সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হযরত দাউদ (আ.) তালুত বনাম অত্যাচারী শাসক জালুতের যুদ্ধ


আল কুরআনে আল্লাহ পাক আলোচ্য কাহিনী রাসুল্ কে জানিয়ে দিয়েছেন, যা তিনি কখনো কারো কাছে পড়েননি, কারো কাছে শোনেননি কিংবা তিনি নিজেও সেসব ঘটনা দেখেননি; আর সে সময় তথ্যপ্রযুক্তিরও যুগ ছিল না যে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ধারণকৃত দৃশ্য তিনি দেখে বলছেন, তাও নয়। বরং এ ঘটনা স্বয়ং আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন, যা সত্যিই বিস্ময়।দাউদ বাইবেলে যাকে ডেভিড নামে অভিহিত করা হয়েছে। বাইবেলের পুরানো নিয়মে (ওল্ড টেস্টামেন্ট) দাউদ(আ.) কে বলা হয়েছে সেন্ট লুইস ডেভিড।বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে, তিনি ছিলেন একজন ইসরায়েল রাজতন্ত্রের দ্বিতীয় রাজা এবং বাইবেলের নূতন নিয়ম অনুসারে গালাতীয়দের প্রতি পত্র ও লূকলিখিত সুসমাচার মতে যীশুর পুর্বপুরুষ ইয়াকুবের পুত্র, ইয়াহুদার অধস্তন বংশধর । তার পিতার নাম জেসি।তার পিতামাতার অনেক পুত্র সন্তানের মধ্যে দাউদ ছিলেন পিতার কনিষ্ঠ সন্তান।বাইবেলের বিবরণে, ডেভিড একজন অল্প বয়সী মেষপালক ছিলেন, যিনি প্রথম একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং গলিয়াত দ্বারা মৃত্যুবরণ করেন। ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রথম রাজা ছিলেন তালুত, যাকে বাইবেলে বলে সল (Saul)।দাউদ রাজা সল প্রিয় ছিলেন এবং সলের ছেলে যোনাথনের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। হযরত দাউদ (আ.) বনী ইসরাইলীদের দ্বাদশ গোত্রের মধ্যে ইয়াহুদার বংশের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, ওহাব ইবনে মুনাব্বেহ-এর মাধ্যমে হযরত দাউদের চেহারা গঠনের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি বেটে,ক্ষুদ্রাকৃতি,নীল চোখ, দেহে অতি অল্প পরিমাণ লোম ছিল। পূর্বে বনী ইসরাইলের এক বংশের কাছে ছিল শাসন ক্ষমতা আর অন্য বংশের কাছে ছিল নবুয়ত। হযরত দাউদ (আ.) প্রথম দুটোই একসাথে পান। তিনি মহান আল্লাহর নবীও ছিলেন, আবার বাদশাহও ছিলেন।তার বাদশাহি পাওয়া নিয়ে পবিত্র কুরআনে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। সুরা আল বাকারার ২৪৬-২৫১ নং আয়াতে ঘটনাটি উল্লেখ আছে।
বেথেলহেমের জেসির ছোট ছেলে দাউদ তালুতের সেনাবাহিনী থেকে ফিলিস্তিনের জালুত (গোলায়াথ)কে পরাজিত করে একক যুদ্ধে এবং তখনই সকলের নজরে আসে। কালক্রমে তিনি ইসরাইলের জনপ্রিয় বাদশাহ হন হযরত দাউদ,চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হন । হযরত দাউদ হযরত মুসা(আ.)-এর শরীয়তকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন।যাবুর কিতাবটি মহান আল্লাহর প্রশংসায় ভরপুর ছিল। হযরত দাউদের(আ.) গলায় মহান আল্লাহ যাদুর সুর দান করেছিলেন যে, তেলাওয়াতের সময় মানুষ তো অবশ্যই পাখি,জীব-জন্তু পর্যন্ত অভিভূত হয়ে যেত।যাবুর শব্দের অর্থ পারা বা খন্ড। মহান আল্লাহর দয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রস্তুতি কম/বেশি যাই থাকুক না কেন, সাফল্য সবসময় তার পক্ষেই থাকতো। সুতরাং অল্প সময়ের মধ্যে তার সাম্রাজ্য সিরিয়া,ইরাক,ফিলিস্তিন এবং পূর্ব জর্ডানের সমস্ত এলাকা তার অধীনে এসে যায়।হেজাযের কিছু অংশ তার নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রজাদের তার সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, যেকোন জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবার মত ক্ষমতা তার আছে।তার পুত্র সলোমন বা সুলায়মান (আ.) তার রাজ্যকে আরো প্রসারিত করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন টেম্পল অফ সলোমন বা বায়তুল মুকাদ্দাস।খ্রিস্টপূর্ব এগার শতক আগের কথা ।বানী-ইস্রাঈল মূসা (আঃ)-এর পর কিছুকাল পর্যন্ত সঠিক পথেই ছিল। তারপর তাদের মধ্যে বিমুখতা এল। দ্বীনে নতুন নতুন বিদআত আবিষ্কার করল। এমন কি মূর্তিপূজাও আরম্ভ করে দিল। নবীগণ তাদেরকে বাধা দিলেন, কিন্তু তারা অবাধ্যতা ও শিরক থেকে বিরত হল না। ফলে আল্লাহ তাদের শত্রুদেরকে তাদের উপর আধিপত্য দান করলেন। তারা ওদের অঞ্চল ওদের কাছ থেকে কেড়ে নিল এবং ওদের মধ্য থেকে বহু সংখ্যক মানুষকে বন্দী করল। তাদের মধ্যে নবী আগমনের ধারাবাহিকতাও বন্ধ হয়ে গেল। শেষে কিছু লোকের দোয়া শামাউন নবী (আ.) জন্ম লাভ করলেন। তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করলেন। তারা নবীর কাছে দাবী পেশ করল যে, আমাদের জন্য একজন বাদশাহ নির্বাচিত করে দিন; আমরা তার নেতৃত্বে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।আল্লাহ পাক বলেন, তুমি কি মূসার পরবর্তী বনী-ইস্রাঈল প্রধানদের দেখনি? যখন তারা নিজেদের নবীকে বলেছিল, ‘আমাদের জন্য একজন রাজা নিযুক্ত কর, যাতে আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি।’ সে বলল, ‘বোধ হয় যদি তোমাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেওয়া হয়, তাহলে তোমরা তা করবে না?’ তারা বলল, ‘আমরা যখন আপন ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছি, তখন আল্লাহর পথে যুদ্ধ করব না কেন?’ অতঃপর যখন তাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেওয়া হল, তখন তাদের স্বল্পসংখ্যক ব্যতীত অধিকাংশই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল। আর আল্লাহ অপরাধিগণ সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। (সুরা বাকারাহ আয়াত-২৪৬)।বনি ইসরাইলের নবি হযরত শামাউন তালুতকে বাদশাহ নির্বাচন করেন। তালুত বাদশাহ নির্বাচিত হওয়ার সত্যের পক্ষে অত্যাচারী শাসক জালুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তালুত ছিলেন ইউসুফ (আ)এর কনিষ্ঠ ভ্রাতা বেনজামিনের বংশোদ্ভুত। তিনি দরিদ্র ও সাধারণ একজন সৈনিক ছিলেন। তাই তারা অভিযোগ করল। নবী বললেন, এটা তো আমার নির্বাচন নয়, বরং মহান আল্লাহ তাঁকে নির্বাচন করেছেন। তাছাড়া নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব করার জন্য সম্পদের চেয়ে জ্ঞান-বুদ্ধি ও দৈহিক শক্তির প্রয়োজন বেশী এবং এতে (জ্ঞান-বুদ্ধি ও দৈহিক শক্তিতে) তিনি তোমাদের সবার ঊর্ধ্বে। আর এই কারণেই মহান আল্লাহ তাঁকে এই পদের জন্য মনোনীত করে নিয়েছেন। তিনি বড়ই অনুগ্রহশীল। তিনি যাকে ইচ্ছা স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহদানে ধন্য করেন। তিনি সর্ব বিষয়ে অবগত। অর্থাৎ, তিনি জানেন যে, রাজত্ব পাওয়ার কে যোগ্য এবং কে অযোগ্য। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্তুতি শুরু করলেন। অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাঊদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর।আল্লাহ বলেন,অতঃপর তালূত যখন সৈন্যদলসহ বের হল, তখন সে বলল, ‘আল্লাহ একটি নদী দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন। অতএব যে কেউ উক্ত নদী থেকে পানি পান করবে, সে আমার দলভুক্ত নয় এবং যে ঐ পানি পান করবে না, সে আমার দলভুক্ত। অবশ্য যে কেউ তার হাত দিয়ে এক আঁজলা পানি পান করবে সে-ও (আমার দলভুক্ত)।’ কিন্তু (যখন তারা নদীর কাছে হাজির হল, তখন) তাদের অল্প সংখ্যক ব্যতীত অধিকাংশ লোকই তা থেকে পানি পান করল।অতঃপর যখন সে (ত্বালূত) ও তার প্রতি বিশ্বাসস্থাপনকারিগণ তা (নদী) অতিক্রম করল, তখন তারা বলল, ‘আমাদের শক্তি ও সাধ্য নেই যে, আজ জালূত ও তার সৈন্য-সামন্তের সাথে যুদ্ধ করি। কিন্তু যাদের প্রত্যয় ছিল যে, আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ ঘটবে, তারা বলল, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাজিত করেছে! আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।(সুরা বাকারাহ আয়াত -২৪৯)।এই নদীটি জর্ডান ও প্যালেষ্টাইনের মধ্যবর্তী এলাকায়। নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর যুদ্ধকালে যুদ্ধরত সাহাবিগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাযারো সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে। বস্তুতবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই ছিলেন দাঊদ।"আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর।"( বাক্বারাহ আয়াত-২৫০)। ।তাফসিরে রুহুল-মা'আনিতে ইবনে আবি হাতেমের বরাত দিয়ে হজরত ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েতের উদ্ধৃতিতে ঘটনার যে পরিণতি বর্ণিত হয়েছে, তাতে বোঝা যায়, এতে তিন ধরনের লোক ছিল। একদল অসম্পূর্ণ ইমানদার, যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। দ্বিতীয় দল পূর্ণ ইমানদার, যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ঠিকই; কিন্তু নিজেদের সংখ্যা কম বলে চিন্তা করেছে এবং তৃতীয় দল ছিল পরিপূর্ণ ইমানদার, যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে এবং নিজেদের সংখ্যালঘিষ্ঠতার কথাও চিন্তা করেনি। (সে জন্যই আল্লাহ পাক ধৈর্যশীল ইমানদারের সঙ্গেই রয়েছেন বলে অঙ্গীকার করেছেন।) যারা আল্লাহর সাহায্যে পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরা বললেন, সফলতা সংখ্যার আধিক্যের এবং অস্ত্র-শস্ত্রের প্রাচুর্যের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং তা আল্লাহর ইচ্ছা এবং তাঁর নির্দেশের উপর নির্ভর করে। আর আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য জরুরী হল ধৈর্যের প্রতি যত্ন নেওয়া।
জালূত সেই শত্রুদলের সেনাপতি ও দলনেতা ছিল, যাদের সাথে ত্বালূত ও তাঁর সঙ্গীদের সংঘর্ষ ছিল। এরা ছিল আমালেক্বা জাতি।সেই সময়ে এই জাতি বড় দুর্ধর্ষ যুদ্ধ-বিশারদ এবং বীর নামে প্রসিদ্ধ ছিল। তাদের এই প্রসিদ্ধির কারণে ঠিক যুদ্ধের সময় ঈমানদারগণ আল্লাহর নিকট ধৈর্য ও সুদৃঢ় থাকার তওফীক চেয়ে এবং কুফরীর মোকাবেলায় ঈমানের সফলতার জন্য দোয়া করেন। অর্থাৎ, (যুদ্ধের) পার্থিব উপকরণাদি গ্রহণ করার সাথে সাথে ঈমানদারদের জন্য অত্যাবশ্যক হল, এ রকম পরিস্থিতিতে আল্লাহর নিকট বিশেষভাবে প্রার্থনা করা। যেমন, বদরের যুদ্ধে নবী করীম (সাঃ) অত্যধিক কাকুতি-মিনতির সাথে বিজয় ও সাহায্য চেয়ে দোয়া করেছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর সে দোয়া কবুল করেছিলেন। ফলে অতীব অল্প সংখ্যক মুসলিম দল অধিক সংখ্যক কাফের দলের উপর জয় লাভ করেছিল।
তালুতের সেনাদলে দাউদ (আ.)-এর বড় ভাইয়েরা অংশ নেয়। দাউদ (আ.)-এর বয়স তখন খুবই কম। তাই তিনি তালুতের সেনাদলে যোগ দিতে পারলেন না। তবে একদিন তাঁর সেই সুযোগ অনায়াসে এসে গেল। দাউদ (আ.)-এর পিতা তাঁকে ভাইদের খবর নিতে পাঠালেন।হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম যখন রওয়ানা হন, তখন পথে তিনটি পাথরকে আল্লাহ তাআলা কথা বলার শক্তি প্রদান করেন। পাথর বালক দাউদ আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলে যে, ‘আমাদেরকে ওঠিয়ে নাও; কারণ তুমি আমাদের দ্বারাই জালুতকে হত্যা করবে।তাই বালক দাউদ পাথরগুলো সঙ্গে নিয়ে নেন।দাউদ (আ.) যুদ্ধেেত্র গিয়ে ভাইদের খোঁজছেন। এমন সময় তাঁর কানে এক লোকের ডাকার শব্দ ভেসে এল। লোকটি বনী-ইসরাইলীদের ডেকে বলছেন, ‘কে আছ পাহলোয়ান, যে একা আমার সাথে লড়বে? আমি ওয়াদা করছি, আমি যদি হেরে যাই তা হলে আমাদের দলের সবাই তোমাদের গোলাম হবে। আর যদি তোমার লোক হারে, তবে তোমরা আমাদের গোলাম হবে।’বালক দাউদ (আ.) লোকটির খোঁজ নিলেন। নাম তার জালুত। কাফেরদের সেনাপতি। প্রায় দুটো মানুষের সমান লম্বা এই কাফের নেতা। শুধু লম্বা কেন, জালুত ছিলেন বিশালদেহী একটা আস্ত দৈত্য। প্যালেস্টাইনের বাসিন্দা এই সেনাপতি খ্যাতনামা যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। ভয়ঙ্কর প্রকৃতির এই সেনাপতি জালুতের সাথে একা লড়াই করার সাহস কারো ছিল না। তিনি চল্লিশ দিন ধরে এভাবে লড়াইয়ের জন্য ডেকেছেন, কিন্তু কোন বনী ইসরাইলী তার সাথে লড়তে এগিয়ে আসল না।
হযরত দাউদ (আ.) এগিয়ে গেলেন। প্রথমে বাদশাহ তালুতকে এসে বললেন, ‘রাজা মশায়! আমি জালুতের সাথে লড়তে চাই। আমাকে অনুমতি দিন।’দাউদ (আ.) তখন ছোট্ট বালক। সে নাকি জালুতের সাথে লড়বে! বালকের কথা শুনে বাদশাহ আশ্চর্য হলেন। বলে কী ছেলেটা? বাদশাহর কাছে দাউদ (আ.)-এর কথা বিশ্বাস হল না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে?’‘আমার নাম দাউদ। আমার বড় ভাইয়েরা আপনার ফৌজে ভর্তি হয়েছেন। বাবা আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। ভাইদের খবর নিতে এসেছি।রাজা বললেন, ‘তুমি নিতান্ত ছেলেমানুষ। জালুত সাহসী এবং ভয়ঙ্কর লোক। তার সাথে লড়াই করা অত্যন্ত কঠিন ও বিপদজনক। বড় বড় পাহলোয়ানরা যেখানে সাহস পাচ্ছে না, আর তুমি লড়বে জালুতের সাথে? তুমি কী ভেবে দেখেছ, কী বলছ তুমি?’
হযরত বললেন, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ সহায় হলে আমি নিশ্চয়ই জালুতকে মারতে পারব।’
বালকটির কথা তালুতের মোটেও বিশ্বাস হল না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে ছোকরা! তুমি কী কখনও লড়াই করেছ?’‘না, করিনি। তবে আমি একদিন মেষ চড়াতে মাঠে গিয়েছিলাম। এমন সময় হঠাৎ একটা সিংহ এবং ভালুক এসে আমাদের মেষপালের মধ্যে পড়ল। আমি সিংহটার কেশ ধরে এক আছাড় মারলাম, আর ভালুককে দিলাম এক থাপ্পড়। এতে সিংহ ও ভালুক দুটোই মারা গেল। আমার আস্থা, যিনি শক্তিশালী ও হিংস্র সিংহ ও ভালুকের হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছেন, তিনি জালুতের হাত থেকেও আমাকে রা করবেন।’দাউদ (আ.)-এর কথার এরূপ দৃঢ়তা, মনের সাহস ও বিশ্বাস দেখে বাদশাহ তালুত মুগ্ধ হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বালকটি সাধারণ কেউ নয়। আশ্চর্য বালক সে। অবশ্যই তাঁর ওপর আল্লাহপাকের বিশেষ অনুগ্রহ আছে। তাই তিনি দাউদকে জালুতের সাথে লড়াই করার অনুমতি দিলেন।তালুত হযরত দাউদকে একটি ঘোড়া, একটি লৌহ বর্ম ও একটি তরবারি দিতে চাইলে তিনি তা গ্রহণ না করে বললেন, ‘যদি আল্লাহ তাআলা আমাকে সাহায্য না করেন তবে এ সব বস্তু আমার কোনো কাজে আসবে না। এ জন্য তিনি ওই সব বস্তু সেখানেই রেখে দিলেন এবং ঐ পাথরগুলো নিয়ে দুশমনের দিকে অগ্রসর হলেন।
হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম বেঁটে এবং অসুস্থ ছিলেন। তাঁর বর্ণ ছিল হলুদ। শক্তিশালী জালুত যখন তাকে দেখলেন, তখন বললেন, তুমি কি আমাকে হত্যার জন্য পাথর নিয়ে এসেছ? যেমন মানুষ কুকুরকে পাথর দ্বারা মারে।হযরত দাউদ বললেন, ‘হ্যাঁ’, তুমি তো কুকুরের চেয়ে নিকৃষ্ট। অতঃপর তিনি বিসমি এলাহি, ইবরাহিমা ওয়া ইসহাকা ওয়া ইয়াকুব’ বলে তিনটি পাথর একসঙ্গে জালুতের কপাল লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করেন। এতে জালুত নিহত হয়।দাঊদ (আ) তখন না নবী ছিলেন, না রাজা। বরং ত্বালূতের সৈন্যদলের একজন সাধারণ সৈনিক ছিলেন। তাঁরই হাতে মহান আল্লাহ জালূতকে ধ্বংস করলেন এবং অল্প সংখ্যক ঈমানদার দ্বারা বিশাল এক জাতিকে জঘন্যভাবে পরাজিত করলেন।এর পর মহান আল্লাহ দাঊদ (আঃ)-কে রাজত্বও দিলেন এবং নবুঅতও। ‘হিকমত’ বলতে কেউ বলেছেন, নবুঅত। কেউ বলেছেন, লোহার কারিগরী এবং কেউ বলেছেন, যুদ্ধ সম্বন্ধীয় বিষয়ের এমন পারদর্শিতা, যা আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত স্থানে বড় নিষ্পত্তিকর সাব্যস্ত হয়েছিল। এখানে আল্লাহর এক নিয়মের কথা বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি একদল মানুষের মাধ্যমেই অপর একদল মানুষের যুলুম-অত্যাচার ও ক্ষমতা নিশ্চিহ্ন করে থাকেন। তিনি যদি এ রকম না করে কোন একই পক্ষকে সব সময়ের জন্য ক্ষমতা ও এখতিয়ার দিয়ে রাখতেন, তাহলে এ পৃথিবী যুলুম-অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। কাজেই আল্লাহর এই নিয়ম বিশ্ববাসীর জন্য তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের একটি দৃষ্টান্ত।
দাউদ (আ.)-এর অনেক গুণ ছিল। তিনি একজন দক্ষ কর্মকার ছিলেন।শক্ত লোহাকে হাতে নিয়ে গলাতে তিনি ছিলেন দক্ষ। এ কারণে সহজেই তিনি অস্ত্র বানাতে পারতেন। তবে এসব অস্ত্র তিনি অন্যায় কাজে প্রয়োগ করতেন না। সত্যের পথে লড়াই করার কাজে তিনি অস্ত্র ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অসাধারণ মিষ্টি। এমন সুমধুর কণ্ঠ আর কারো ছিল না। তিনি সকাল ও সন্ধ্যায় মধুর সুরে আল্লাহর প্রশংসা কীর্তন করতেন। এ সময় সমস্ত সৃষ্টিজগৎ তাঁর সাথে জোরে জোরে আল্লাহর প্রশংসায় মেতে উঠত। দাউদ (আ.) পাখির ভাষাও বুঝতে পারতেন।

গ্রন্থনায়-মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...