করোনা পরিস্থিতিতে বেকার জীবন প্রলম্বিত

মো.আবু রায়হান :চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের থাবায় ক্ষতবিক্ষত মানববতা। মানুষের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ,পারমাণবিক বোমা,চন্দ্র অভিযান, মঙ্গলগ্রহ জয় সবই অসার প্রয়োজনবিহীন মনে হচ্ছে। যেখানে মানবতা রাস্তা ঘাটে, ঘরে দম বন্ধ হয়ে মরছে সেখানে এসব প্রযুক্তি অভিযান কি কাজে লাগবে?  সামান্য একটি ভাইরাস মানুষকে নাস্তানাবুদ করে চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কপালে ফেলেছে চিন্তার ছাপ। ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্য অনুযায়ী আজ অবধি সারা বিশ্বে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছে ৯৫ হাজার মানুষ। একইসঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যাও ১৬ লাখ ছুঁয়েছে। করোনায় আক্রান্ত  সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিন লাখ ৫৫ হাজার ৪৮০ জন। বিশ্বের আকাশে বাতাসে দম বন্ধ আর্তনাদ, প্রকৃতি যেন নীরবে সিরিয়াল কিলার হয়ে মানুষ খুন করছে। পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাসে যেমন আমাদের অন্য দেশসমূহের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগী হয়ে চলতে হয় তেমনি দুর্যোগ দুর্ঘটনা সবাইকে স্পর্শ করে। বৈশ্বিক এই পরিবর্তনের ঢেউ আমাদের গায়ে তথা বাংলাদেশও লাগছে।গত আট মার্চ বাংলাদেশে তিনজনের শরীরে করোনা ভাইরাস সনাক্ত হবার পর করোনা রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে।
সতর্ক পদক্ষেপ হিসেবে বন্ধ রয়েছে দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিস আদালত, পরিবহন। আমেরিকা ইতালির মতো করোনার বীভৎসতা দেশবাসী না দেখলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেকে বিচলিত ও ভীত। দিনমজুর, রিক্সা, ভ্যান চালক, শ্রমিক, দরিদ্র, দুস্থরা আজ করুণ হালে দিনাতিপাত করছে।  আয় রোজগার না থাকায় তাদের ত্রাণ ও অন্যের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। কখনো অনাহারে অর্ধাহারে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় চার কোটি শিশুর অলস ও মন খারাপের দিন কাটছে। প্রিয় স্কুলে যেতে না পারার কষ্ট ওদের প্রতিনিয়ত তাড়িত করছে। হোম কোয়ারেন্টিন, লকডাউনের কারণে মানুষ অনেকটা বন্দী সময় পার করছে। তারপরও কিছু মানুষের বিনা প্রয়োজনে বাইরে ঘুরোঘুরি  করতে বের হওয়াটা খুবই বেদনার।
সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ডাক্তার সার্বক্ষণিকভাবে দেশের মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। এদিকে করোনা অভিশাপে পিষ্ট এদেশের বেকার তরুণ সমাজ অনেকটাই আলোচনার বাইরে।এই মুহুর্তে  দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। তন্মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ১০ লাখ ৪৩ হাজার। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। তবে প্রকৃত বেকারত্বের সংখ্যা এই সংখ্যার চেয়ে ঢের বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। অনেক বেকারদের হয়তো দুই তিনমাসের মধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি  হতো।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি এবং দেশের সবখানে আজ খাখা করছে বেকার তরুণদের সরব উপস্থিতির খরায়। কেউ মৌখিক, কেউবা লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের আশায় প্রহর গুনছেন। এখনো তারা বেকারত্বের জীবন নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায়। এসবের বাইরে সদ্য পাস করা শিক্ষিত বেকারদের অবস্থাও কাহিল। অনেকে মেসে, বাসায়, হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছেন ভালো একটি চাকরির আশায়। তারা বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষায় টিকলেও চূড়ান্ত ভাবে মনোনীত না হওয়ায় দুর্বিষহ কষ্ট তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।বেকার তরুণেরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির যৌক্তিক  দাবি জানিয়ে আসছে কিন্তু সরকার এবিষয়ে নীরব। এইতো কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এক গ্র্যাজুয়েট আত্মহত্যা করেছেন।কারণ হিসাবে জানা গেল, সরকারি চাকরিতে বয়স শেষ হওয়া, দীর্ঘদিন চেষ্টার পরও চাকরি না পাওয়ায় তরুণ সেন নামে ছেলেটি আত্মহত্যা করেন। তিনি ঢাবির দর্শন বিভাগে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। 
শুধু একটি ভালো চাকরি পাবার আশায় অনেক বেকার ছেলে ঈদ পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবের ছুটিতে বাড়ি পর্যন্ত যান না। বাড়ি গেলে প্রতিবেশী ও পরিবারের লোকজনের কটু কথা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয়। এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা, কটুক্তি গলাধঃকরণ করতে না পারার যন্ত্রণা, বাড়ি থেকে দূরে কোনো বাসা বাড়ি কিংবা মেসের চার দেয়ালের ভেতরে বসে খেয়ে না খেয়ে থেকে একটি বই হাতে নিয়ে বড় কিছু হবার স্বপ্ন তাদের স্বজন বিচ্ছেদ ভুলিয়ে রাখে। দুখিনি মায়ের মলিন মুখ, পরিশ্রান্ত বাবার কষ্টের হাসি, আদরের বোনের মায়া ভরা মুখের হাতছানি কোনো কিছুই তাদের পেছনে ফেরায় না। তখন অদম্য জেদ বেকারত্ব ঘোচানোর তন্ত্রমন্ত্রে পরিণত হয়।জনৈক কবির কয়েকটি চরণ মনে পড়ে গেল, 
বেকারের এই চুল্লিতে কেউ
একটু আগুন দে
আরেকটি বার বেঁচে থাকি
বাঁচার আনন্দে।
মরতে গেলেই ফাঁস কেটে যায়
পাশ কেটে যায় গাড়ি
জুড়তে গেলেই বিয়ের লগন
ঘর ছেড়ে যায় নারী।

কবিতার প্রতিটি চরণ যেন বেকারদের বুকে জমা বিষাদের অগ্নি বারুদের বিস্ফোরণ। বাড়িতে না যেতে চাইলেও এবার করোনার ভয়াবহতা ও বেঁচে থেকে স্বপ্ন পরিপালনে অনেকে এখন বাড়িতে । হয়তো প্রকৃতির এই নির্মমতায় পরিবারের কটু কথা শুনতে হচ্ছে না।পাড়ার চায়ের দোকানে কম ভীড়ে বেকার ছেলেটির সমালোচনা দখলে নিয়েছে করোনা। এই যাত্রায় ছাড় পেলেও সমালোচনার যে দীর্ঘ পথ। এর আগামাথা নেই। গ্রাম মহল্লার যত জ্ঞানী বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সরব উপস্থিতিতে এসব সমালোচনা আদিকাল থেকে চলছে এবং চা দোকান থাকা পর্যন্ত চলবে।এসব চায়ের দোকানের বিরুদ্ধে তরুণেরা একশন নিতে পারে কিন্তু কেমনে নেবে সকাল বিকেল সন্ধ্যায় এই দোকানের চা সিগারেট না খেলে তো তাদের  ঝিমুনি যায় না। এলাকায় সব ছেলেই যথেষ্ট ভদ্র।শেষে শহরের দোকানের কথা বলেছি। এই দুর্যোগে বইটি হাতে নিয়ে হয়তো অনেক বেকার জানালার ওপাশে তার গন্তব্যের ঠিকানা খুঁজে। গভীর রজনীতে বালিশে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে সকালে সবার অগোচরে নিজেকে স্বাভাবিক করে নতুন দিন শুরু করে। হয়তো করোনার এই দুঃসময়ে অনেক বেকার এভাবেই লিখছে তাদের দিনলিপি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের শিক্ষক ইতোমধ্যে তাদের বিভাগের অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছেন। সরকার বিশেষ ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু বেকারেরা বরাবরই পরিত্যাজ্য, অসহায়। একটি পজিশন হোল্ড করার আগ পর্যন্ত সবার জন্য বোঝা, করুণার পাত্র। বেকারদের কেউ নেই। সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাস নতুন বেকার তৈরি করছে।আমেরিকায় ২ এপ্রিল পর্যন্ত বেকার ভাতা চেয়ে প্রায় ৬৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ আবেদন করেছে। অথচ ২ সপ্তাহ আগেও এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২ লাখ ৮১ হাজারের মতো।এই ঢেউ বাংলাদেশেও লাগছে করোনার ভয়াল গ্রাসে অনেকে চাকরি হারিয়ে নতুন করে বেকারে পরিণত হবেন। এতে প্রলম্বিত হবে বেকার জীবন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল