নীল নদ নয় লোহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন হযরত মুসা (আ.)
মো আব রায়হানঃ হযরত মুসা (আ.) একজন নবি ও রাসুল।বাইবেলে তিনি মোজেস নামে পরিচিত।তাঁর ওপর আসমানী কিতাব তাওরাত নাযিল হয়েছিল। আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য তাঁকে কালিমুল্লাহ বলা হয়।তিনি ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত রাসুল বা আল্লাহর বার্তাবাহক। কোরআনে মুসা (আ.) এর নাম অন্য নবীদের তুলনায় বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। ধারণা করা হয় যে মুসা (আ.) ১২০ বছর বেঁচে ছিলেন। হযরত মুসা (আ.) এর অসংখ্য মুজেজা ছিল। তন্মধ্যে উল্লেখ করার মতো মুজেজা হলো তাঁর হাতের লাঠি মাটিতে নিক্ষেপ করলে বিশালাকার অজগর সাপে পরিণত হতো।
হযরত মুসা (আ.) এর জাতি বা কাওমের নাম ছিল বনী-ইসরাঈল। ইসরাঈল একটি হিব্রু শব্দ। যার অর্থ–আল্লাহর বান্দা। হযরত ইয়াকুব (আ.)এর আরেকটি নাম হলো ইসরাঈল। কুরআনে ইহুদিদেরকে ইয়াকুব (আ.) এর বংশধর’ না বলে ইসরাঈলের বংশধর বলা হয়েছে, যেন ইহুদিরা এটা ভুলে না যায় যে, তারা আল্লাহর বান্দার বংশধর। তাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে তারা যেন তাদের রাবাইদের উপাসনা না করে, শুধুমাত্র আল্লাহরই উপাসনা করে।আরেকটি ব্যাপার হলো বনী ইসরাঈল বলতে আজকের ‘ইসরাঈল’ নামক দেশে যারা থাকে, তাদেরকে বুঝায় না। হযরত মুসা ( আ.) এর সমসাময়িক প্রাচীন মিসর দেশেরএকজন শাসক ছিল ফেরাউন বা ফারাও। ফেরাউন কারো নাম নয়।প্রাচীন মিশরীয় রাজবংশের রাজাদের প্রচলিত উপাধি ছিল ফারাও বা ফেরাউন। বিশাল বিশাল প্রাসাদে বসবাসকারী রাজার উপাধী ছিল ফারাও। যার অর্থ হচ্ছে বৃহৎ গৃহ। বনি ইসরাঈল যুগের ধর্ম যাজক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের কর্তা ব্যক্তিদের উপাধি ছিল ফেরাউন। পরবর্তীতে বনি ইসরাঈলরা যখন রাজ্য শাসনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন যারা ঐ অঞ্চলের শাসক হতো তাদেরকে ফেরাউন বলে সম্বোধন করা হতো।হযরত মুসা (আ.)-এর সময় যে ফেরাউন হযরত মুসা (আ.) বিরোধিতা করেছিল, কেউ কেউ তার নাম বলেছেন দ্বিতীয় রামাসিস। আর কেউ কেউ বলেন, সে ছিল দ্বিতীয় রামাসিসের পুত্র মারনেপতাহ বা মিনফাতাহ। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়। হযরত মুসা (আ.) এমন এক ফেরাউনের আমলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন- যিনি রামেসিস ও পিথম নগরী নির্মাণ করেন। সে-ই হচ্ছেন দ্বিতীয় রামেসিস।কেউ কেউ বলেন হযরত মুসা (আ.) মাদায়ানে অবস্থানকালে ক্ষমতাসীন ফেরাউনের (অর্থাৎ দ্বিতীয় রামেসিসের) মৃত্যু ঘটে এবং হযরত মুসার জীবনের পরবর্তী ঘটনাবলী সংঘটিত হয় দ্বিতীয় রামেসিসের উত্তরাধিকারী মারনেপতাহর শাসনামলে।কেউ কেউ বলেন, হযরত মুসা (আ.) যুগের ফেরাউনের নাম ছিল ওলীদ ইবনে মাসআব ইবনে রাইয়ান। তার বয়স হয়েছিল ৪০০ বছরেরও বেশি।সুতরাং ফেরাউনদের নাম যাই হোক কেন, তৎকালীন শাসকদের খেতাব ছিল ফেরাউন। ইতিহাসে এ সকল শাসকরা ফিরাউন নামে পরিচিতি লাভ করেছে।হযরত মুসা ( আ.) যখন আল্লাহর বাণী প্রচার করছিলেন তখনকার ফেরাউন নিজেকে খোদা দাবী করেছিল।ফেরাউন বলেছিল, আমি তোমাদের খোদা। আমি তোমাদের সৃষ্টি কর্তা। আমি তোমাদের পালন কর্তা। ফেরাউন ও তার সভাসদবর্গ বনি ইসরাঈলের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালায়। এজন্য হযরত মুসা (আ.) তাঁর উম্মতকে ধৈর্য ধারণ ও আল্লাহর ওপর ভরসা করার পরামর্শ দেন। ফেরাউন ও তার সভাসদবর্গ বনি ইসরাঈল কেবল দৈহিক যন্ত্রণাই দেয়নি, তারা তাদের ঘরবাড়ি ও প্রার্থনাগৃহ ধ্বংস করে দেয়। দেশময় মুসা (আ.)-এর দাওয়াতের প্রসার বন্ধ করার জন্য বনি ইসরাইলের ওপর অত্যাচার শুরু করে। ফেরাউন ঘোষণা করে, ‘আমি এখনই টুকরা টুকরা করে হত্যা করব ওদের পুত্রসন্তানদের এবং বাঁচিয়ে রাখব ওদের কন্যাসন্তানদের। আর আমরা তো ওদের ওপর (সব দিক দিয়েই) ক্ষমতাবান।’ (সুরা আরাফ আয়াত ১২৭)।
মহান আল্লাহ বলেন,''আমরা মূসার প্রতি এই মর্মে অহী করলাম যে, আমার বান্দাদের নিয়ে রাত্রিযোগে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্কপথ নির্ধারণ কর। পিছন থেকে এসে তোমাদের ধরে ফেলার আশংকা কর না এবং (পানিতে ডুবে যাওয়ার) ভয় কর না’।(সুরা ত্বোয়াহা- ৭৭)।আল্লাহর আদেশ পেয়ে মূসা (আ.) রাত্রির সূচনা লগ্নে বনু ইসরাঈলদের নিয়ে রওয়ানা হলেন। তাঁরা সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হলেন।আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'অতঃপর যখন উভয় দল পরস্পরকে দেখল, তখন মুসার সঙ্গীরা (ভীত হয়ে) বলল, ‘আমরা তো এবার নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম’। ‘তখন মূসা বললেন, কখনই নয়, আমার সাথে আছেন আমার পালনকর্তা। তিনি আমাকে সত্বর পথ প্রদর্শন করবেন’। ‘অতঃপর আমরা মূসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড় সদৃশ হয়ে গেল’। ‘ইতিমধ্যে আমরা সেখানে অপরদলকে (অর্থাৎ ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনীকে) পৌঁছে দিলাম’। ‘এবং মূসা ও তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম’। ‘অতঃপর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম’।(সুরা আশ শুয়ারা আয়াত ৬০-৬৬)।
মূসা ও বনু ইসরাঈলদেরকে সাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে দেখে ফেরাউন দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে সবার আগে শুষ্ক সাগর বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিছনে তার বিশাল বাহিনীর সবাই সাগরের মধ্যে নেমে এলো। যখন তারা সাগরের মধ্যস্থলে পৌঁছে গেল, তখন আল্লাহর হুকুমে দু’দিক থেকে বিপুল পানি রাশি ধেয়ে এসে তাদেরকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলল।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর ফেরাউন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। কিন্তু সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলল’ (ত্বোয়াহা আয়াত ৭৮)।মাঝেমধো একটি প্রশ্ন করা হয়,আচ্ছা বলুন তো পৃথিবীর মধ্যে এমন একটি জায়গার নাম, যেখানে মহান আল্লাহ পাক মাত্র একবারই সূর্যের আলো ফেলেছিলেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন দিন সেই জায়গায় সূর্যের আলো পৌঁছাবে না।স্বভাবতই অনেকে ভুল করে ফেলি। কেননা মিসর বলতেই যেহেতু নীলনদ মাথায় চলে আসে, সেহেতু অনেকেরই এমনটা মাথায় গেঁথে থাকে যে, মুসা (আ.) ও তার সঙ্গীদের পার হতে নীলনদ ভাগ হয়ে গিয়েছিল এবং সেখানেই একবার সূর্যের আলো পড়েছিল। কিন্তু মোটেও তা নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাত সেই স্থানটি মূলত লোহিত সাগরের একটি স্থান। যেখানে হযরত মুসা (আ.) এর মু’জিযার কারণে বাহরে কুলযুম তথা লোহিত সাগরের উপর রাস্তা হয়ে যায় আর সেখানে সূর্যের আলো পৃথিবীর ইতিহাসে একবারই পড়েছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত আর পড়বে না। কুরআনে কেবল সাগর বলা হয়েছে কিন্তু সেই সাগরের নাম উল্লেখ নেই।
রেড সী বা লোহিত সাগরের ঠিক কোন জায়গা দিয়ে হযরত মুসা ও তাঁর বনি ইসরাঈল জাতি পার হয়েছিল সেটা নিয়ে ধর্মীয় ইতিহাসবিদদের মাঝে রয়েছে ব্যাপক মতভেদ।তওরাতে বলা হয়েছে সাগরের সে জায়গাটির নাম ইয়াম সুফ যার ইংরেজি অর্থ 'সী অফ রিডস' (Sea of Reeds) বা বাংলায় 'নলখাগড়ার (Seaweed) সাগর। এখনও সেই অঞ্চলে জন্মে রীডস বা নলখাগড়া। ধারণা করা হয়, ইয়াম সুফ জায়গাটি লোহিত সাগরের কাছের এক বিশাল হ্রদের মতো ছিল, যা সাগরের সবচেয়ে সরু অংশ- এটি পার হলেই ওপারে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু সুয়েজ খালের কারণে সেই জায়গা এখন শুকিয়ে গেছে। মিসরের সিনাই উপদ্বীপের সুয়েজ উপত্যকাতেই ছিল এর অবস্থান।
তবে প্রচলিতভাবে একে লোহিত সাগর অনুবাদ করা হয়, এবং এ ভুল অনুবাদটি তৃতীয় শতকে গ্রিক অনুবাদ করতে গিয়ে হয়ে যায়, এবং সেই অনুবাদ চলে আসে ল্যাটিনেও। আর সেই থেকে প্রচলিত হয়ে যায় লোহিত সাগর। কিন্তু লোহিত সাগর বেশ বড় একটি এলাকা, যেখানে সী অফ রিডস একটি নির্দিষ্ট জলজ এলাকা। কিন্তু পাশ্চাত্য মনীষী লুইস গোল্ডিং-এর তথ্যানুসন্ধান মূলক ভ্রমণ কাহিনী IN THE STEPS OF MOSSES, THE LAW GIVER -এর বরাতে লিখেছেন যে, ওটা ছিল লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হ্রদ’।কোনো কোনো মনীষীর মতে সাগরীয় এলাকা গালফ অব আকাবা (Gulf of Aqaba) বা আকাবা উপসাগরও হতে পারে। কেউ কেউ 'তানিস হ্রদ'-কে (Lake of Tanis)হযরত মুসার সাগর বিদীর্ণ করার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মিসরের আধুনিক তাফসীরকার তানতাভীও (মৃঃ ১৯৪০ খৃঃ) বলেন যে, লোহিত সাগরে ডুবে মরা ফেরাঊনের লাশ ১৯০০ খৃষ্টাব্দের মে মাসে পাওয়া গিয়েছিল।সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম সাগরতীরে যেখানে ফেরাউনের লাশ সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, আজও জায়গায়টি অপরিবর্তিত আছে। বর্তমানে এ জায়গার নাম জাবালে ফেরাউন বা ফেরাউন পর্বত। এরই কাছাকাছি আছে একটি গরম পানির ঝরনা। স্থানীয় লোকেরা এর নাম দিয়েছে হাম্মামে ফেরাউন। এর অবস্থানস্থল হচ্ছে আবু জানিমের কয়েক মাইল ওপরে—উত্তরের দিকে। স্থানীয় লোকেরা জায়গাটি চিহ্নিত করে বলে, ফেরাউনের লাশ এখানে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।তবে উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় অধিকাংশ ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে হযরত মুসা (আ.) লোহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন নীল নদ নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন