শহিদ নূর হোসেন মিলনরা ফিরে আসেন জাতির প্রয়োজনে

  

‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক ' এই স্লোগান বুকে ও পিঠে লিখে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায়  বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির একটি মিছিলে অংশ নেন নূর হোসেন। মিছিলটি ঢাকার গুলিস্তানের জিপিও-র সামনে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি আসলে স্বৈরশাসকের মদদপুষ্ট পুলিশবাহিনীর গুলিতে নূর হোসেন নিহত হন। সেদিন মোট তিনজন আন্দোলনকারী  নিহত ও অসংখ্য আন্দোলনকারী আহত হন। নিহত অপর দুই ব্যক্তি হলেন যুবলীগ নেতা নুরুল হূদা বাবুল এবং আমিনুল হূদা টিটু। নূর হোসেনরা সব সময় জন্ম গ্রহণ করেন না। জাতির দুর্দিনে প্রয়োজনে দুঃসময়ে তারা অবতারের মতো অবতীর্ণ হন  জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনে যেমন দুজন বাংলার দামাল ছেলে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ক্ষমতার মসনদে জেকে বসা স্বৈরশাসক এরশাদের পতনে দুজন সূর্য সন্তানের শাহাদত এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করেছিল।আমরা ইতিহাস থেকে জানি পাকিস্তান আমলে শহিদ আসাদ তিনি আইয়ুব খানের পতনের দাবীতে মিছিল করার সময় ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। শহীদ আসাদ হচ্ছেন ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে একজন পথিকৃৎ। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান আমলে আইয়ুব বিরোধী  গণআন্দোলনে শহীদ হন মতিউর রহমান। ১৯৬৯ সালের  ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় পুনরায় মিছিল বের হলে সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন মতিউর রহমান। এ দুটো হত্যাকান্ড এক দশকের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে  গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় নিতে বাধ্য করে।পাকিস্তান আমলে পর স্বাধীন বাংলাদেশে  দুটো ঘটনায় যেন  ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিল। উরুগুয়ের সাংবাদিক এদুয়ারদো গালিয়ানো বলেছিলেন, 'ইতিহাস বিদায় বলে না, বলে পরবর্তীতে দেখা হবে।' এইচএম এরশাদ ১৯৮২ সালে একটি সেনা অভ্যুত্থানের  মধ্যদিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি প্রহসনের একটি নির্বাচন দেন।  নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন, কিন্তু বিরোধী দলগুলো তার এই প্রহসন ও জালিয়াতির নির্বাচন বলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। তাদের একমাত্র দাবী ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা। এই দাবিতে দেশের দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামীলীগ স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫-দলীয় ঐক্যজোটের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নিহত হন। আজ শহীদ ডা. মিলনের ২৯তম শাহাদত বার্ষিকী। ১৯৯০ সালের এইদিনে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় স্বৈরশাসক এরশাদের  লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. মিলন।ডা. মিলনের নিহতের মধ্য দিয়ে তখনকার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। এবং অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।এদিকে নূর হোসেন হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিরোধী দলগুলো ১১ ও ১২ই নভেম্বর সারা দেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, ফলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আরোও ত্বরান্বিত হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। এর মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে গণতন্ত্র পুণ-প্রতিষ্ঠিত হয়।এরশাদ পদত্যাগ করলে পরবর্তীতে বাংলাদেশে দুটি হ্যাঁ-না ভোটের মধ্য দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হয়।১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এতে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এর এক বছর পর সরকারের পক্ষ থেকে নূর হোসেন'র মৃত্যুর দিনটি সরকারিভাবে উদযাপনে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দিনটিকে প্রথমে ঐতিহাসিক ১০ই নভেম্বর দিবস হিসেবে পালন করা হলেও আওয়ামী লীগ এটিকে শহীদ নূর হোসেন দিবস করার জন্য সমর্থন প্রদান করে এবং এই নামে দিবসটি এখনো পালন হয়ে আসছে।এতক্ষণ আমরা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে দুজন স্বৈরশাসকের বিদায়ে চারজন অকুতোভয় দামাল সন্তানের ভূমিকা আলোচনা করলাম। এসব অতি সাধারণ আলোচনা মনে করি। সাদামাটা কথা। আজকে নূর হোসেন দিবস হেতু  কিছু কথা বলা প্রয়োজন। নূর হোসেন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এক জীবন উৎসর্গকারী বীর। তাঁর আত্মত্যাগের  মূল্যায়ন কি আমরা করতে পেরেছি? নূর হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার নামে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতি বছরের ১০ই নভেম্বর বাংলাদেশে নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এছাড়া তিনি যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তার নামানুসারে সেই গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে নূর হোসেন চত্বর। এতোটুকু কি যথেষ্ট? নূর হোসেন ১০ই নভেম্বর তাঁর নিহত হবার ১০ মিনিট পূর্বে  তোলা গায়ে লেখাযুক্ত আন্দোলনরত অবস্থায় ছবিটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে উঠেছে। নূর হোসেন যে উদ্দেশ্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তা সাময়িক সময়ের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করলেও বর্তমান সময়ে তাঁর আত্মত্যাগের শিক্ষা যেন ইতিহাসে ঠাঁই করে নিতে পারেনি। বরং নূর হোসেনের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো তার আত্মত্যাগকে ক্ষমতা আরোহণের সোপান হিসেবে ব্যবহার করেছে। নূর হোসেন স্বৈরশাসক এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া পেটুয়া বাহিনীর গুলিতে নিহত হলেও আওয়ামীলীগ নিজের কর্মী নূর হোসেনের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকা করে শুধু ক্ষমতার মোহে   এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথে একত্রে মহাজোট গঠন করে।শুধু তাই নয় আওয়ামীলীগ এরশাদকে নিয়ে সরকার গঠন করে একজন পতিত স্বৈরশাসককে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছে। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় কি জানেন? ১০ নভেম্বরকে এরশাদের জাতীয় পার্টি গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে।জাতির সঙ্গে এর চেয়ে বড় তামাশা আর কি হতে পারে? 
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসের আলোচনায়, 
নূর হোসেনকে ইয়াবাখোর ফেনসিডিল খোর বলে উল্লেখ করেন। যে নূর হোসেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এতো বড় ত্যাগ শিকার করলেন তাঁকে নিয়ে এতো বড় মিথ্যাচার করা হলেও শুধু ক্ষমতার মসনদের লোভে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। এই হলো আমাদের রাজনীতি!
২০১২ সালে এরশাদ অভিযোগ করেন বিরোধী দলগুলো নূর হোসেনকে তার সরকার বিরোধী একটি প্রতীকে রুপান্তরিত করেছে। তিনি বলেন,
"আপনারা (বিরোধী দল) আমাকে সরাতে লাশ নিয়ে এসেছিলেন, কারণ আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে এটা দরকার ছিল।" একথা শুনতে গা ঘিনঘিন করার মতো অবস্থা। এদেশে লাশ নিয়ে কম রাজনীতি হয়নি হচ্ছে না। 
বাস্তবে কি দেখছি নূর হোসেনদের লাশের ওপর রাজনীতি করেই তো আমোদ ফুর্তি করা হচ্ছে। নূর হোসেনরা হৃদয় দিয়ে যা বিশ্বাস করেন তা লালন করে জীবন সঁপিয়ে দেন। সুবিধা লোভীরা তা লুফে নেয়।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ই নভেম্বরের স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, সেদিন আমরা যখন মিছিল শুরু করছিলাম তখন নূর হোসেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তাঁকে কাছে ডাকলাম এবং বললাম তাঁর গায়ের এই লেখাগুলোর কারণে তাকে পুলিশ গুলি করবে। তখন সে তার মাথা আমার গাড়ির জানালার কাছে এনে বলল, "আপা আপনি আমাকে দোয়া করুন, আমি গণতন্ত্র রক্ষায় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত। 'শেষ কথা রাজনীতির শেষ কথা বলে কিছু নেই। হোক না সে স্বৈরাচার, দেশবিরোধী কিংবা রাজাকার তাদের সঙ্গে জোট বাঁধো।তাদের খুব বেশি প্রয়োজন ক্ষমতার মিষ্টি স্বাদ। নূর হোসেনরা কোনো রাজনৈতিক দলের হতে পারেন কিন্তু বেঁচে থাকবেন এদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে সত্যের প্রতীক হয়ে, জাতির সূর্য সন্তান হিসেবে।রাজনৈতিক দলগুলো নূর হোসেনদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারে কিন্তু দেশবাসী করবে না। আজ আরও নূর ও মিলনের মতো সাহসী সত্যের নিশানবাহী অকুতোভয় বীর সন্তান প্রয়োজন যারা কিনা আমাদের অন্ধকার হতে আলোর বন্দরে পৌঁছে দেবেন।নূরলদীনের সারাজীবন’নাটকে প্রতিবাদী নূরলদীন যখন হাঁক দিয়ে যান,
‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’।
ঘুমিয়ে পড়া বা ঝিমিয়ে পড়া  বাঙালি জাতির চেতনাকেই যেন জানান দিয়ে যায়, জাগবার সময় এখনই, নয়ত আর কখনই নয়।নূর হোসেন  যেন কবি সৈয়দ হকের নূরলদীন।
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়।
আজ নূর মিলনরা আমাদের মাঝে আবারো ফিরে আসুক কোনো স্বৈরাচার হটাতে,  জাতির মুক্তির অকুতোভয় কান্ডারি হয়ে।যারা এগিয়ে নিয়ে যাবেন এদেশ ও জাতিকে গৌরবের সুউচ্চ শিখরে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল