গল্প : জেসহানের আম্মু
জেসমিন সাদাসিধে চঞ্চলা বুদ্ধিমতী মেয়ে। এইচএসসিতে পড়াশোনা অবস্থায় প্রথম বর্ষে ক্লাসমেট সোহানের সঙ্গে তার পরিচয় । এরপর থেকে তাদের গভীর বন্ধুত্ব। ক্যাম্পাসের সবাই জানতো তারা প্রেমিক জুটি। কিন্তু তখনো তাদের রিলেশন সে পর্যায়ে ছিল না । কথায় বলে আগে পরিচয় তার পর বন্ধুত্ব তারপর না হয় প্রেমিক প্রেমিকা চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে পরিণয়। ওদের দুজনের বন্ধুত্বটা যেন অন্যরকম। জেসমিনের বিপদ আপদে সোহান যেন নিবেদিত। তার কেয়ারিং পড়াশোনা সবখানে সোহানের সরব উপস্থিতি ছিল। সোহান ছোটবেলা থেকে খুবই মেধাবী এসএসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। শহরের নামিদামি স্কুলে তার ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সোহানের বাবা মা চাইতেন এইচএসসি পর্যন্ত সে তাদের চোখে চোখে থাকুক।সোহান এবং জেসমিনের বন্ধুত্ব এ পর্যায়ে জেসমিনের বাবা মা জেনে যায়। তার মা আলেয়া বেগম চায় না তাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় ও গভীর হোক। আলেয়া বেগমের ধারণা ছেলে মেয়েদের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। যা হয় সবই স্বার্থের সম্পর্ক ঠুনকো । তবে সোহানের বাবা মি.আজাদ এসব ব্যাপারে নির্লিপ্ত। যেন ছেলে সামলানোর দায়িত্ব একা মায়ের দায়িত্ব ।সরকারি চাকরি, বই পড়া নিয়ে তার ব্যস্ত সময় কাটে। গোয়েন্দা সিরিজের বই মি. আজাদের পছন্দের শীর্ষে। বই মেলা এলে সোহানের বাবার অস্থিরতা বেড়ে যায়। প্রত্যেকটা বুক স্টল তন্নতন্ন করে খুঁজে তার গোয়েন্দা কাহিনীর বই আনা চাই। সোহানের এসব বই ধরা ছোঁয়া সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।তার বাবার মি. আজাদের কথা এ স্টেজে এসব বই পড়া সমীচীন নয়।তার কথা এখন সোহানের একাডেমিক বই পড়ে রেজাল্ট করার সময়। বাকি জীবন তার বই পড়ার জন্য পরেই আছে। প্রতিটি বই পড়ে মি. আজাদ বুকসেলফে লক করে রাখে। তার কথা এসব বই তার ছেলে সোহানের জন্য অমূল্য সম্পদ ভবিষ্যতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। সোহানের এসব বই পড়ার প্রতি প্রবল আসক্তি থাকলেও সুযোগ না পাওয়ায় পড়তে পারে না। গত বার্থডে তে জেসমিন সোহানকে একটি বই গিফট করে।বইটি জেসমিন তার বান্ধবী রিফাত, পিয়া, বিথীর সঙ্গে গিয়ে বই মেলায় কিনেছিল। বইটির নাম ছিল বিসিএস হয়নি বলে। জেসমিনেরও বিসিএস দেবার ইচ্ছে। তার এক আঙ্কল বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখন বড় সরকারি আমলা। উপন্যাসটা পড়ে জেসমিনের অনেক ভালো লেগেছিল। শেষ পর্যন্ত নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ তাকেও কাঁদিয়েছিল। কষ্ট পাবার ভয়ে জেসমিন প্রেমের রিলেশনে জড়াতে চায় না। যদি ভালোবাসার সেই কাঙ্ক্ষিত আরাধ্য মানুষটিকে সে না পায়,তাহলে ভীষণ কষ্ট পাবে।জেসমিনের ভাবনা মন থেকে যাকে চাইবে তাকে তার পেতেই হবে। অবহেলা, বিচ্ছেদ সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না । সোহান একদিনে জেসমিনের দেওয়া বইটি পড়ে শেষ করে। বইটি তার বাবার হস্তগত হবার ভয়ে সোহান বইটি বালিশের কভারের ভেতরে রেখে কত রাত ঘুমিয়েছে! গিফট হিসেবে পাওয়া বইটির তার কাছে আলাদা একটা সমাদর ছিল। ইদানীং সোহানের চলাফেরায় ছন্দপতন ঘটে। খানাপিনা শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়া যেন সে ভুলেই গেছে। সব সময় জেসমিনের জন্য কিছু করতে পারলেই তার বিশ্বজয়ের হাসি মুখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে।
সোহান পড়াশোনায় ভালো ছিল বলে শিক্ষকদেরও বেশ স্নেহধন্য ছিল। নিয়মিত ক্লাস, নোট করা, আড্ডা দেওয়া সবই ছিল তার।গুরুত্বপূর্ণ নোট, সাজেশন সে জেসমিনকে দিতো।কখনো কখনো তারা দুজনে দূরে কোথাও ঘুরতে যেত। বিশাল আকাশের শেষ সীমা দেখবে বলে। আকাশের বিশালতা তাদেরকে আরো কাছে টানে। তাদের মধ্যে বোঝাপড়াও হয়ে উঠে চমৎকার।তারা দুজন দুজনের প্রতি বেশ দুর্বল। কিন্তু কেউ কাউকে কখনো ভালো লাগার কথা বলতে পারেনি। বললে যদি তাদের ভালো বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যায়। ভীষণ কষ্ট পাবে। নিজের ভালো লাগা দুজনেই মনের গভীরে জিয়ে রাখে। সোহান সুযোগ খোঁজে তাকে ভালো লাগার কথা বলার জন্য। ইতোমধ্যে এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে। সোহান পরিকল্পনা করে পরীক্ষার আগেই তাকে প্রপোজ করবে। কিন্তু কিভাবে? তার দুশ্চিন্তা জেসমিন যদি তাকে ইগনোর করে তার পরিণতি কি হবে? এতোদিনের বন্ধুত্ব স্মৃতি সুখ দুঃখ কষ্টের মুহুর্তগুলো? কি হবে এই রিলেশনের? নানান বিচিত্র চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। কয়েকদিন পর পরীক্ষা সোহানের পড়াশোনাও তেমন হচ্ছেন না। কলেজে আসা যাওয়া দুজনের বন্ধ। বাইরে বের হয়ে দেখা করারও সুযোগ নেই।পরীক্ষার দুদিন আগে এডমিট কার্ড বিতরণ। অনেকটা পরিপাটি হয়ে সোহান কলেজে যায়। কিন্তু সেদিন জেসমিনের মা এসে এডমিট কার্ড নিয়ে যায়। সোহান বুকের ভেতর হালকা কষ্ট অনুভব করতে লাগলো। জেসমিনকে দেখতে না পাবার যন্ত্রণা তাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। আজ কলেজে সে জেসমিনকে তার ভালো লাগার কথা জানাতে চেয়েছিল।কিন্তু তার সুযোগ হলো না। সন্ধ্যায় সোহান বের হলো তার নিত্য বাহন সাইকেল নিয়ে। জেসমিনদের বাসায় যাবে বলে। সোহানদের বাসা থেকে জেসমিনদের বাসা ৫ কিমি: দূরত্বে । জেসমিনের সঙ্গে এতো ভালো বন্ধুত্ব থাকার পরও সোহান তাদের এলাকায় আগন্তুক প্রায়। কদাচিৎ তার সেখানে যাওয়া হতো। জেসমিন তাদের বসুধা ভিলার দুতলায় থাকতো। বিকেলে প্রায় জেসমিন তাদের বাসার বেলকনিতে পায়চারি করতো। মির্জা বংশের মেয়ে হিসেবে আশেপাশের এলাকায় তাদের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি বিদ্যমান ।এলাকার সবাই তাদের সমীহ করে চলে। জেসমিনের রুমের পাশের বেলকনি থেকে আশেপাশের সবই দৃশ্যমান। সেদিন বিকেলেও জেসমিন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে নিচে দৃষ্টি পড়তেই জেসমিন সোহানকে দেখলো সে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো। জেসমিন এক দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নিচে এসে সোহানের পাশে এসে দাঁড়াল।এক নিঃশ্বাসে বলল সোহান তুমি? মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! তোমাকে না খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। তুমি আসছো বেশ করছো। বাসায় চল। সোহান কিছুটা ইতস্ততবোধ করে বলল আজ না আরেক দিন। সোহান খুব ভয়ে ভয়ে এক টুকরো কাগজ জেসমিনের হাতে ধরিয়ে দিল। বলল বাসায় গিয়ে খুলবে।আমার তাড়া আছে। বলে সোহান সাইকেল নিয়ে সাঁসাঁ করে চলে গেল। জেসমিন অপলক দৃষ্টিতে সোহানের পথ পাণে চেয়ে থাকে। যতদূর দৃষ্টি সীমা যায়।
বাসায় গিয়ে কাগজ খুলতেই জেসমিন সারপ্রাইজড। কাগজে লেখা আই লাভ ইউ। যদি তুমি আমাকে লাভ করো তাহলে আগামীকাল সন্ধ্যায় তোমার বেলকনিতে একটি প্রদীপ জ্বেলে রাখবে। যদি সত্যি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো।আমি সন্ধ্যায় প্রদীপ দেখে বুঝবো তোমার হ্যাঁ অথবা না। জেসমিনের গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা আনন্দাশ্রু পড়ে। সে খুশিতে আত্মহারা। কাগজের টুকরোটার দিকে আবেগে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠে ধন্যবাদ সোহান। আই এলসো লাভ ইউ। পরের দিন সকালে জেসমিন কাজের বুয়াকে দিয়ে একটি মোমবাতি এনে রাখে। ভেতরে আজ অন্য রকম শিহরণ। বুকের ভেতরে আজ ভালো লাগার আবেশ। কখন সন্ধ্যা হবে। প্রদীপ জ্বেলে কখন আলোকিত করবে তার ভালোবাসা!এদিকে সোহানের কাটছে নির্ঘুম রাত। বুকের ভেতরটা চিনচিন করছে। জেসমিন আমার ভালোবাসায় সাড়া দেবে তো? না আজীবনের জন্য বন্ধুত্ব নষ্ট করলাম। পরের দিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই সোহান জেসমিনদের বসুধা ভিলার সামনে হাজির। তারা ভালোবাসার প্রদীপের প্রোজ্জ্বলন উপভোগ করতে। বাসা থেকে সোহান বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সেটি দেখার জন্য। জেসমিনের মোমবাতি রেডি কিন্তু আগুন জ্বালাতে গিয়ে বিপত্তি ঘটল। বাসায় কোথাও দিয়াশলাই পেল না। এ সন্ধ্যায় কোথাও গিয়ে দিয়াশলাই আনার মতো ফুসরতও নেই। অনেক ছুটোছুটি করেও লাভ হলো না। ভাবলো আগামীকাল পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষার পর তার অনুভূতি জানাবে।এই ভেবে জেসমিন পড়ার টেবিলে গেল। আগামীকাল পরীক্ষা আজ মাথায় কিছুই ঢুকছে না। জানা শোনা জিনিসও ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে তার।জেসমিনের মন ভীষণ খারাপ। রাতের খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। মায়ের বকুনি হজম করার ভয়ে একটু খেয়ে ঘুমুতে গেল। এদিকে সোহান তার ভালোবাসার সবুজ সংকেত না পেয়ে বুক ভরা কষ্টে জর্জরিত হয়ে বাসায় ফিরে ।বিপর্যস্ত সোহান বাসায় ফিরে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরের দিন পরীক্ষায় সে অংশ নিতে পারলো না।
পরীক্ষার কেন্দ্রে জেসমিনের দুটো চোখ শুধু সোহানকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু শতশত পরীক্ষার্থীর ভীড়ে কোথাও তাকে পেল না। অনেক পরিচিতজনকে সোহানের কথা জিজ্ঞেস করলো।কিন্তু কেউ সোহানের কোনো খোঁজ দিতে পারলো না। জেসমিনের বুকে যেন পাহাড় ভেঙে পড়ল। নিজেকে বড্ড অপরাধী ও পরাজিত মনে হতে লাগলো। জানে না তার সোহান কতটা কষ্ট পেয়েছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে জেসমিন পরীক্ষার কক্ষে প্রবেশ করল।পরীক্ষার তিনটা ঘন্টা নানা অজানা আশঙ্কা মনে উঁকি দিতে লাগলো।পরীক্ষা শেষ হলো। বাইরে রিকসা নিয়ে জেসমিন সোজা সোহানদের বাসায় গিয়ে হাজির। এ প্রথম তার সোহানদের বাসায় আসা। সোহানের পাশে তার মা সালমা দাঁড়িয়ে। সোহান জেসমিনকে দেখেই বাম দিকে পার্শ্ব বদলে নেয়। তার গায়ে কম্বল। প্রচন্ড শীতে কাঁপছে। জেসমিন আস্তে গিয়ে তার মাথার কাছাকাছি বসে তার হাতটি আলতো করে সোহানের মাথায় রাখলো। জেসমিন সোহানের মাথার প্রচন্ড উত্তাপ অনুভব করল।জেসমিন সোহানের মাকে বলল আন্টি সোহানের জ্বর অনেক বেশি।মাথায় পানি দিতে হবে। সোহানের মা এক বালতি পানি এনে দিল। জেসমিন আস্তে আস্তে সোহানের মাথায় পানি ঢালতে থাকে। তার গতরাতের অসহায়ত্ব আর ব্যর্থতা তাকে অপরাধী করে তুলল। এবার অস্ফুট কন্ঠে সোহান বলল তুমি কেন এসেছো? আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। এক্ষুণি চলে যাও।গতরাতের ঘটনা জেসমিন সব খুলে বলল। তার অপারগতা ও কষ্টের কাহিনীও শোনালো। খুবই অনুতপ্ত জেসমিন। আই এলসো লাভ ইউ বলে জেসমিন সোহানকে জড়িয়ে ধরল।দরজায় সোহানের মায়ের প্রবেশের শব্দ পেয়ে দুজনে স্বাভাবিক হয়ে গেল। ঐদিনের মতো জেসমিন বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে। রিকসায় উঠে সর্বশেষ ঘটে যাওয়া দৃশ্য গুলো তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল। নিজের দায়িত্বহীনতা ও অসতর্কতা সোহানের জীবনকে এক বছর পিছিয়ে দিল।
পরীক্ষার পুরো সময়টা সোহান বাসায় থাকতো। মাঝেমধ্যে জেসমিন পরীক্ষা শেষে দেখা করে যেত। পরীক্ষার পর সোহান এবং জেসমিন রুপ সাগরে বেড়াতে যায়। সারাদিন তারা সেখানে থাকে। তাদের বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়ের সম্পর্কটা দিনদিন গভীর হতে থাকে। একে অপরের চোখের আড়ালে যেন দুর্বিষহ কষ্টের অনুভূতি জাগায়। সেদিনের মতো তারা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে। কিন্তু দুটো মন যেন পড়ে আছে স্মৃতির আঙিনায়। খুঁনসুটি আর আদরে ভরা সেই রুপ সাগরের মায়ায়। কিছুদিন পর জেসমিনের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো।জেসমিন সন্তোষজনক একটি রেজাল্ট করে। রেজাল্ট পেয়েও সে ভীষণ কষ্ট অনুভব করে সোহানের জন্য। তার বোকামির জন্য সোহানের আজ এই দশা। নিজেকে কিছুতেই শান্তনা দিতে পারছে না। সোহান জেসমিনের রেজাল্ট জেনে যায়। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। পরের দিন তারা দুজনে ঘুরতে যায়। জেসমিন সোহানকে অনেক শান্তনা দেয়। সোহানের ভয় সে যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়। জেসমিন তাকে কথা দেয় পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকুক সে শুধু সোহানের। সেদিন জেসমিন সোহানকে যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল গিফট করে। জেসমিনের আগে থেকেই একটি মোবাইল ছিল। জেসমিন কোথায় ভর্তি হবে, তার বাবা মার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেয় সোহানকে। এরমধ্যে জেসমিনের মোবাইলে তার মায়ের কল আসে। জেসমিন তাড়াহুড়া করে বাসায় ফিরে। এরপর থেকে তারা মোবাইলে যোগাযোগ করে। দুজনের দেখা সাক্ষাৎ, ঘুরাঘুরি সবই হচ্ছে।জেসমিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিংয়ের জন্য শহরে যায়। ফোনে সোহানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতে থাকে।ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে জেসমিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের একটি কলেজে দর্শনে বিভাগে ভর্তি হয়। তাদের যোগাযোগ দেখা সাক্ষাৎ ভালোই চলছে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় জেসমিন একদিন বাসায় চলে আসে। সুস্থ হবার পর জেসমিনের মা তাকে বিয়ে শাদির ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার কথা বলে। পছন্দ আছে কি না সে বিষয়েও জিজ্ঞেস করে। জেসমিন সোহানের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কিছু না বলে বরং ভালো ভাবে পড়াশোনায় মনযোগী হতে চায় বলে তার মাকে জানায়। জেসমিনের মা বলে ভালো পাত্র পেলে তিনি হাত ছাড়া করতে চান না। জেসমিন কিছু না বলে তার রুমে প্রবেশ করল।জেসমিন সোহানকে কল দিয়ে সব ঘটনা সহসাই জানিয়ে দিল। সোহান জেসমিনকে বলল দেখ জেসহানের আম্মু আমি তোমাকে ছাড়া জীবনে কাউকে গ্রহণ করতে পারবো না। তোমার বিকল্প কাউকে ভাবতে পারি না। জেসমিন গর্জে উঠল জেসহানের আম্মু মানে? সোহান এবার এক গাল হেসে বলল আরে আমাদের ছেলে বাবুর নাম হবে জেসহান। তোমার নামের শুরুর দুই বর্ণ আর আমার নামের শেষের দুই বর্ণ মিলে জেসহান। চমৎকার না?জেসমিন,হুম গাছে কাঠাল গোঁফে তেল। আচ্ছা কাল তুমি আমাদের খেলার মাঠে দেখা করো বলে জেসমিন ঠাস করে লাইনটা কেটে দিল। সেই রাতে দুজনের চোখে যেন ঘুম নেই।
কোনোমতে সকাল হতেই সোহান তার সাইকেল চালিয়ে খেলার মাঠে হাজির। এখনো জেসমিন আসেনি। খেলার মাঠ থেকে জেসমিনদের বাসা কয়েক গজ দূরে। এলাকার সবাই চেনে। বসুধা ভিলা বললে সোজা বাজার থেকে রিকসা তাদের বাসার সামনে এনে নামিয়ে দেবে। সোহান জেসমিন না আসায় মাঠে পায়চারি করছিল। ঘন্টা খানেক পর জেসমিনের আগমন ঘটে। শান্ত শিষ্ট বিনয়ী সোহান ভেতরের রাগ চেপে রেখে স্বাভাবিক ভাবেই জেসমিনের সঙ্গে কথা বলে। আজ সোহানের কাছে জেসমিনকে অসাধারণ লাগছে। কোনো এক লেখায় সোহান পড়েছিল দুই সময় নারীকে অপূর্ব লাগে প্রথমত: গোসলের পর দ্বিতীয়ত: ঘুম থেকে জাগার পরে। সোহানের মনটা জেসমিনকে দেখে উরু উরু। ভেতরে রোমান্টিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মনের অজান্তে মুখ থেকে বের হয়ে এলো জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতার কয়েকটি শ্লোক
'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর হাল ভেঙে যে ...'বলতেই জেসমিন তার হাত দিয়ে সোহানের মুখ চেপে ধরে। জেসমিন বলে হইছে ঢং দেখাতে হবে না। এমনি পরীক্ষা না দিয়ে জুনিয়র হয়ে আছ। তারপরে এ অবস্থা! বাসা থেকে মহা সরগরমে ছেলে দেখাদেখি হচ্ছে। আমার বাবা মা যে জেদি আর রাগি তোমাকে মেনে নেবে বলে মনে হয় না। আমার কথা শেষ। এখন তুমি কি করবে তোমার সিদ্ধান্ত। যদি আমাকে বিয়ে না করো হয় বিষ খাবো নয়তো .... বলেই জেসমিন হনহন করে বাসার দিকে রওনা হলো। সোহান পড়ে গেল মহা টেনশনে একে তো বেকার, পড়াশোনা! মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম।এক বুক বিষন্নতা নিয়ে সোহান বাসায় ফিরে। ফর্সা সোহানের মুখটা আজ বড়ই বিবর্ণ দেখাচ্ছে। খাওয়া নাওয়া সব বন্ধ। জেসমিনের পরিবার তো এ বিয়ে মেনে নেবে না। তাহলে উপায় কি?এক চোখে ভাসছে প্রিয়সী জেসমিনের ছবি অন্য চোখে বাবা মা ভাইবোনের ছবি। তবে কি সবার মুখে চুনকালি দিয়ে কলঙ্কের বোঝা নিয়ে সব ছেড়ে চলে যাবে? নানা সাত সতেরো চিন্তায় নিস্তব্ধ সোহান। এরমধ্যে কল আসে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জেসিমিনের কন্ঠ । কাঁদো কাঁদো কন্ঠে জেসমিন বলল, শোনো সোহান বাবা তার বন্ধুর ছেলে দীপেনের সঙ্গে বিয়ের কথা দিয়ে রেখেছে। ছেলে নাকি আমাকে কোনো এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে দেখেছে।আগামী সপ্তাহে বিয়ের সব কিছু পাকাপাকি করতে চায়। ছেলে বেসরকারি একটি ব্যাংকে জব করে। জেসমিন তার কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বলে শোনো সোহান আমার অর্থ বিত্ত টাকা কড়ি প্রয়োজন নেই। আমি আমার ভালোবাসাকে চাই। তুমি ছাড়া আমার এই জগৎ অন্ধকার। আমার সামনে দুটো অপশন হয় তুমি আমাকে বিয়ে করবে নয়তো আমি সুইসাইড করবো। জেসমিন আরো আক্রমণাত্মক মুডে সোহানকে বলে তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো সুইসাইড নোটে আমার মৃতুর জন্য তুমিই দায়ী লিখে যাবো। এখন কি করবে সিদ্ধান্ত নাও। আর আগামীকাল সকাল দশটায় বাজারে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। একথা বলে জেসমিন কল কেটে দেয়। সোহানের হার্টবিট বাড়তে থাকে। সমস্ত শরীর যেন নিস্তেজ হয়ে আসে। কি করবে কিং কর্তব্য বিমূঢ়। পিতামাতা সবার স্বপ্ন চুরমার করে কি জেসমিনের টানে চলে যাবে? শরীর ঘেমে লেবুর রসের মতো ঘাম ঝরছে। এরমধ্যে ঘরে সোহানের মা প্রবেশ করে। সোহানের অপ্রস্তুত ইতস্তত অবস্থা দেখে তার মা ঘাবড়ে যায়। মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেহের উত্তাপ বোঝার চেষ্টা করল। সোহানের মা সোহানের মাথায় পানি দিতে চায়। সোহান তার মাকে বলে ওকিছু না এমনি ঠিক হয়ে যাবে। তুমি অযথা টেনশন করো না। তার মা রুম থেকে বের হয়ে গেল।
এবার সোহান বারবার জেসমিনের ফোনে কল দিতে চেষ্টা করে কিন্তু ফোন বন্ধ। সারাদিন ভাবনা চিন্তায় ওদের কেটে যায়। পরের দিন সকালে আগে থেকেই জেসমিন বাজারে সোহানের অপেক্ষায়।
যথা সময়ে সোহান হাজির হয়।সোহানকে পেয়ে জেসমিন ছলছল চোখে সোহানকে জড়িয়ে ধরে।
এরপর দুজনে রিকসা চেপে রওনা দেয় শহরের উদ্দেশ্যে।শৈশবের স্মৃতি, প্রিয়মুখ গুলো পেছনে ফেলে অনিশ্চিত গন্তব্যে ছুটে চলছে দুটো মন। চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি। ভালোবাসার পূর্ণতায় বিস্মিত তারা। বাঁধা বিপত্তির সোপান পেরিয়ে আজ তারা মুক্ত বিহঙ্গ। শহরের কাজি অফিসে গিয়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। শহরের পাশেই রুপনগরে একটি বাসার চিলোকোটায় দুজনের নতুন সংসার জীবন শুরু। টিউশন করে তারা জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এরমধ্যে জেসমিনের জন্য আসে সুখবর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্ত নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। সোহানও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এক বছরের মাথায় তাদের কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে ছেলে সন্তান। তাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হয় জেসহান। সেদিন থেকে সোহানের ভালোবাসার প্রিয়তমা জেসমিন হয়ে যায় জেসহানের আম্মু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন