তারাবিহ নামাজের ইতিহাস ও তারাবিহ'র রাকাত সংখ্যা

#মো.আবু রায়হান 
তারাবিহ নামাজ রমজান মাসে আদায় করা হয়ে থাকে। রমজানে রাতে এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নত নামাজের পর এবং বেতর নামাজের আগে দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয় তা তারাবিহ নামাজ। মূলত তারাবিহ বলতে কোনো নামাজের নাম  হাদিস গ্রন্থে পাওয়া যায় না। তারাবিহ নামে আখ্যায়িত হওয়ার কারণ মাঝখানের বিরতিগুলো। ২০ রাকাত নামাজ আদায় করতে গিয়ে প্রতি চার রাকাতের পর কিছু সময় বিশ্রাম নেয়ার রীতি ছিল। কেননা এই নামাজ আদায় করা হয় দীর্ঘ সময় ধরে। তবে নবী করিম (সা.) রমজানে কিয়ামুল লাইল বা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগির বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন এবং এ জন্য অশেষ ছোয়াবের সুসংবাদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) রমজানের রাত গুলোতে ইবাদত করার জন্য আমাদের উৎসাহ দিতেন। কিন্তু জোরালো আদেশ দিতেন না। তিনি বলতেন, "যে ব্যক্তি রমজানে ঈমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে কিয়াম করবে, তার ইতঃপূর্বেকার সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।"
তারাবিহ শব্দটি আরবি একবচন ,বহুবচনে  তারবিহাতুন। শব্দটির মূল ধাতু রাহাতুন অর্থ আরাম বা বিশ্রাম করা, অর্থ বসা,আরাম করা। তারাবিহ নামাজ পড়াকালে প্রতি দুই রাকাত বা চার রাকাত পরপর বিশ্রাম করার জন্য একটু বসার নামই তারাবিহ। দীর্ঘ নামাজের কঠোর পরিশ্রম লাঘবের জন্য প্রতি দুই রাকাত, বিশেষ করে প্রতি চার রাকাত পর একটু বসে বিশ্রাম করে দোয়া ও তসবিহ পাঠ করতে হয় বলে এ নামাজকে সালাতুত তারাবিহ বা তারাবি নামাজ বলা হয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে তারাবিহ নামাজ পড়েছেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে পড়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তারাবিহ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা ও কুরআন খতম করা অধিক ছোয়াবের কাজ। তবে ঘরে সূরা-কেরাতের মাধ্যমে আদায় করলেও ছোয়াব পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তারাবিহ নামাজের জন্য রাতের কোনো বিশেষ সময়কে নির্দিষ্ট করে দেননি। তবে তারাবিহ নামাজ অবশ্যই এশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের পূর্ব সময়ের মধ্যে আদায় করা হয়।রাসুলুল্লাহ (সা.) বেশির ভাগ সময় রাতের শেষাংশে তারাবি আদায় করতেন এবং প্রথমাংশে বিশ্রাম নিতেন। তিনি কখনো আট রাকাত, কখনো ১৬ রাকাত, আবার কখনো ২০ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় করেছেন। তারাবিহর নামাজের রাকাত নির্দিষ্ট করা হয়নি। হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি ফিকহের অনুসারীগণ ২০ রাকাত, মালিকি ফিকহের অনুসারীগণ ৩৬ রাকাত এবং আহলে হাদিসের অনুসারীরা ৮ রাকাত তারাবিহ পড়ে থাকেন। 
রাসুল (সা.) বিশেষ কারণবশত নিয়মিত ২০ রাকাত তারাবিহ পড়তেন না। কেননা, রাসুল (সা.) কোনো কাজ নিয়মিত করলে তা উম্মতের জন্য ওয়াজিব তথা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়। এ করুণা দৃষ্টির কারণে তিনি তাঁর আমলে প্রতিনিয়ত ২০ রাকাত পূর্ণ তারাবিহ জামাত হতে দেননি। যে কারণে তারাবিহর নামাজ সুন্নত, ওয়াজিব নয়।তবে সুন্নতে মুয়াক্কাদা বা জরুরি সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা তারাবিহ নামাজ একা আদায় করলেও  মাত্র চার রাত তারাবিহ নামাজ জামাতে পড়েছিলেন,  কারণ যদি তিনি নিয়মিত জামাতে তারাবিহ'র নামাজ আদায় করেন, তাহলে তাঁর উম্মতেরা ভাববেন যে হয়তো এ তারাবিহ নামাজ আদায় করা ফরজ। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রাসুল (সা.) দুই রাতে ২০ রাকাত করে তারাবিহ নামাজ পড়িয়েছেন। তৃতীয় রাতে লোকজন জমা হলেও রাসুল (সা.) উপস্থিত হননি। পরদিন সকালে তিনি এরশাদ করলেন, ‘আমি তোমাদের ওপর তারাবিহ নামাজ ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাবোধ করেছি। তখন তা তোমাদের জন্য কষ্টকর হবে।’ তাই দৈহিক বা মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ২০ রাকাত অথবা কমপক্ষে ৮ রাকাত তারাবির সুন্নত নামাজ পড়ার সুযোগ রয়েছে।যদিও আট রাকাত নামাজ পড়া নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। ১২৮৪ হিজরিতে ভারতের আকবরাবাদ থেকে সর্বপ্রথম এক আহলে হাদিসের মাওলানা সাহেব আট রাকাত তারাবীর ফাতোয়া প্রদান করেন। এরপর ১২৮৫ হিজরিতে পাঞ্জাব সীমান্তে মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী আট রাকাত তারাবিহ নামায পড়া সুন্নত হওয়ার দাবি করেন।
১৩৭৭ হিজরিতে আরবে শায়েখ নসীব রেফায়ী ও শায়েখ নাসীরুদ্দীন আলবানী (র.) সর্বপ্রথম আট রাকাত তারাবিহ'র মত প্রকাশ করেন। তখন শায়েখ আতিয়্যা সালিমসহ আরবের জমহুর উলামায়ে কেরাম তাদের উক্ত রায়কে প্রত্যাখ্যান করেন।২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ হওয়ার সপক্ষে দলিল সহিহ হাদিসে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করিম (সা.) রমজান মাসে বিনা জামাতে একাকী ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ আদায় করতেন, অতঃপর বেতর নামাজ পড়তেন।’ (বায়হাকি)।
 রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম বিশ রাকাতের শিক্ষা পেয়েছেন। আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খেলাফতকাল থেকে অবিচ্ছিন্ন কর্মধারায় এখন পর্যন্ত মক্কা শরিফের মসজিদুল হারাম ও মদিনা শরিফের মসজিদে নববীসহ সকল মসজিদে ২০ রাকাত তারাবিহ পড়া হয়।হযরত সায়েব বলেন, হযরত ওমর রাঃ এর সময়কালে বিশ রাকাত তারাবীহ ছিল। (ফাতহুল বারী-৪/৪৩৬} যার সনদ বুখারীতে দুই স্থানে আছে)রাসুল (সা.)'র ওফাতের পর তারাবিহ নামাজ ওয়াজিব হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আর থাকেনি। প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর (রা.) ও দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)'র খেলাফত কালেও তারাবিহ নামাজ ২০ রাকাত পড়া হতো।
ইবনে শিহাব যুহরি (র.) বলেন, রাসুলুল্লাহ(সা.)'র ওফাতের পরও তারাবিহ'র অবস্থা এরুপ ই ছিল। আবু বকর সিদ্দিক(রা.)'র খেলাফত কালে এবং ওমর ইবনে খাত্তাব(রা.)'র খেলাফতের প্রথম দিকেও তারাবিহ'র অবস্থা অনুরুপ ই ছিল।তারাবিহ নামাজের বর্তমান নিয়মটি চালু হয়েছে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর  (রা.) সময় থেকে। এর আগে অর্থাৎ রাসূলে পাক সা. ও হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর সময়ে এমনকি হযরত ওমর ফারুক (রা.)'র খেলাফত কালের প্রথম দিকে মুসলমানেরা রমজানের রাত গুলোতে এশার নামাজের পর তারাবিহ নামাজ একাকী আদায় করতেন।
হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববিতে সাহাবিদের খণ্ড খণ্ড জামাতে ও একাকী তারাবির নামাজ পড়তে দেখে সবাই মিলে এক জামাতে তারাবিহ পড়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
হযরত ওমর ফারুক (রা.)'র সময়ে জামাতের সঙ্গে সালাতুত তারাবিহ চালু হওয়া সম্পর্কে একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন আবদুর রহমান ইবনে সায়েব ইবনে আবদুল কারি নামে এক তাবেয়ি। তিনি বলেন, রমজানের এক রাতে হযরত ওমর ফারুক (রা)'র সঙ্গে আমি মসজিদে নববীতে গেলাম। দেখলাম লোকেরা বিক্ষিপ্তভাবে ইবাদত করছে। কেউ একাকী, আবার কারো সঙ্গে কয়েকজন যোগ দিয়ে নফল নামাজ আদায় করছেন। হযরত ওমর রা. বললেন, এদের সবাইকে একজন তিলাওয়াতকারীর পেছনে একত্র করে দিলে ভালো হতো। পরে হযরত উবাই ইবনে কা’বকে ইমাম নিযুক্ত করা হয়। কেননা হযরত উবাই রা. ছিলেন সাহাবিদের মধ্যে সবচেয়ে শুদ্ধ ও মধুর কণ্ঠে কুরআন  তিলাওয়াতকারী। এরপর এক দিন আবারো বের হলেন হযরত ওমর (রা.)। বর্ণনাকারী আবদুর রহমান বলেন, হযরত উবাই (রা.)'র ইমামতিতে তখন এই নামাজ চলছে। পরিবেশটি দেখে হজরত ওমর মুগ্ধ হলেন এবং বললেন, চমৎকার আবিষ্কার এটি।হযরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে সাহাবিদের ইজমা দ্বারা মূলত রমজান মাসের মধ্যে ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার রীতির প্রচলন হয়।এ জন্য হযরত ওমর (রা.) এর সময় থেকে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে রমজান মাসে সিয়াম সাধনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে তারাবিহ'র জামাতে নামাজ আদায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ