সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কচুরিপানা তুলকালাম ও বঙ্গ জনপদে কচুরিপানার রাজত্ব

 :



মো আবু রায়হানঃ সারাদেশে কচুরিপানা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। একজন মন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই সমালোচনা। যদিও মন্ত্রী তার বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ করেছেন। দ্রুত বিস্তার করতে পারা এই জলজ উদ্ভিদ নিয়ে রয়েছে নানান মজার ও বিব্রতকর কাহিনী। কচুরিপানা আমাদের দেশীয় কোনো উদ্ভিদ নয়। মনে করা হয় কচুরিপানা অর্কিড-সদৃশ ফুলের সৌন্দর্যপ্রেমিক  ব্রাজিলীয় এক পর্যটক ১৮ শতকের শেষভাগে বাংলায়  নিয়ে আসেন। তারপর কচুরিপানা এতো দ্রুত বাড়তে থাকে যে ১৯২০ সালের মধ্যে বাংলার প্রায় প্রতিটি জলাশয় কচুরিপানায় ভরে যায়। এরপর কচুরিপানা বাংলার প্রবাদ প্রবচন গানেও ঠাঁই করে নেয়। বাঙালি জীবনে কলহ-বিবাদ ও ঝগড়ায় প্রসঙ্গক্রমে এসে যায় কচুরিপানার কথা। প্রতিপক্ষের কথায় আক্রমণাত্মক হয়ে অপরজন বলে উঠে, ‘ভেসে আসা কচুরিপানা পেয়েছিস, ঠেলা দিলেই সরে যাব!গানেও কচুরিপানার দখল লক্ষ্য করা যায়, ‘থাকিলে ডোবাখানা হবে কচুরিপানা...’। 
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই কচুরিপানার ভুমিকা ছিল প্রশংসনীয়। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা  যখন গেরিলা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতে খাল বিলে লুকিয়ে থাকত তখন এই সামান্য কচুরিপানায় তাদেরকে মায়ের মত আচল দিয়ে লুকিয়ে ফেলতো।তাই তো কোনো এক কবি  বলেছেন,
" পুরুষের ভেতর হিংস্র কুকুর আর
 নারীর ভেতর বিষধর কাল-কেউটে ; দেখতে দেখতে
 এই সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে স্নিগ্ধতা -
 শৈশবের সেই কচুরিপানা ।
 অথচ এই কচুরিপানা ছিল একমাত্র মুক্তিকামী উদ্ভিদ,
 ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আড়াল; তথাপি
 ছিল বঙ্গবন্ধু প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত লক্ষ কোটি বাঙ্গালীর একবেলা আহার। "
খুব হালকা বেগুনি সাতটি পাপড়ির একটিতে মাত্র ময়ূরের পালকের মত আসমানী রংয়ের ছোঁয়া। তার মাঝে হলুদ রঙের যেন একটি তিলক। ময়ূরের পালকের মত দেখতে এই ফুলটির নাম হলো কচুরিপানা। কবির ভাষায়,
"নদীর ঘোলাতে অস্বচ্ছ জল
সাদা-বেগুনী ফুল থোঁকায় থোঁকায় কচুরিপানা,
তুমি কি দেখেছ কভু প্রিয়া ?
সবুজ আভায় ভাসমান আলপনা।"
গ্রাম বাংলার খাল বিল ডোবা জলাশয়ে শোভাবর্ধক এই ফুলটির ঘ্রাণ না থাকলেও কচুরিপানার ফুল নান্দনিক ও শিল্পশোভন একটি ফুল। এই ফুলের সৌন্দর্য শিশু-বৃদ্ধ সকলকে সমভাবে মুগ্ধ করে। 

কচুরিপানা বাঙালির গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্য ও সুন্দর একটি প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে পরিগণিত। এটি আমাদের খাদ্য হিসেবে তালিকায়  না থাকলেও, এর উপকারের দিক তো অস্বীকার করার উপায় নেই। আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে মিশরের নলখাগড়া থেকে যেমন প্যাপিরাস বা পেপার, কাগজ প্রস্তুত হতো। তেমনি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কচুরিপানা থেকে একধরনের কাগজ উৎপাদন বহু আগেই শুরু হয়েছে। যা দক্ষিণাঞ্চলে অনেকের গ্রামীণ জীবনের এনে দিয়েছে আর্থিক স্বচছলতা। হঠাৎ কচুরিপানা নিয়ে আলোচনার নেপথ্যের ঘটনা এবার জেনে আসি। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আর কচুরিপানা নিয়ে কিছু করা যায় কি না। আমি গ্রামের ছেলে, গ্রামের নদীগুলো সব (আটকে যাচ্ছে), কচুরিপানার পাতা খাওয়া যায় না কোনো মতে? গরু তো খায়। গরু খেতে পারলে আমরা খেতে পারব না কেন? আমি জানি না, বিষাক্ত কোনো ব্যাপার আছে কি না।’পরিকল্পনামন্ত্রীর এ বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এ বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষেও অনেকে যুক্তি দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কেউ বলেন,দুঃখ কষ্টের দিন শেষ এখন কচুরিপানার বাংলাদেশ। আবার কেউ বলছেন, কচুপাতা খেতে পারলে কচুরিপাতা খাওয়া যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত।এদিকে পরিকল্পনামন্ত্রী  বলেছেন, "কচুরিপানা খাওয়া যায় কি না, এটা নিয়ে কৃষি গবেষকদের গবেষণা করতে বলেছি। সরাসরি কাউকে কচুরিপানা খেতে বলিনি। আমার বক্তব্য কিছু মিডিয়ায় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।''
দেশের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলছে তাতে আমাদের বিকল্প খাদ্যের অনুসন্ধান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নতুন খাদ্যের সন্ধানে গবেষণা করার কথা বলে মন্ত্রী মহোদয় হাস্যরসের কথা বলেননি।বাঙালি সুযোগ পেলেই কোনো আইডিয়াকে না বোঝে ট্রল করতে পারলে নিজেদের বড় কিছু মনে করে।আমরা চিন্তার খোরাককে তুচ্ছ ভেবে অবহেলা করি। বাঙালির স্বভাবে এটি আবহমান কাল ধরে প্রবাহমান। মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের পর কেউ কেউ তরিতরকারির দোকানে কচুরিপানা রাখছে। কেউ কেউ কচুরিপানার রেসিপি তৈরী করে সেই ছবি সোসাল মিডিয়ায় আপলোড করছে।  জানা যাচ্ছে শোল মাছ দিয়ে কচুরিপানার ঝোলের প্রচলন নাকি বাংলাদেশের  কোথাও কোথাও আছে।আমরা জানি না সে ঝোলের কেমন স্বাদ। জানি না এর পুষ্টিগুণ বা খাবার হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু আছে। তবে কচুরিপানা যদি কলমি শাক বা শাপলার মতো জলজ উদ্ভিদের মতো কোনোদিন  আমাদের খাদ্যতালিকায়  জায়গা করে নেয় , এতে খারাপ  কিছু তো দেখি না।প্রতিদিন নতুন  চিন্তাধারা, ইনোভেশন আসছে। আগের দিনে মাশরুম দেখলে বলা হতো ব্যাঙের ছাতা, নিষিদ্ধ খাবার। এখন কিন্তু তা খাওয়া হচ্ছে। হয়তো এমন দিন আসবে, কচুরিপানা থেকেও খাবার আবিষ্কৃত হবে।আজ যা ফেলনা বা অখাদ্য মনে হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে তা খাবার হয়ে যাওয়ার ঘটনা তো কম নয়।
কচুরিপানার দ্রুত বংশ বৃদ্ধিতে এদেশে এক সময় নদ-নদীতে চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে আর জলাভূমির ফসল আমন ধান, পাট চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলে বাংলার অর্থনীতিতে  দেখা দেয় মন্থর গতি।সেই সময় কচুরিপানার বংশ নিয়ন্ত্রণ ও লাগাম টেনে ধরতে  সরকার ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা আইন জারি করে।তৎকালীন সময়ে বাংলার জলাভূমি আইন, বাংলার মিউনিসিপ্যালিটি আইন, বাংলার স্থানীয় সরকার আইন এবং বাংলার স্থানীয় গ্রাম সরকার এই চারটি আইন সংশোধন করে ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা আইন জারি করা হয়।  যার মাধ্যমে বাড়ির আশেপাশে কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কচুরিপানা পরিষ্কার অভিযানে অংশ নেয়াকে নাগরিকদের কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়।কচুরিপানা আক্রান্ত এলাকায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে কচুরিপানা দমনে কার্যকর অভিযান চালাতে নির্দেশিত হন।জনগণ এই কাজে উৎসাহের সঙ্গে যোগ দেয়। এমনকি ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে সবগুলো দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানার অভিশাপ-মুক্ত করার অঙ্গীকার ছিল।সেই নির্বাচনের পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে  কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে  শেরে বাংলা নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং কচুরিপানার বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান চালান।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...