বার্ধক্যে পিতামাতার প্রতি খেদমত কেমন হওয়া উচিত ?
মো.আবু রায়হান: পিতামাতার খেদমত সন্তানদের ওপর প্রয়োজন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী ফরজ ও ওয়াজিব। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো। (সুরা ৪ নিসা আয়াত- ৩৬) এক হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে”। (তিরমিযী: ১৮৯৯)।অন্য হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, “সে ব্যক্তির নাক ধুলিমলিন হোক, তারপর ধুলিমলিন হোক, তারপর ধুলিমলিন হোক”, সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে কে? রাসূল বললেনঃ “যে পিতা-মাতার একজন বা উভয়কে তাদের বৃদ্ধাবস্থায় পেল তারপর জান্নাতে যেতে পারল না”। (মুসলিমঃ ২৫৫১)।......... ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।তারা একজন বা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল। (সুরা বনি ইসরায়েল আয়াত-২৩)।
পিতা-মাতার সেবাযত্ন ও আনুগত্য পিতা-মাতা হওয়ার দিক দিয়ে কোন সময়ও বয়সের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। সর্বাবস্থায় এবং সব বয়সেই পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা ওয়াজিব। কিন্তু বার্ধক্যে উপনীত হয়ে পিতা-মাতা সন্তানের সেবাযত্নের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন এবং তাদের জীবন সন্তানদের দয়া ও কৃপার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন যদি সন্তানের পক্ষ থেকে সামান্যও বিমুখতা প্ৰকাশ পায়, তবে তাদের অন্তরে তা ক্ষত হয়ে দেখা দেয়। অপরদিকে বার্ধক্যের উপসৰ্গসমূহ স্বভাবগতভাবে মানুষকে খিটখিটে মেজাজের করে দেয়। তদুপরি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে যখন বুদ্ধি-বিবেচনাও অকেজো হয়ে পড়ে, তখন পিতা-মাতার বাসনা এবং দাবীদাওয়াও এমনি ধরনের হয়ে যায়, যা পূর্ণ করা সন্তানের পক্ষেও কঠিন হয়। আল্লাহ তায়ালা এসব অবস্থায় পিতা-মাতার মনোতুষ্টি ও সুখ-শান্তি বিধানের আদেশ দেয়ার সাথে সাথে সন্তানকে তার শৈশবকাল স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আজ পিতা-মাতা তোমার যতটুকু মুখাপেক্ষী, এক সময় তুমিও তদপেক্ষা বেশী তাদের মুখাপেক্ষী ছিল।
তখন তাঁরা যেমন নিজেদের আরাম-আয়েশ ও কামনা বাসনা তোমার জন্যে কোরবান করেছিলেন এবং তোমার অবুঝ কথাবার্তাকে স্নেহমমতার আবরণ দ্বারা ঢেকে নিয়েছিলেন, তেমনি মুখাপেক্ষিতার এই দুঃসময়ে বিবেক ও সৌজন্যবোধের তাগিদ এই যে, তাদের পূর্ব ঋণ শোধ করা কর্তব্য।আল্লাহ বলেন, '‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যে তুমি আমার এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমার কাছেই তো ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা লোকমান, আয়াত- ১৪)সুরা বনি ইসরাঈলের ঐ আয়াতে উফ বাক্যে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার দ্বারা বিরক্তি প্ৰকাশ পায়। এমনকি, তাদের কথা শুনে বিরক্তিবোধক দীর্ঘশ্বাস ছাড়াও এর অন্তর্ভুক্ত। মোটকথা, যে কথায় পিতা-মাতার সামান্য কষ্ট হয়, তাও নিষিদ্ধ। হাদীসে রয়েছে, কোন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ( সা.)কে প্রশ্ন করল, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোনটি? তিনি বললেন, সময় হলে সালাত পড়া। সে আবার প্রশ্ন করল, এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার। (মুসলিম- ৮৫)।
তবে আল্লাহর নাফরমানীর কাজে কোন সৃষ্ট-জীবের আনুগত্য জায়েয নয়। সে হিসেবে কোন কোন বিষয়ে পিতা-মাতার আনুগত্য ওয়াজিব তো নয়ই; বরং জায়েযও নয়। কিন্তু পিতা-মাতার সেবাযত্ন ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাদের মুসলিম হওয়া জিরুরী নয়, হযরত আসমা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করেন, আমার জননী মুশরিকা। তিনি আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তাকে আদর-আপ্যায়ন করা জায়েয হবে কি? তিনি বললেন “তোমার জননীকে আদর-আপ্যায়ন কর।” (মুসলিম- ১০০৩) কাফের পিতা-মাতা সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ্ বলেছেন, আমি মানুষকে নির্দেশ দিচ্ছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তবে ওরা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদেরকে মেনো না। (সূরা আল-আনকাবূত- ৮) আল্লাহ আরেক জায়গায় বলেনঃ “তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মেনো না, তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে বসবাস করবে। সদভাবে”। (সূরা লুকমান আয়াত - ১৫)।অর্থাৎ যার পিতা-মাতা কাফের এবং তাকেও কাফের হওয়ার আদেশ করে এ ব্যাপারে তাদের আদেশ পালন করা জায়েয নয়, কিন্তু দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে হবে।
হাদিস শরিফে এসেছে. এক জুমার দিনে রাসুল (সা.) মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! অতঃপর দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! তারপর তৃতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! এরপর খুতবা দিলেন ও নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুল (সা.) ! আজ যা দেখলাম, তা ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি (আপনি একেক ধাপে পা রেখে, আমিন! আমিন!! আমিন!! বললেন) ; এটা কি কোনো নতুন নিয়ম! নাকি?নবি করিম (সা.) বললেন, না, এটা নতুন কোনো নিয়ম নয়; বরং আমি মিম্বারে ওঠার সময় হযরত জিবরাইল (আ.) এলেন, আমি যখন মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখি, তখন হযরত জিবরাইল (আ.) বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা পিতা-মাতা উভয়কে বা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও তাঁদের খেদমতের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! (তাই হোক)। আমি যখন মিম্বারের দ্বিতীয় ধাপে পা রাখি, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা রমজান পেল, কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে তাদের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! আমি যখন মিম্বারের তৃতীয় ধাপে পা রাখি, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা আপনার পবিত্র নাম মোবারক (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুনল কিন্তু দরুদ (নবীজির প্রতি শুভকামনা) শরিফ পাঠ করল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! (মুসলিম শরিফ)।আল্লাহ তায়ালা সর্বাবস্থায় আমাদের পিতামাতার খেদমত করার তাওফিক দিন। আমিন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন