাগর বলা হয়।

সামুদ জাতির বাসস্থান ছিল হেজাজ ভূমি তথা বর্তমান সৌদির সিরিয়া সীমান্ত বরাবর অংশ এবং সিরিয়ার মধ্যস্থল হিজর ও ওয়াদিল কুরা নামক স্থানে।মূলত হিজর ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় আবাসস্থল।সামুদ জাতির ধ্বংসাবশেষ মদিনার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। বর্তমান শহর আল উলা থেকে কয়েক মাইল ব্যবধানে তা দেখা যায়। সামুদ জাতি শিল্প ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ছিল।বলা হয়ে থাকে আদ জাতির পর আল্লাহ তায়ালা তাদের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি দান করেছেন। তাদের জীবনযাপনের মান যতটা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল সেই তুলনায় মানবতা ও নৈতিকতার মান ছিল ততই নিম্নগামী ও অবক্ষয়ে ভরা।তারা যেমন খোলা মাঠে প্রান্তরে পাথর খোদিত প্রাসাদ তৈরি করেছিল অপরদিকে সমাজে কুফর, শিরক ও পৌত্তলিকতার প্রসার ঘটিয়েছিল। ন্যায়-ইনসাফ বলে সে সমাজে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অন্যায় ও অবিচারে সমাজ ধবংসের পথে।সেই জাতির  সমাজে চরিত্রহীন লোকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। হযরত সালেহ (আ.)সামুদ জাতিকে যে সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন, তাতে নিম্ন শ্রেণির লোকেরাই সাড়া দিয়েছিল।হযরত সালেহ (আ.) সারা জীবন তাদের হেদায়েতের পথে আনার চেষ্টা করেছেন। এতে অল্প কিছু সঙ্গী ছাড়া গোটা জাতি তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে। একপর্যায়ে সামুদ জাতি দাবি করে, আপনি যদি সত্যি নবী হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের কাতেবা নামের পাহাড় থেকে ১০ মাসের গর্ভবতী, সবল ও স্বাস্থ্যবতী একটি উট বের করে দেখান। এটি দেখাতে পারলে আমরা আপনার ওপর ঈমান আনব। হযরত সালেহ (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহর কুদরতে পাহাড় থেকে একটি অদ্ভুত রকমের মাদি উট বের হয়। তা দেখে কিছু লোক ঈমান আনে। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব পর্যায়ের যারা ছিল তারা ঈমান আনেনি, বরং তারা সে উটনিকে হত্যা করে ফেলে। এতে হযরত সালেহ (আ.) তাঁর জাতির ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসার হুশিয়ারি দেন। উদ্ধত অহঙ্কারী সামুদ জাতির প্রতি হযরত সালেহ (আ.)'র হুঁশিয়ারি সত্যি বাস্তবায়িত হয়েছে। হঠাৎ একদিন প্রচণ্ড শব্দে ভূমিকম্প তাদের নাস্তানাবুদ করে ফেলে। বজ্রপাতের ভয়ংকর শব্দে মানুষ ভীত বিহ্বল ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অবশেষে গগন বিদারী আওয়াজে তাদের অপমৃত্যু ঘটে। আসমানি গজব অবিশ্বাসীদের চিরতরে ধবংস করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারপর সীমা লঙ্ঘনকারীদের মহানাদ আঘাত করে। ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে (ধ্বংস হয়ে যায়)। যেন তারা কখনোই সেখানে বসবাস করেনি। জেনে রেখ, সামুদ জাতি তাদের প্রভুকে অস্বীকার করেছিল। আরও জেনে রেখো, ধ্বংসই হলো সামুদ জাতির পরিণাম।’ (সুরা হুদ আয়াত - ৬৭-৬৮)। একসময় যে জাতি পাহাড়ে ঘর নির্মাণ করত, পৃথিবীতে যাদের চেয়ে শক্তিশালী কোনো জাতি ছিল না, আসমানি আযাবে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। 
আল্লাহ বিনা কারণে কোনো জাতি সম্প্রদায়কে শাস্তি দেননি যা উপরিউক্ত বর্ণিত ঘটনাসমূহ সাক্ষ্য বহন করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'যে কেউ সৎপথে চলে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎ পথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথ ভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।যখন আমি কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তার অবস্থাপন্ন লোকদেরকে উদ্ধুদ্ধ করি অতঃপর তারা পাপাচারে মেতে উঠে। তখন সে জনগোষ্টীর উপর আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমি তাকে উঠিয়ে আছাড় দেই।' (বনি ইসরাইল, আয়াত ১৫ -১৬)।আমাদের প্রিয় নবী (সা.) আল্লাহ তায়ালার কাছে এ দোয়ায় করেছিলেন যে তাঁর উম্মতকে যেন পূর্বেকার সম্প্রদায়ের মতো আজাব তথা মানব আকৃতির বানর, শূকর ইত্যাদির আকৃতিতে পরিবর্তন , শিলা বৃষ্টি, ভূমি উল্টিয়ে দেওয়ার মতো কঠিন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনষ্ট করা না হয়। আল্লাহ আমাদের সকল প্রকারের পাপ পঙ্কিলতা হতে হেফাজত করুন। আমিন

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...