সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

যুগেযুগে যত মহামারি ও জীবনহানি


মো. আবু রায়হান:
Image result for মহামারিকরোনা ভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্ব যখন আতঙ্কিত তখন নতুন করে আলোচনায় আসছে অতীতের মহামরি ও সেগুলোর ধ্বংসাত্মক প্রভাব।গত শতাব্দীর দুটো বিশ্বযুদ্ধসহ, পারমানবিক বোমা, ইন্টারনেট, ফরমালিন, প্রযুক্তি, হাইব্রিড খাদ্য,  ইত্যাদি বিশ্বকে করে রেখেছে মৃত্যুপুরী। বন্যা, খরা, অগ্নুৎপাত,ভূকম্পন, সাইক্লোন,মহামারি পৃথিবীকে করছে বিপর্যস্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ২০১১-২০১৭ এই সাত বছরে বিশ্ব ব্যাপি ১৩০৭ টি মহামারির মতো ঘটনা ঘটেছে।ভূতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেছেন ১০০ বছর পর পর প্রকৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়।পৃথিবীর ভূঅভ্যন্তরে আছে বিশালাকার প্লেট, যা প্রাকৃতিক নিয়মে অবিরত নড়াচড়া করছে।বলা হচ্ছে প্রতি ১০০ বছর পর পর তাদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করছে, গ্রামকে গ্রাম উজার হচ্ছে, নগরসভ্যতা হারিয়ে যাচ্ছে মহামারিতে। বিভিন্ন লিখিত রচনাতে আমরা এসব মহামারি ও মানব সভ্যতায় তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের নিদর্শন জানতে পারি।কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে অতীতে বিভিন্ন জাতির ধ্বংস ,এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে গ্রন্থে ঈশ্বরের শাস্তি হিসেবে মহামারির বিভিন্ন নিদর্শনের বর্ণনা পাই। আবার প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসবিদ থুকিডাইডিসের রচনাতেও মহামারির উল্লেখ পাওয়া।এসব মহামারি ভাইরাসবাহী রোগ। ভাইরাস হলো একপ্রকার অতিক্ষুদ্র জৈব কণা বা অণুজীব। ভাইরাস অর্থ বিষ।আদিতে যে কোন ধরনের বিষাক্ত পদার্থকে ভাইরাস বলা হতো।ভাইরাস আবিষ্কার এর বহু আগে এই মহামারিতে শতশত নগর সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যায়।পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম সভ্যতা মিসরীয় মমির গায়েও বসন্ত রোগের চিত্র পাওয়া গেছে। ইতিহাসের বহু পুরনো মিসরের ফারাওরা বিশ্বকে এক সময় শাসন করতো। তাদের ক্ষমতা ও বীরত্বে একসময় পুরো দুনিয়া কাঁপতো। তাদের হাতের মুঠোয় ছিল তৎকালীন মিসরীয় সভ্যতা। সেই ফারাও নামক নৃপতি গোষ্ঠী ধবংস হয়েছে গুটি বসন্তে।
থুকিডাইডিসের রচনা থেকে আমরা জানি, পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ যখন সংগঠিত হয়েছিলো গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে তখন টাইফাস মহামারিতে এথেন্সের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায়, যার কারণে স্পার্টার জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল।
একসময় দুনিয়ার বাতিঘর বলা হতো রোমকে। ১৬৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দ সেই রোম মাত্র ১৫ বছরে জনমানব শূন্য হয়ে যায় গুটি বসন্তের কারণে। সে সময় রোমকে বলা হতো ভূতের নগরী। এমন কি পুরো রোমে বাতি দেওয়ার মতো একজন মানুষও জীবিত ছিল না।রাজপরিবারের সদস্যরাও এর প্রকোপ থেকে রেহাই পাননি। বিখ্যাত রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের ভাই লুইসিয়াস ভেরাসও মারা যান।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ এ গ্রিসের ফুসফুস নামে খ্যাত এথেন্সে বসন্ত রোগে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, যা ছিল ওই নগরের ২০ শতাংশ মানুষ।বসন্ত রোগটি ভেরিওলা ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রামক এই রোগটি একজন মানুষের ত্বকের সাথে আরেকজনের স্পর্শে ছড়ায়। এমনকি বাতাসের মাধ্যমেও এই রোগ ছড়ায়।
যে রোমান সভ্যতার সে সময় চিকিৎসায় ব্যাপক সুনাম ছিল।২৫০ খ্রিষ্টাব্দে সাইপ্রিয়ানের প্লেগ মহামারী রোমান সাম্রাজ্যকে বিপর্যস্ত করে দেয়। এরপর, পঞ্চম শতাব্দীতে একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে এই মহামারি পরাক্রমশালী পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যকেই ধ্বংস করে দেয়। আবার ষষ্ঠ শতাব্দির প্রথমভাগে রোমান সাম্রাজ্যেও পূর্ব অংশের সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান , রোমান সাম্রাজ্যকে আবার আগের মত প্রতাপশালী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন, বিউবনিক প্লেগ মহামারিতে তার মৃত্যু সেই সম্ভাবনাকেও শেষ করে দেয়। পরবর্তীতে দুই শতাব্দীতে বিউবনিক প্লেগে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মারা যায়। এই রোগ মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ছড়ায়। ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর মহামারী বলা হয় একে। ।মানুষের মরা পচা দুর্গন্ধ বাতাস দূষিত হয়। পশুপাখি, কীট পতঙ্গ সব মারা যায়।

পঞ্চম শতকে ইরাক,ইরান তথা মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ মারা যায় প্লেগ রোগে।বলা হয় পার্সিয়ার অর্ধেক মানুষ মারা যায় এই রোগে।
৬০০ শতকের প্রথমার্ধে পুরো দুনিয়ায় ৪০%মানুষ মারা যায় প্লেগ রোগে ৭৩৫-৭৩৭ এই দুই বছরে শুধুমাত্র জাপানে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। একই সময় প্লেগ রোগে বাইজানটাইন সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়। ১৬ শতকে ম্যাক্সিকোতে ৮০%, ইতালিতে ৩ লক্ষ প্লেগ রোগে মারা যায়। দুনিয়াব্যাপী ফ্রক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড, অজানা রোগে ৯০% মানুষ মারা যায়। উনিশ শতকে তামাম দুনিয়া ইনফুয়েঞ্জা নাড়িয়ে দেয়।
১৩৩৪ সালে গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন হিসেবে স্বীকৃত প্লেগ আসে চীন থেকে। এরপর ইতালির ফ্লোরেন্স শহরেই ছয় মাসে প্লেগে মারা যায় ৯০ হাজার মানুষ।কয়েক বছরে এশিয়া ও ইউরোপে মারা যায় ৫ কোটি মানুষ। প্লেগ রোগটি মূলত একটি জীবাণুবাহী ভাইরাসের নাম। এর সৃষ্টি কোথা হতে তা সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি, তবে আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, ইঁদুরের খাদ্য ও প্রস্রাব থেকে এই রোগটি হয়েছে। এই রোগ সম্ভবত এশিয়ায় উৎপত্তি হয় এবং পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।মধ্য এশিয়া হতে বাণিজ্য বিস্তার সময় ইউরোপে জাহাজে ইঁদুরের মাধ্যমে গোটা ইউরোপ এ রোগ ছড়ায়। গ্রীনল্যান্ডের প্রতাপশালী ভাইকিং জলদস্যুরা এই মহামারির ফলে সমুদ্রে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়। গোটা ব্রিটেনের সামন্ত ব্যবস্থা এই প্লেগের কারণে বিপর্যস্ত হয় এবং নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শর্ত তৈরি হয়।ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৩০-৬০ ভাগ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই মহামারির কবলে পড়ে ১৪’শ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৫০-৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে।
পঞ্চদশ শতাব্দির শেষভাগে, ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে স্প্যানিশ বণিকেরা নিয়ে আসে ভয়ংকর স্মলপক্স, বিউবনিক প্লেগ ও হামের মত জীবাণু। ইউরোপিয়ানরা এইসব রোগ প্রতিরোধী হলেও ক্যারিবিয়ানের মানুষের শরীরে এই রোগের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিলো না। এর ফলে প্রায় ৯০ ভাগ আদিবাসী জনগোষ্ঠী এইসব রোগে মৃত্যুবরণ করেন।
১৫১৯ সালে বর্তমান মেক্সিকোতে স্মলপক্স ছড়িয়ে পড়লে দুই বছরে মারা যায় প্রায় ৮০ লাখ মানুষ।১৫২০ সালে ইউরোপিয়ানদের সাথে আসা একজন আফ্রিকান দাস স্মলপক্স নিয়ে আসলে গোটা এজটেক সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি।উপনিবেশিক শক্তি গোটা আমেরিকা মহাদেশে শুধু তরবারি দিয়েই হত্যা করেনি। রোগ বালাই নিয়ে এসেও মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দিতে ইউরোপিয়ানদের বয়ে আনা জীবাণুর কারণে আমেরিকা মহাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। আদিবাসীদের এই গণহারে মৃত্যু গোটা আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপিয়ানদের আধিপত্য করার সুযোগ করে দেয়।
১৬৩৩ সালে ফ্রান্স, গ্রেট বৃটেন ও নেদারল্যান্ডসবাসীদের মাধ্যমে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে স্পলপক্স ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায় বলে দাবি করেন ইতিহাসবিদরা।
১৬৬৫ সালের দিকে দি গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’-এ লন্ডনের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে সৈনিকদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতবর্ষ ছাড়াও স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি ও আমেরিকায় দেড়শ বছরের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ কলেরায় মারা যায়। ১৭৯৩ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় ইয়েলো ফিভার মহামারী আকার ধারণ করে। এতে নগরের ১০ ভাগের এক ভাগ, প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ মারা যায়।
১৮৫৫ সালের দিকে চীন, হংকং ও ভারতে প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্লেগে ভুগে মারা যান। ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া স্প্যানিশ ফ্লুতে পৃথিবীতে মারা যায় ৫ কোটি মানুষ। মহামারির এরকম বহুনিদর্শন পাওয়া যায় ইতিহাসে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে যুগে যুগে শত শত নগর সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে যেমন।তেমনি ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৭২০ সালে দুনিয়া জুড়ে ২০ কোটি মানুষ শুধু মাত্র প্লেগ রোগে মারা যায়। তার ১০০ বছর পর ১৮২০ সালে শুধুমাত্র ভারত ও পূর্ব এশিয়া কলেরা রোগে মারা যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। এবং আফ্রিকা ইউরোপে বসন্ত রোগে মারা যায় ৩৫ লক্ষ মানুষ। তারও ১০০ বছর পর ১৯২০ সালে দুনিয়া জুড়ে মারা যায় ৫ কোটি মানুষ। ১৮৬০ সালে আধুনিক যুগে প্লেগ ছড়ায় এতে চীন, ভারত ও হংকংয়ে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। পরে ১৮৯০ এর দশকে প্লেগের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হয়। বিশ শতকের সবচেয়ে বড় প্লেগ মহামারী দেখা দেয় ১৯১০ সালে। চীনের মাঞ্চুরিয়ায় দুই বছরে মারা যায় প্রায় ৬০ হাজার মানুষ।বিশ্বজুড়ে ১৯১৮ সালে গ্রেট ফ্লু মহামারী রূপ নেয়। এতে দুই বছরে সারা বিশ্বে মারা যায় ৩ কোটির বেশি মানুষ।
১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সাল সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। ভয়াবহ এই মহামারীকে তখন নাম দেওয়া হয় ‘‘স্প্যানিশ ফ্লু’’। এটি ‘দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক’ নামেও পরিচিত।গুটিবসন্ত বা স্মল পক্স ভ্যারিওলা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতো এবং এটি অত্যন্ত মারাত্মক এক ব্যাধি ছিল।গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৭৯৬ সালে। অথচ টিকা আবিষ্কারের প্রায় ২০০ বছর পরও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে ভারতে। ১৯৭০ সালে লক্ষাধিক মানুষ রাতারাতি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।১৯৭৫ সালেই ভারতকে গুটিবসন্ত মুক্ত ঘোষণা করা সম্ভব হয়। আমেরিকায় ১৯৫২ সালে পোলিওতে আক্রান্ত হয় প্রায় ৬০ হাজার শিশু, এতে তিন হাজারের বেশি মারা যায়।প্রথম এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত হয় ১৯৮৪ সালে। এই ভাইরাসের কারণে এইডস রোগে সে বছরই আমেরিকায় মারা যায় ৫,৫০০ জন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। আর এ পর্যন্ত এইডসে মারা গেছে আড়াই কোটির বেশি মানুষ ।
সার্স বা সিভিয়ার একিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম এ ২০০২ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৩ সালের জুলাইয়ের মাঝে ১৭টি দেশে ৭৭৪ মানুষের প্রাণ সংহার করেছিল।
বিশ্বজুড়ে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু বা এইচ ওয়ান এন ওয়ান ফ্লুতে ১৮,৫০০ জন মারা গেছে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ ৭৫ হাজার বলেও ধারণা করা হয়। হাইতিতে ২০১০ সালে ভয়ংকর এক ভূমিকম্পের পর কলেরা মহামারী রূপ নিলে ১০ হাজার মানুষ মারা যায়।
২০১২ সালে ভাইরাসজনিত রোগ হামে মারা যায় ১ লাখ ২২ হাজার মানুষ। সে বছর পুরো বিশ্বে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামক রোগ টিউবারকিউলোসিসে মারা যায় ১.৩ মিলিয়ন মানুষ। এছাড়া প্রতি বছর টাইফয়েড জ্বরে মারা যাচ্ছে ২ লাখ ১৬ হাজার মানুষ।

মার্স বা মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম ২০১২ সালে প্রথম সৌদি আরবে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয় এবং সেখানে আক্রান্তদের ৩৫শতাংশ মারা যায়। সৌদি আরব ছাড়াও এর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে ওমান, আরব আমিরাত, মিসর ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কটি দেশে। ধারণা করা হচ্ছে, মানবদেহে এই ভাইরাস এসেছে উট থেকে। কাতার, ওমান, সৌদি আরব ও মিসরে উটের রক্তেও মার্স ভাইরাসের অস্তিত্ব পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া সৌদি আরবে বাদুড়ের রক্তেও পাওয়া গেছে এই ভাইরাস। মানুষ থেকে মানুষে ভাইরাস ছড়িয়েছে হাঁচি, কাশি, নিকট অবস্থান ইত্যাদি থেকে।
নিপাহ ভাইরাস বাদুড় থেকে পশুপাখি ও মানুষের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় শূকরের মধ্যে প্রথম এ রোগ চিহ্নিত হওয়ার পর সেখানকার কৃষি শহর নিপাহ'র নামে ভাইরাসটির নামকরণ হয়েছে। পশুপাখি থেকে প্রায় তিনশ মানুষের এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে যার মধ্যে অন্তত একশ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ইবোলা ভাইরাসে সংক্রমিত হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যুই অবধারিত।১৯৭৬ সালে এ ভাইরাসের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়।ইবোলা ভাইরাসের পাঁচটি ভিন্ন নাম রয়েছে - ইবোলা-জায়ারে, ইবোলা-সুদান, ইবোলা-আইভোরি কোস্ট, ইবোলা-রেস্টন এবং ইবোলা-বুন্দিবুগিও। এ নামকরণগুলো ছড়িয়ে পড়া এলাকার নামানুসারে হয়েছে। ভয়ংকর এই ইবোলাভারাসে মৃত্যুহার ৫০ শতাংশের মতো।পশ্চিম আফ্রিকায় ২০১৪ সালে ইবোলা জ্বরে মারা যায় অন্তত ১১,৩০০ জন।
জিকা ভাইরাস উগান্ডার জিকা ফরেস্ট এলাকায় বানরের মধ্যে ১৯৪৭ সালে এটি আবিষ্কৃত হয়। তবে আফ্রিকা ও এশিয়ায় এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। মশার মাধ্যমে দ্রুত এ ভাইরাসটি ছড়ায়। ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটেছে এমন কোনো রোগীকে এডিস মশা কামড়ানোর মধ্য দিয়ে এর স্থানান্তর হয়। পরে ওই মশাটি অন্য ব্যক্তিদের কামড় দিলে তা ছড়াতে থাকে। এরপর ওই ব্যক্তিদের মাধ্যমেই ভাইরাসটির বিস্তার ঘটতে থাকে।
ডেঙ্গু ২০১৯ সালে এশিয়ার কয়েকটি দেশে এডিস মশা বাহিত রোগ ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। ফিলিপাইনে প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশের মতো থাইল্যান্ড,ফিলিপাইন, মালয়েশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু।
এখন আমরা ২০২০ সালে অবস্থান করছি। করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়।করোনা ভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ মুকুট।প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়।
মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনা ভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনা ভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়।এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে ‘নোভেল করোনাভাইরাস’। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস ঘিরে ক্রমেই ছড়াচ্ছে আতঙ্ক।২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রমণ দেখা দেয়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানবদেহে যে রোগ হয় তার নাম কোভিড-১৯।সর্বশেষ ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ১৯ হাজার ১৭৯ জন। বিশ্বের ১১৯ টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস।করোনা ভাইরাসে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা চার হাজার ২৯৫ জনে দাঁড়িয়েছে।তবে এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজার ৬১৭ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...